ঠিক দু’বছর আগে এই এপ্রিল মাসেই বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ। ওই সময় সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে দুই পার্বত্য জেলা রাঙামাটি ও বান্দরবানের মোট নয়টি উপজেলার সমন্বয়ে ‘স্বশাসিত বা স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতা-সহ’ পৃথক রাজ্যের দাবি তোলে তারা।
উপজেলাগুলো হলো- রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি এবং বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম। মানচিত্রে দেখা যাচ্ছে, সবগুলো উপজেলাই সীমান্তবর্তী।
স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠার দাবির ক্ষেত্রে তারা সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলোকে কী কী কারণে অগ্রাধিকার দিচ্ছে?
পাহাড়ে গোষ্ঠীগত দিকে থেকে তাদের উপস্থিতি ও প্রভাবই বা কেমন?
একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও গবেষক বলছেন, সীমান্তের ওপারে আশ্রয় পাওয়ার সুযোগ, ভূরাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক কারণেই সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলোকে কেএনএফ অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
কেএনএফের ঘোষণা ও বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমের উদ্দেশে দেয়া বক্তব্য অনুযায়ী, অন্তত ছয়টি নৃ-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে তারা।
যদিও স্থানীয়ভাবে জানা যায়, মূলত বম সম্প্রদায়ের কিছু মানুষই এতে যুক্ত। সংগঠনের নেতৃত্বেও রয়েছে এই সম্প্রদায়ের সদস্যরাই।
নয়টি উপজেলার মধ্যে তিনটি উপজেলায় গোষ্ঠীটির কয়েক হাজার মানুষ বসবাস করলেও বাকিগুলোতে তাদের জনসংখ্যা তুলনামূলক কম।
সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলো কেন?
১৮৯২ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলা, আসাম আর বার্মার সীমান্তঘেঁষা চিন-লুসাই হিলসের প্রশাসনিক রূপরেখা নির্ধারণে কলকাতায় একটি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
ওই অঞ্চলে কুকি (বম)-চিন-লুসাই (বা কুকি-চিন-মিজো) নৃগোষ্ঠীর লোকদের বসবাস।
কলকাতার সেই ‘চিন-লুশাই কনফারেন্সে’র পরই স্থির হয়েছিল, এই জাতিগোষ্ঠীর বাস যে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে তা তিনটি ভাগে ভাগ করে দেয়া হবে- চিন হিলস বার্মার, লুসাই হিলসের দক্ষিণভাগ বাংলার আর উত্তরভাগ আসামের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
এই সীমান্তের বিভেদ তৈরির অনেক আগে থেকেই কুকি, চিন ও লুসাইরা নিজেদের একই এথনিসিটি, একই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের লোক বলে মনে করতেন।
মিজোরাম ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জে ডাউঙ্গেলের কিংবা দিল্লির জেএনইউ-তে স্কুল অব সোশ্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক ও সমাজতাত্ত্বিক জয় পাচুয়াউও’র মতো বিশেষজ্ঞরা ওই জাতিগোষ্ঠীগুলোকে একত্রে ‘জো’ বলে অভিহিত করে থাকেন।
এদের মধ্যে আর একটা মিল হলো- ধর্মীয় বিশ্বাসে তারা বেশির ভাগই খ্রিষ্টান। তেমনি তাদের মধ্যে ফারাকও কম নয় বলে জানান মিজ পাচুয়াউ।
‘জো-দের মধ্যে আলাদা আলাদা যে নৃগোষ্ঠীগুলো, তাদের মধ্যে রীতিমতো সূক্ষ্ম প্রতিদ্বন্দ্বিতাও আছে’, বলছিলেন তিনি।
গত জুলাইয়ে বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ডাউঙ্গেল বলেছিলেন, ‘এক এক জায়গায় জো-দের আন্দোলনের দাবিটা এক এক রকম।’
এই নৃতাত্ত্বিক সংযোগের জন্য ভারতের মণিপুর, মিজোরাম ও বার্মার চিন রাজ্যের মানুষের সাথে বাংলাদেশের বমদের এক ধরনের আত্মিক সম্পর্ক ও আদান-প্রদান রয়েছে বলে জানাচ্ছেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও গবেষক বায়েজিদ সারোয়ার।
‘সীমান্তের ওপারে একই সম্প্রদায়ের (কুকি) অবস্থান, ভূরাজনৈতিক ও উচু পাহাড়কে আশ্রয় বা লড়াইয়ের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার মো সুবিধার কারণে সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলোকে কেএনএফ অগ্রাধিকার দিচ্ছে’, জানান তিনি।
কেএনএফ কাদের প্রতিনিধিত্ব করছে
জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ অনুযায়ী বাংলাদেশে বমদের সংখ্যা ১৩ হাজার ১৯৩।
পাহাড়ের নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা সাধারণত গ্রাম বা পাড়ার মতো সামাজিক কাঠামোবদ্ধ হয়ে বসবাস করে।
