শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫, ১২:১৫ অপরাহ্ন

বিদ্যুৎ বিভ্রাটে বিপর্যস্ত গ্রামের মানুষ

এনবিডি নিউজ ডেস্ক :
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ১০ মে, ২০২৩
  • ৫৭ বার

তীব্র গরমে মানুষের যখন বেহাল দশা তখন বাংলাদেশজুড়ে বিদ্যুতের লোডশেডিংও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। বিদ্যুঃ পরিস্থিতি নিয়ে সবচেয়ে বেশি নাকাল হচ্ছেন গ্রামাঞ্চলের মানুষ। কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে এখন চাহিদার বিপরীতে প্রায় ১ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে।

চট্টগ্রামের ইসমাইল কলোনী এলাকার বাসিন্দা শাহিন আক্তার রুমি। গত শুক্রবার ফটিকছড়ি এলাকার বক্তপুর গ্রামে কয়েকদিন বেড়ানোর জন্য গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু লোডশেডিং আর গরমের কারণে চার দিনের মাথায় চট্টগ্রামের ফিরে যেতে বাধ্য হন তিনি।

রুমি বলেন, গ্রামে এত বেশি লোডশেডিং হয় যে ঘণ্টাখানেকও বিদ্যুৎ থাকছে না।

‘১০ মিনিট যদি কারেন্টটা ভালো করে থাকতো আরকি। এমন অবস্থা যে চার্জ দেয়ার সুযোগটা হচ্ছে না। বাচ্চা নিয়ে গেছি, বাচ্চাটার এমন অবস্থা হইছে আমি আবার চিটাগাং শহরে ফিরে আসতে বাধ্য হইছি।’

তার মতে, চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ গেলেও ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে আবার চলে আসে। বুধবার দুপুর ২টার দিকে যখন তার সাথে কথা হচ্ছিলো তখন তিনি জানান, সকাল থেকে এরইমধ্যে প্রায় ২ থেকে ৩ বার বিদ্যুৎ চলে গেছে।

চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ সরওয়ার জাহান বলেন, রাঙ্গুনিয়া, রাউজান ও ফটিকছড়ি উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত তিনি। এই তিন উপজেলায় ১০ মিনিটও বিদ্যুৎ থাকে না কথাটি ঠিক নয়। তবে লোডশেডিং হয় বলে জানিয়েছেন তিনি।

তিনি বলেন, বিদ্যুতের চাহিদা বিভিন্ন সময় পরিবর্তিত হয় এবং চাহিদার সাথে সরবরাহের কিছুটা পার্থক্য থাকে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, বুধবার বেলা সোয়া ৩টার দিকে রাউজান এলাকায় বিদ্যুতের চাহিদা ১৪ মেগাওয়াট। কিন্তু তারা সরবরাহ পেয়েছেন সাড়ে ৯ মেগাওয়াটের মতো। ফলে কিছু সময়ের জন্য লোডশেডিং করতেই হয় তাদের।

লোডশেডিংয়ে অতিষ্ট হওয়ার কথা জানাচ্ছিলেন বগুড়া শহরের ফুলদিঘী এলাকার বাসিন্দা তানিয়া শিরীন। তিনি বলেন, বগুড়ার সদরেও লোডশেডিংয়ের বিরক্ত গেছে মানুষ।

শিরীন বলেন, তার বাসায় এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে তো পরের ঘণ্টায় থাকে না। এক ঘণ্টা পর পর যাচ্ছে বিদ্যুৎ।

‘বিশেষ করে সন্ধ্যার পর থেকে আরো থাকেই না, বাচ্চাদের লেখাপড়ার এটাই সবচেয়ে বড় প্রবলেম হয়ে যাচ্ছে এখন। আর এত গরমে, এত লোডশেডিং খুবই কষ্টদায়ক।’

এরকম লোডশেডিং রোজার মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়েছে বলেও জানান তিনি।

লোডশেডিং বাড়ছে?
বাংলাদেশে এপ্রিল মাঝের মাঝামাঝি সময় থেকেই লোডশেডিং বাড়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক বলেন, বর্তমান সময় বাংলাদেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদার সময়। একদিকে যেমন গ্রীষ্মকাল চলছে, তেমনি তাপমাত্রাও ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠে যাচ্ছে।

এমন অবস্থায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বৈশ্বিক জ্বালানি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। আর এ কারণেই সারাদেশে লোডশেডিং বাড়ছে বলে জানান তিনি।

পাওয়ার সেলের হিসাব অনুযায়ী, ১০ মে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ১৫ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। আর এর আগের দিন সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৩ হাজার ৭৫২ মেগাওয়াট। সে হিসেবে আজই দেশে বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে প্রায় ১ হাজার ৮৪৮ মেগাওয়াট।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতিটি বিভাগে যে পরিমাণ লোডশেডিং হয়েছে তার মধ্যে গত ৭ ও ৮ মে সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং ছিল। আর সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং হয়েছে ময়মনসিংহ জেলায়।

