আব্দুর রাজ্জাক। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার গোস্বামী দৃর্গাপুর ইউনিয়নের উত্তর মাগুরা গ্রামের বাসিন্দা। তিনি পেশায় একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। গত তিন বছর ধরে তার নামে খাদ্যবান্ধব কর্মসুচীর ওএমএসের বরাদ্দকৃত চাল উঠছে। অথচ তিনিই জানেন না তার নামে কার্ড আছে। হঠাৎ করে বুধবার খবর পেয়ে ডিলারের ঘরে হাজির হন। দেখেন সাড়ে তিন বছরে ধরে তার নামে চাল উঠে আসছে তিনি পান না। পরে তাকে ৩০ কেজি চাল দেয়া হয়। আর বলা হয় এ কথা কাউকে না জানাতে, এখন তিনি নিয়মিত চাল পাবেন বলে জানানো হয়।
শুধু আব্দুর রাজ্জাকই এলাকার অনেকের অভিযোগ তিন বছর ধরে চাল উঠলেও তারা কিছুই জানেন না।
অনুসন্ধানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত তিন বছরে ধরে অনেক গরীব ও অসহায় মানুষের নামে এভাবে ফেয়ার প্রাইসের ১০ কেজি চাল উত্তোলন করা হলেও কেউ কিছুই জানেন না। ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দবির মোল্লার নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট গত তিন বছরে গরিবের চাল বিক্রি করে খাচ্ছে বলে স্থানীয়ভাবে অভিযোগ উঠেছে। আগামী নির্বাচনে চাল চোরেরা মনোনয়ন পাবেন না হুশিয়ারি দেয়ার পর এখন অনেকের বাড়িতেই গোপনে চাল দিয়ে আসছেন।
বিষয়টি এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। গত তিন বছরে এ ইউনিয়নের গরিবের জন্য বরাদ্দকৃত ৬০০টন চালের বড় অংশ ঢুকেছে চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার পেটে। ইউনিয়নে চাল বিতরণের সময় যে সরকারি প্রতিনিধি থাকেন তিনিও বিষয়টি অনেকটা স্বীকার করে নিয়েছেন।
উপজেলা পরিসংখ্যান কর্মকর্তা সুখেন কুমার পাল ট্যাগ অফিসারের দায়িত্বে আছেন। মোবাইলে কথা হলে সুখেন কুমার পাল বলেন,‘ আমি সময়ের অভাবে সব সময় যেতে পারি না। অনেক সময় উপস্থিত থাকলেও একজনের কার্ড নিয়ে অন্যজন চাল নিয়ে যায় এমন ঘটনাও ঘটেছে। চেয়ারম্যান ও ডিলালরা করে সেটা তো আমি জানি না।
প্রতারণার শিকার আব্দুর রাজ্জাক জানান, দবির উদ্দিন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর আমাকে একটি কার্ড করে দেয়। একবার মাত্র চাল পেয়েছিলাম। তাও টাকা দিয়ে কিনে নিতে হয়েছিল। এরপর গত সাড়ে তিন বছরে তালিকায় নাম থাকার পরও কোনো চাল আমার কপালে জোটেনি। গত বুধবার চাল বিতরনের সময় আমি উপস্থিত হয়ে তালিকা দেখতে চাইলে সরকারি কর্মকর্তা সুখেন কুমার বলেন, আপনার নাম তালিকায় আছে। এরপর আমাকে ৩০ কেজি চাল দেয়া হয়। আমি আমার দুই প্রতিবেশির ঘরে খাবার না থাকায় তাদের ১০কেজি চাল দিয়েছি।
রাজ্জাক জানান, আমার মত কয়েক’শ লোকের নামে কার্ড আছে অথচ চাল তারা পান না। অনেকেই এক ও দুইবার চাল পাওয়ার পর তাদের কপালে আর কোনো দিনই চাল জোটেনি। ওই ইউনিয়নের কুঠিপাড়াসহ কয়েকটি গ্রামের রাশিদুল ইসলাম, জোয়াদ আলী, সিদ্দিক আলীসহ কমপক্ষে ৩০জনের মত মানুষের অভিযোগ তারা গত তিন বছরে কোন চাল পাননি। অথচ তাদের নাম তালিকায় আছে।
জেলা খাদ্য অফিস থেকে পাওয়া তালিকা ঘেটে এমন সতত্য মিলেছে।
উত্তর মাগুরা গ্রামের ভ্যান চালক আইয়ুব আলীও চাল পান না। খাদ্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, গোস্বামী দুর্গাপুর ইউনিয়নে প্রতি বছর দুটি ধাপে ৮০০ কার্ডধারীর অধীনে ফেয়ার প্রাইসের চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রতিকেজি চালের কেজি ১০ টাকা। প্রতি বছর দুটি সময়ে দেয়া হয়। প্রথম ধাপে মার্চ ও এপ্রিল এবং দ্বিতীয় ধাপে সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে দেয়া হয়। দুইজন ডিলার এ ইউনিয়নে রয়েছে। একজন মিন্টু হোসেন গোস্বামী দুর্গাপুর বাজারে অন্যজন আলীউল আজিম শংকরদিয়া বাজারে। এর মধ্যে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজ উদ্দিনের ভাই মিন্টু রয়েছে। আর অন্যজন চেয়ারম্যানের আত্মীয়।
অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, দবির উদ্দিন ২০১৬ সালে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর নতুন করে অনেকের কার্ড করা হয়। তালিকায় ৮০০ জনের নাম রয়েছে। এদের বেশির ভাগ কার্ড হওয়ার পর প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তি চাল পাওয়ার পর এরপর তিন বছরে তাদের কপালে আর কোনো চাল জোটেনি। ৬০০টনের বেশি চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এ পর্যন্ত। যার বেশির ভাগই নয়ছয় হয়ে গেছে।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক দবির উদ্দিন, সভাপতি সিরাজ উদ্দিন, ১ন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহরাব উদ্দিন, সাধারন সম্পাদক সেলিনুর রহমানসহ আরও কয়েকজন মিলে ডিলারদের সাথে আঁতাত করে সাধারন মানুষের চাল নয়ছয় করছে। এমনকি প্রথম ও দ্বিতীয় তিস্তি দেয়ার পর যাদের কার্ডে চাল উঠছে এসব চাল বাইরে বিক্রি করে যে অর্থ আয় তা ভাগাভাগি হয়ে যায়।
ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহরাব উদ্দিন জানান, ‘অনেক কার্ড ডিলারের কাছে থাকে হিসাবের জন্য। চাল নেয়ার সময় যার কার্ড তারা নিয়ে যান। চাল না পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে কোন কথা আমি বলতে পারব না।’ ডিলার মিন্টু হোসেন জানান, ‘কেউ চাল পাচ্ছে না এমন কোনো বিষয় আমার জানা নেই। কয়েকজনের নাম বললে তিনি তার কোনো জবাব দিতে পারেননি।’
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দবির উদ্দিন বলেন, ‘ভাই কিছু অনিয়ম থাকতে পারে। তালিকা ঘাটলে আমিও পাব, আপনিও পাবেন। আপনি এবারের মত সুযোগ দেন যাতে আগামীতে আর ভুল ক্রটি যাতে না হয়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জুবায়ের হোসেন চৌধুরী বলেন,‘চাল নিয়ে অনিয়ম করার কোনো সুযোগ নেই। তালিকায় যাদের নাম আছে তারা কেন চাল পাচ্ছে না তা খতিয়ে দেখে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’