কর্মহীন জনপদে পরিণত হয়েছে ব্যস্ততম নগরী ঢাকা। সব কলকারখানা বন্ধ, বন্ধ দোকানপাট শপিংমলও। জরুরি জিনিসপত্রের দোকান আর কাঁচাবাজার ছাড়া খোলা নেই কিছুই। অলিগলিতে দু-চারটে রিকশা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে চললেও বেশির ভাগ খেটে খাওয়া নিম্নআয়ের মানুষজন পড়েছে বিপাকে। ফলে নিরুপায় হওয়া এই মানুষগুলো রাতের আঁধারে ঢাকা ছাড়ছে ঝুঁকি নিয়ে।
কখনো সবজির ট্রাকে, সংবাদপত্রের গাড়ি কিংবা মালবাহী ট্রাকে চেপে পাড়ি জমাচ্ছেন গ্রামে। কখনো মাছের পিকআপ ভ্যানে থাকা খালি ড্রামে ঢুকে পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে বাড়িতে যাচ্ছেন। গত কয়েক দিন থেকে এমন তথ্য মিলছে বিভিন্ন জায়গা থেকে। বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের ভয়ও হার মেনেছে তাদের ক্ষুধার কাছে।
ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে খোঁজ খবর নিয়ে এসব তথ্যের সত্যতাও মিলেছে। রাতের আঁধারে ঢাকা ছাড়া এসব মানুষের ভাষ্য, ‘ঢাকায় থাইক্যা কী করুম, আমাগো খাওন দিবো ক্যাডা? আমরা করোনায় মরবো না, মরবো না খাইয়া। এর চাইতে বাড়িত গিয়া মরাই ভালা।’ তবে পরিবহন শ্রমিকরা বলছেন, তারা কাউকেই ট্রাকে তুলতে চান না। তাদের আকুতি মিনতি শুনে তুলতে বাধ্য হন। যদিও এ বিষয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে পরিবহন মালিকদের পক্ষ থেকে।
রাজধানীর কাওরানবাজার এলাকার ডেইলি স্টার ভবনের কাছে থাকা ওভারব্রিজে ওঠার সিঁড়ির সামনে প্রতি রাতেই যুবক, মহিলা ও নারীদের ভিড় বাড়ছে। দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যেকের কাঁধে ও হাতে একটি করে ব্যাগ দেখা যায়। এমনই একজন রায়হান মিয়া। বাড়ি ময়মনসিংহ জেলা সদরে। তিনি ঢাকায় রিকশা চালাতেন। গত বুধবার তিনি ফার্মগেটে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তার সঙ্গে বিভিন্ন আলাপের এক পর্যায়ে তিনি জানালেন, তার স্ত্রী, সন্তান ও মা-বাবা গ্রামে থাকেন। তিনি ঢাকায় তেঁজকুনি পাড়ায় রিকশা চালাতেন। কিন্তু গত ২৫ মার্চ থেকে তার কোনো আয় নেই। কোনো মতে খেয়ে-পরে ছিলেন। কিন্তু আর পারছেন না, বাধ্য হয়ে সবজির গাড়িতে বাড়ি যাওয়ার মনস্ত করেছেন। কারওয়ানবাজারে রাত সাড়ে ৯টার পর গেলেই অনেক লোকই সবজি ও মাছের ট্রাকের জন্য দাঁড়িয়ে থাকেন। ট্রাকের চালক ও হেলপারদের সঙ্গে কথা বলে অল্প ভাড়ায় বাড়ি যাচ্ছেন স্বল্প আয়ের নিম্ন শ্রেণীর এসব লোক।
শুধু কারওয়ানবাজারই নয়, কাপ্তানবাজার, গাবতলী, মিরপুর এলাকাতেও এমন অভিনব কায়দায় ঢাকা ছাড়ছেন অনেকে। তবে গাবতলীতে একটু ভিন্ন কৌশলে গ্রামে রওনা হচ্ছেন অনেকে। রাত যত গভীর হয় গাবতলী টার্মিনালে খেটে খাওয়া মানুষের অপেক্ষার প্রহর ততই দীর্ঘ হয়। গভীর রাতে কোনো এক সময় আন্তঃজেলা টার্মিনাল থেকে দু-একটি বাস ছেড়ে যাচ্ছে বলেও জানা গেছে।
দারুসসালাম থানার ওসি তোফায়েল আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, আমরা এমন খবর পেয়েছি কিন্তু বাস্তবে গিয়ে কাউকে পাইনি। তারপরও আমরা নজর রাখছি। চেকপোস্টে প্রতিটি গাড়ি তল্লাশি করা হচ্ছে। তবে বিষয়টি অস্বীকার করছেন বাস মালিক সমিতির নেতারা। তারা বলছেন, তারা এ বিষয়টি জানেন না, কেউ এমন করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। দুর্যোগকালীন এই সময়ে গাবতলী টার্মিনালে রাত ১০টার পর তেমন কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য চোখে পড়ে না। এই সুযোগকেই কাজে লাগাচ্ছেন এক শ্রেণীর চালক। তারা পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাসের সামনে জরুরি কাজে ব্যবহৃত বা সংবাদপত্রের গাড়ি বলে স্টিকার লাগিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু ভেতরে সব নিম্নশ্রেণীর মানুষকে তুলে গন্তব্যে পৌঁছানো হচ্ছে বলে জানা গেছে। ঢাকাকে লকডাউনের অংশ হিসেবে গাবতলী, উত্তরা, সায়েদাবাদ চট্টগ্রাম মহাসড়কে কড়া নজরদারি চলছে। কিন্তু এর মাঝেও কিছু লোক পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে ঢাকা ছাড়ছে বলে জানা যাচ্ছে।
গাবতলীর কয়েকজন বাসচালক ও হেলপার জানান, শুধু গাবতলী নয়, মহাখালী ও সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে রাতে বাস ছেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর সংখ্যা খুবই কম। আরো জানা গেছে, কিছু লোক নানা অজুহাতে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করেও বাড়িতে রওনা হচ্ছেন। কেউ কেউ আবার জরুরি রোগী পরিবহন লিখে মাইক্রোবাসের সামনে সাঁটিয়ে দিয়ে গ্রামে যাচ্ছেন। এমনই একটি মাইক্রোবাস সম্প্রতি আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত ২৬ মার্চ থেকে করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সব ধরনের গণপরিবহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লার বাস চলাচলও বন্ধ। তবে সেই সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে চলছে বাস।
বাংলাদেশ ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির জেনারেল সেক্রেটারি ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কার্যকরী সভাপতি রুস্তম আলী খান সাংবাদিকদের বলেন, আসলে এগুলো বন্ধ রাখা কঠিন। আমাদের মালামাল পরিবহন ও সবজি পরিবহন ছাড়া কোনো গাড়ি যাত্রী নিয়ে ঢাকা থেকে ছাড়ছে না। যারা (চালক ও হেলপার) ট্রাকে যাত্রী পরিবহন করবে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন, এতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।