শান্তি ও সমতার ধর্ম ইসলাম। ইসলাম দিতে পারে মানব জাতির মুক্তির যৌক্তিক ও সঠিক নির্দেশনা। এ জন্যই বলা হয় Islam is the complete code of life. মানুষের বাক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সার্বিক পরিস্থিতিতেই ইসলাম বাতলে দেয় কার্যকরী সমাধান। ইসলামে পর্দার বিধান তেমনি একটি সমাধান যেটি মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনকে রাখে নিরাপদ।
ইসলামে পর্দার বিধান নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই আবশ্যক তথা ফরজ। তবে, পর্দার মাধ্যম হিসেবে হিজাবের ব্যাপারটি কেবল নারীদের সাথেই সম্পৃক্ত। বলা বাহুল্য, নারীদের মান-মর্যাদা, নিরাপত্তা-সুরক্ষা, অধিকার ও সতিত্ব রক্ষার ব্যাপারে ইসলাম বন্ধপরিকর।
হিজাব শব্দটি আরবি। এর অর্থ পর্দা। হিজাব হলো নারীর নিরাপত্তা লাভের প্রধান ঢাল। হিজাব পরা বলতে কেবল বাহ্যিকভাবে নারীদেহে এক টুকরো কাপড় পরিধান করাকেই বুঝায় না, সামগ্রিক বিবেচনায় এটি দ্বারা নারীর নিরাপত্তা লাভ করাকে বুঝায়। অর্থাৎ, নারীদের নিরাপত্তা লাভের জন্য হিজাব একটি কার্যকরী ব্যবস্থা।
সম্মানিতা ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নারীর জন্য হিজাব কতটা দরকারি, ইসলামে কেন হিজাব একটি আবশ্যিক বিধান এবং ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে এর প্রয়োজনীয়তাই বা কতটুকু- সেটিই মূলত এই লেখার মুখ্য আলোচনার বিষয়।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- ‘হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রী, কন্যা ও মুমিনদের নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের খানিকটা অংশ (জিলবাব) নিজেদের ওপর টেনে দেয়। এতে তাদের চেনা সহজ হবে। ফলে তারা উত্তক্তের শিকার হবেন না। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।’ (সূরা আহজাব-৫৯)
আয়াতে উল্লিখিত ‘চাদরের খানিকটা অংশ’ বা ‘জিলবাব’ বলতে এমন পোশাককে বোঝায় যা পুরো শরীরকে আচ্ছাদিত করে। পরের অংশে ‘চেনা সহজতর হবে’ কথাটির অর্থ হচ্ছে, তাদেরকে এ ধরনের অনাড়ম্বর লজ্জা নিবারণকারী পোশাক বা হিজাবে সজ্জিত দেখে প্রত্যেকে এটি জানতে পারবে যে, তারা অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। কোনো ভবঘুরে অসতী ও পেশাদার মেয়ে নয় এবং যার কাছে কোনো অসৎ মানুষ কোনো কুপ্রস্তাব দেয়ার সাহস পাবে না।
বাস্তবে বেপর্দা নারীরা ফাসেক মানুষের চোখের তৃপ্তির খোরাক মেটায় ও জৈবিক বাসনা পূরণের লোভ জাগায়। থাকতে পারে সে লোভ মনের অভ্যন্তরে তথা গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে। আর এ থেকেই সৃষ্টি হয় বিপদের সমূহ আশঙ্কা।
সত্য বলতে, পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই চায় নিরাপদ ও সুরক্ষিত উপায়ে বেঁচে থাকতে।
এ দিক বিবেচনায়, পর্দা হলো তেমনি একটি বিষয় যেটি নারীকে পুরুষদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে উদ্বুদ্ধ করে। আর হিজাব নারীদেহের ‘নিরাপত্তা সরঞ্জাম’ বা ‘ঢাল’ হিসেবে নিরাপত্তা প্রদান করে।
