শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৩৬ অপরাহ্ন

ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্সে’র সংসারে বাংলাদেশের ভূমিকা কী?

বিডি ডেইলি অনলাইন ডেস্ক :
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
  • ২৭ বার

দেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের ঠিক দু’দিন আগে ভারতীয় চ্যানেল এনডিটিভি-কে একটি সাক্ষাৎকার দেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনি যদি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তোলেন, তাহলে সেই অস্থিরতার আঁচ কিন্তু বাংলাদেশের বাইরেও মিয়ানমার, সেভেন সিস্টার্স, পশ্চিমবঙ্গ- সর্বত্রই অগ্ন্যুৎপাতের মতো ছড়িয়ে পড়বে।’

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগের কয়েক দিনে বিভিন্ন ভারতীয় সংবাদপত্র বা চ্যানেলকেও দেয়া একাধিক সাক্ষাৎকারেও তিনি মোটামুটি একই ধরনের সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন, আর প্রতিবারই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে বুঝাতে ব্যবহার করেছিলেন এই ‘সেভেন সিস্টার্স’ শব্দবন্ধটি।

লক্ষণীয় বিষয় হলো- ভারতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোকে বুঝাতে এখন কিন্তু ‘নর্থ-ইস্ট’ বা ‘নর্থ-ইস্টার্ন স্টেটস’ কথাটাই বেশি ব্যবহৃত হয়। সেভেন সিস্টার্স কথাটা এককালে জনপ্রিয় হলেও এখন ভারতীয়রা সেটি প্রায় ভুলতেই বসেছেন।

অথচ ভারতে ‘সেভেন সিস্টার্স’ কথাটা ইদানীং প্রায় অপ্রচলিত হলেও বাংলাদেশে ওই অঞ্চলটিকে বুঝাতে এখনো কিন্তু ওই শব্দবন্ধটিই সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত।

এমন কী দিনকয়েক আগে বাংলাদেশে আকস্মিক বন্যার পর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে শত শত ছাত্রকে স্লোগান দিতে শোনা গিয়েছিল, ‘বন্যায় যদি মানুষ মরে, সেভেন সিস্টার্স থাকবে না রে!’ সেই দৃশ্যের ভিডিও প্রবল বেগে ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল ভারতেও।

তথাকথিত ‘সেভেন সিস্টার্সে’র ভারতের সাথে যুক্ত থাকা না-থাকার প্রশ্নে বাংলাদেশের যে একটা প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে, সম্ভবত সেই ইঙ্গিতই প্রচ্ছন্ন ছিল শিক্ষার্থীদের ওই স্লোগানে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরাও বারবার এই বিষয়টির ওপর জোর দিয়েছেন।

আসলে বাংলাদেশের সাথে ভারতের যে চার হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ স্থল-সীমান্ত, তার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই কিন্তু এই সেভেন সিস্টার্সের সাথে! আরো নির্দিষ্ট করে বললে, সাতটির মধ্যে চার বোন- আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামের সাথে।

ইতিহাস বলে, সেভেন সিস্টার্স-ভুক্ত এই রাজ্যগুলোর বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী অতীতে বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকেই অবাধে তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। আবার যখন ওই নেতাদের বাংলাদেশ সরকার ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে, তাদের সক্রিয়তাতেও দেখা গেছে ভাঁটার টান!

সেভেন সিস্টার্সের সবচেয়ে বড় রাজ্য আসামের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা একাধিকবার প্রকাশ্যেই বলেছেন, বাংলাদেশ বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী আলফা-র নেতাদের ভারতের কাছে হস্তান্তর করেছে বলেই আসাম আজ এত ‘শান্তিপূর্ণ’, রাজ্যের লোক ‘রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারেন’!

ফলে ভারতের এই অঞ্চলটির ওপর প্রতিবেশী বাংলাদেশের যে একটা ‘স্ট্র্যাটেজিক লিভারেজ’ বা কৌশলগত সুবিধা আদায়ের পরিসর আছে, সে বিষয়ে পর্যবেক্ষকরা প্রায় সবাই একমত।

কিন্তু ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রে ‘সেভেন সিস্টার্সে’র উৎপত্তি ও নামকরণ হয়েছিল কিভাবে?