বম সোশ্যাল নেটওয়ার্কের ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, দুই পার্বত্য জেলায় তাদের ৭০টি গ্রাম বা পাড়া রয়েছে।
এর অর্ধেকই রুমা উপজেলায়। এছাড়া রোয়াংছড়িতে ১৮টি, থানচিতে ৮টি, বান্দরবান সদরে রয়েছে ৯টি পাড়া।
স্থানীয় সাংবাদিক বাটিং মারমা বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘যদিও ওরা ছয়টি জাতির কথা বলে, আসলে ওই বম সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ নিয়েই ওরা আছে।’
‘এই সম্প্রদায়ের সবাই যে কুকি চিন ফ্রন্টের সমর্থক, তাও না। একটা অংশ হয়তো সমর্থন করতে পারে’, যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হয়ে প্রায় সাত বছর পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো: বায়েজিদ সারোয়ার।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, ‘কেএনএফ-এর নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, যেমন হত্যা, চাঁদাবাজি, জোরপূর্বক খাদ্য সংগ্রহ, ডাকাতি, নির্যাতন ও এলাকা অশান্ত হওয়ায় বম জনগোষ্ঠি ও বান্দরবানের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির মধ্যে কিছুটা বিরক্তি তৈরী করেছে।’
তবে পার্শ্ববর্তী কিছু অঞ্চলের উত্তেজনা ও চাঞ্চল্য এই অঞ্চলের কুকি সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করতে পারে, এই বিষয়টিও মনে রাখা দরকার বলে উল্লেখ করেন এই সাবেক সেনা কর্মকর্তা।
বম ছাড়াও আরো পাঁচটি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বের দাবি করে কেএনএফ। তারা হলো- পাংখোয়া, লুসাই, খিয়ং, ম্রো ও খুমি।
জনশুমারি ২০২২ -এর তথ্য বলছে, বাংলাদেশে পাংখোয়া নৃগোষ্ঠীর মানুষ আছেন এক হাজার ৮৫৭ জন। ৩৮০ জন লুসাই, খিয়াং সম্প্রদায়ের চার হাজার ৮২৬ ও তিন হাজার ৭৮০ জন খুমি আছেন।
ম্রো গোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা অন্যদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি, ৫২ হাজার ৪৫৫ জন।
‘অন্যদিকে চাকমা-মারমা-ত্রিপুরা জনগোষ্ঠির সাথে কুকি সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক বিরোধের কথা আলোচনায় আছে। চাকমা-মারমা-ত্রিপুরাদের জনসংখ্যা প্রায় ছয় থেকে সাত লাখ’, বলছিলেন সারোয়ার।
বান্দরবান থেকে বাটিং মারমা জানাচ্ছেন, ‘ওরা (কেএনএফ) আসলে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে রুমা উপজেলা সংলগ্ন বর্ডার সাইডে, থানচির দুর্গমে ও রোয়াংছড়ির কিছু এলাকায়। অন্য কোথাও তাদের তেমন কার্যকলাপ নেই।’
পাহাড়ে চ্যালেঞ্জ
কেএনএফ-কে মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনীকে বেশ কিছু বিষয়ে নজর দিতে হবে বলে মনে করেন সাবেক সেনা কর্মকর্তারা।
পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) এমদাদুল ইসলামের।
ইসলাম বিবিসি বাংলাকে জানান, কেএনএফের শক্তি ও সমর্থন খুব একটা আছে, তেমনটা তিনি মনে করেন না।
‘তবে আমার মনে হয় তাদের যথাযথ গুরুত্ব না দেয়ায় তারা একটু বড় হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। পরে উগ্রবাদী ইস্যুটি সামনে আসার পর কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে এসেছে। আবার কেএনএফ আলোচনায় আসায় হয়তো আত্মতুষ্টি তৈরি হয়েছে। সেই সুযোগেই এবারের ঘটনা ঘটেছে’, বলছিলেন তিনি।
বাংলাদেশের শীর্ষ পাহাড়চূড়াগুলোর অবস্থান বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো: বায়েজিদ সারোয়ার বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘সেখানকার পূর্বাঞ্চলের দুর্গম উঁচু পাহাড়ে অভিযান পরিচালনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।’
সীমান্তের ওপার থেকে সশস্ত্র গোষ্ঠীটি সমর্থন পাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে গোয়েন্দা কার্যক্রম কঠিন হয়ে পড়ে।’
এর আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানকালে কেএনএফ পাহাড়ে প্রথমবারের মতো আইইডি বা ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (এক ধরনের বোমা) ব্যবহার করেছিল।
এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে অভিযানে অংশগ্রহণকারী বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন সারোয়ার।
‘মনে রাখতে হবে এই অভিযানের লক্ষ্যবস্তু শুধু কেএনএফ-এর সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। পাহাড়ের সাধারণ জনগণ যেন মোটেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়’, সতর্ক করে দেন তিনি।
সূত্র : বিবিসি