হিজাব নারীর সামজিক মর্যাদা বা ‘সোশ্যাল স্ট্যাটাসের’ মাত্রা নেক্সট লেভেলে নিয়ে যায়। কিভাবে সেটি হয়-তা বলার আগে প্রথমেই বলে নিই, পৃথিবীতে কিছু পেশা আছে যেগুলোর মূলধন কেবল বাহ্যিক সৌন্দর্য ও শরীর। সেসব পেশার মূল উপলক্ষই থাকে শরীর প্রদর্শন করা। তবে, এসব পেশার অধিকাংশ ব্যক্তিই সমাজে ঘৃণার পাত্র। আমাদের এসব পেশার সাথে ন্যূনতম যোগসাজশ না থাকলে নিশ্চয়ই আমরা তেমনভাবে শরীর প্রদর্শন করে চলার ইচ্ছা পোষণ করব না। অর্থাৎ একজন আত্মমর্যাদা সম্পন্ন, ভদ্র ও সভ্য-শিক্ষিত মানুষ হিসেবে আমরা নিজেদের শরীর ও লজ্জা ঢেকে চলার চেষ্টা করব সর্বোচ্চ। আর নারীদের লজ্জা ও শরীর ঢাকার জন্য হিজাব আদর্শ পোশাক হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত।
পর্দাহীন বা খোলামেলাভাবে চলাফেরা করা যদি নিম্নশ্রেণীর পর্যায়ভুক্ত বলে পরিগণিত হয়, পক্ষান্তরে হিজাবসমেত পর্দাশীল অবস্থায় চলাফেরা কি তাহলে ‘উন্নত শ্রেণীর’ বলে পরিগণিত হয় না? এই সূত্রে বলা যায়, হিজাব নারীর সামজিক মর্যাদা বা ‘সোশ্যাল স্ট্যাটাসের’ মাত্রা কার্যতই নেক্সট লেভেলে নিয়ে যায়।
ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দেখা যায়, হিজাব নারী নিরাপত্তায় বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া, সামাজিক অবক্ষয় রোধেও হিজাব বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, নারী যখন পুরুষের সামনে নিজেকে খোলামেলাভাবে উপস্থাপন করে তখন স্বভাবতই পুরুষের মনে এক ধরনের আকর্ষণ ভাব কাজ করে। শুরুতে এটিকে অগ্রাহ্য করার মতো মনে হলেও এখান থেকেই রোপিত হয় বৃহৎ অপকর্মের অশুভ বীজ। যার শেষ পরিণতি হতে পারে কল্পনাতীত। সমাজে এর প্রভাব অত্যন্ত ভয়াবহ। তাই, মহান আল্লাহ নারীকে খোলামেলা অবস্থায় যত্রতত্র নির্বিচারে ঘোরার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেছেন।
যেমন- সূরা নূরের ৩১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা নারীকে ১৪ শ্রেণীর মানুষ ব্যতীত অন্য কারোর সামনে নিজের সাজসজ্জা প্রকাশ করতে নিষেধ করেছেন। এই শ্রেণীভুক্ত মানুষ তারাই যারা ওই নারীর রক্তের সম্পর্কে সম্পর্কিত এবং যাদেরকে বিয়ে করা যায় না। এর বাইরে গোটা সমাজের সামনে নারীকে সর্বোচ্চ পর্দা মেনে চলতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এই নির্দেশনার ব্যত্যয় আজকালের সমাজে অপ্রতুল নয়। তাতে সমাজে সহজলভ্য হয়ে গেছে
নারী হেনস্তা, লাঞ্ছনা, ধর্ষণ ইত্যাদির মতো অপরাধ।
মনে রাখতে হবে, পর্দা করা মানে গৃহে অবরুদ্ধ হওয়া নয়। মূলত, ইসলামে নারীকে কোনোভাবেই কোনো দিক দিয়ে খাটো করে দেখা হয়নি, করা হয়নি স্বাধীনতা হরণ; বরং ইসলামই জাহেলি যুগের দুর্দশা থেকে নারীকে করেছে মুক্ত, ফিরিয়ে দিয়েছে মর্যাদা, স্বাধীনতা ও অভূতপূর্ব সম্মান।
আগেই বলেছি, পর্দা কেবল নারীর জন্য প্রযোজ্য নয়, সমানভাবে প্রযোজ্য পুরুষের জন্যও। লেখার বিষয় হিসেবে এই লেখায় কেবল নারীর প্রতি হিজাবের গুরুত্বই তুলে ধরা হয়েছে।
লেখক:
শিক্ষার্থী, আরবী সাহিত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়