এই বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ৮ মে তারিখে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, সিলেট, বরিশাল এবং রংপুরে মোট ১৩৫৬ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে।

তার মানে দেশে তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে বিদ্যুতের চাহিদা। আর চাহিদার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লোডশেডিংও।

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ওয়েবসাইটের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এই মুহূর্তে ডিপিডিসি এলাকাতে কোনো লোডশেডিং নেই।

উৎপাদনের অবস্থা কী?
পাওয়ার সেলের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৬ হাজার ৫৫০ মেগাওয়াট। এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট।

বাংলাদেশে বিদ্যুতের গ্রাহক সংখ্যা ৪ কোটি ৪৮ লাখ। এই গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী দিনে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে প্রায় প্রতিদিনই বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। মে মাসের প্রথম আট দিনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছিল গত ৭ মে। এদিন মোট ১৪ হাজার ৩৩১ মোগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছিল।

এছাড়া বাকি দিনগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ১১ হাজার থেকে ১৪ হাজার এর মধ্যে ওঠানামা করেছে। একই চিত্র দেখা গেছে এপ্রিল মাস জুড়েও। এ মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৯ হাজার থেকে শুরু করে ১৪ হাজারের মধ্যে ওঠানামা করেছে।

তবে এ মাসের ১৯ তারিখে দেশে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের তথ্য দিচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন। এর আগের দিনও ১৫ হাজার ৬২৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছিল।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জ্বালানি সঙ্কটের কারণে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় না।

যেভাবে সামাল দেয়া হবে
দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম কেন্দ্র রয়েছে ১৫৪টি। যার মধ্যে বেশিরভাগই ভাড়ায় চালিত ডিজেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালু হলেও সেখানেও কাঁচামাল সরবরাহ নিয়ে জটিলতা রয়েছে।

ডলার আর কয়লা সঙ্কটের কারণে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে একবার রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

গত ২৩ এপ্রিল থেকে কয়লা সঙ্কটের কারণে রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রেরে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি দৈনিক ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, তাদের আশা ছিল পায়রা ও রামপালের মতো বড় বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো এই গ্রীষ্মে বিদ্যুতের সঙ্কট মেটাবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা দেখা যায়নি।

গত মাসে কয়লার সঙ্কটে রামপালে উৎপাদন বন্ধের পর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, মঙ্গলবার নাগাদ কয়লা বোঝাই জাহাজ চট্টগ্রামে পৌঁছাবে।

চলতি মাসের ১৫ তারিখের পর থেকেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের সঙ্কট কাটিয়ে উঠে দেশে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে। ফলে থাকবে না কোনো লোডশেডিং। এমন তথ্য দিয়েছেন পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন।

তিনি বলেন, আগামী তিন দিনের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে ঘাটতি রয়েছে তা কমে অর্ধেকে নেমে আসবে। আর এর দুই দিন পর থেকে কোনো ঘাটতি থাকবে না।

প্রতিদিন একই হারে না হলেও বর্তমানে দেশে সর্বোচ্চ ২ হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে।

তিন দিন পর রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন শুরু হলে এটি ১ হাজার মেগাওয়াটে নেমে আসবে বলে পাওয়ার সেল থেকে জানানো হয়।

তারা বলছে যে, চাহিদা অনুযায়ী যাতে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রাখা যায় তার জন্য পর্যাপ্ত সব ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, জাহাজটি কয়লা নিয়ে চট্টগ্রামে ভিড়েছে এবং এটি বৃহস্পতিবার মোংলা বন্দরে পৌঁছাবে।

এরপর বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি আগামী ১৩ মে বা এর আগেই আবার উৎপাদনে আসতে পারে বলেও জানান তিনি।

এরআগে আমদানি বিল বকেয়ার কারণে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানি বন্ধ হয়ে যায় বলে জানায় বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল)।

এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে প্রায় ১৫ থেকে ১৬ দিনের মতো কয়লা মজুদ ছিল বলেও জানানো হয়। ফলে পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রেও উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। এ বিষয়ে হোসাইন বলেন, মানুষ তো আশঙ্কা করবেই যেহেতু সারা বিশ্বেই অবস্থা নাজুক।

তিনি বলেন, ‘তবে পায়রার উৎপাদন এখনো চলছে এবং আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি এটা যেনো কন্টিনিউ করে, আশা করছি কোনো সমস্যা হবে না।’

এই দুই বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছাড়াও বরিশালে একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হবে বলেও জানানো হয়। এছাড়া আরো যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে সেগুলো এরইমধ্যে শনাক্ত করা হয়েছে।

এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে যাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত থাকে তার জন্য ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলেও জানানো হয়।

‘আমরা এগুলোকে আইডেন্টিফাই করে ক্লোজ মনিটরিংয়ে রাখছি। আশা করি যে সমস্যা হবে না।’

সূত্র : বিবিসি

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com