‘সাত বোনে’র এই পরিবারে কেন বারেবারে ভারত-বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলন ও বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথাচাড়া দিয়েছে? সার্বিক জাতীয় নিরাপত্তার দৃষ্টিতেই বা ভারতের জন্য কেন এই অঞ্চলটি এত সংবেদনশীল?

যে নাম পছন্দ হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধিরও
১৯৭১ সালে ভারতের পার্লামেন্টে পাস হওয়া ‘নর্থ ইস্টার্ন কাউন্সিল অ্যাক্টে’র অধীনে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি অঙ্গরাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়নের জন্য একটি পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়, যার সদর দফতর স্থাপিত হয়েছিল শিলংয়ে।

এই রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলো ছিল- আসাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মেঘালয়, অরুণাচল প্রদেশ, ত্রিপুরা ও মিজোরাম।

এর মধ্যে ত্রিপুরা, মণিপুর ও মেঘালয় ১৯৭২-র ২১ জানুয়ারি ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। আসাম ও নাগাল্যান্ড আগে থেকেই ছিল ভারতের পূর্ণ অঙ্গরাজ্য, আর ওই তারিখে অরুণাচল প্রদেশ (তখন নাম ছিল ‘নেফা’) ও মিজোরাম ছিল কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মর্যাদায়।

ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলাতে সে সময় টাইমস অব ইন্ডিয়ার সংবাদদাতা ছিলেন জ্যোতি প্রসাদ শইকিয়া, যিনি জে পি শইকিয়া নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন।

নতুন রাজ্য হিসেবে ত্রিপুরার আত্মপ্রকাশের দিনে তিনি যে- রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন, তাতেই তিনি না কি প্রথমবারের মতো গোটা অঞ্চলটিকে ‘ল্যান্ড অব সেভেন সিস্টার্স’ বলে অভিহিত করেন। পরে ওই একই নামে তিনি একটি বইও লিখেছিলেন।

জনশ্রুতি হলো- এই ‘সেভেন সিস্টার্স’ কথাটি না কি তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধিরও খুব পছন্দ হয়ে গিয়েছিল।

ভারতের মানচিত্রের এক কোনায় সাতটি রাজ্য বা অঞ্চলকে এক কথায় বর্ণনা করতে তখন সরকারি কাগজপত্রেও ধরে ধীরে এই শব্দটির প্রয়োগ শুরু হয়।

ভারতের পর্যটন বিভাগ ওই অঞ্চলের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান নিয়ে সেই আমলে যে ছোট ছোট পুস্তিকা বের করত, সেখানেও তখন সেভেন সিস্টার্স কথাটি খুব ব্যবহৃত হতো।

উত্তর-পূর্ব ভারতের বিশেষজ্ঞ ও সুপরিচিত লেখক-গবেষক সঞ্জয় হাজারিকা বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ‘সাংবাদিক জে পি শইকিয়া এক সময় চাকরি ছেড়ে আসামের তখনকার মুখ্যমন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা শরৎ চন্দ্র সিনহা-র উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন।’

‘১৯৭৬ সালে গুয়াহাটিতে এআইসিসি-র যে অধিবেশন হয়েছিল, সেখানে সিনহা প্রকাশ্যে এই সেভেন সিস্টার্স কথাটি ব্যবহার করেন। আমরা ধরে নিতেই পারি এর পেছনে নিশ্চয়ই জে পি শইকিয়ার ভূমিকা ছিল।’

২০২০ সালের ডিসেম্বরে গুয়াহাটিতে জে পি শইকিয়ার মৃত্যুর পর আসামের ‘দ্য সেন্টিনেল’ পত্রিকা যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল, তাতেও ‘সেভেন সিস্টার্স’ কথাটির স্রষ্টা হিসেবে তাকেই স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

এদিকে ২০০১ সালে তদানীন্তন অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারের আমলে উত্তর-পূর্ব ভারতের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ‘ডোনার’ নামে আলাদা একটি মন্ত্রণালয় গঠন করে, তাতে আগেকার সাতটি রাজ্যের সাথে যুক্ত করা হয় সিকিমকেও।

তখন থেকে অনেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে ‘সাত বোন এক ভাই’য়ের দুনিয়া বলেও বর্ণনা করতে থাকেন।

আটটি রাজ্যের সমাহারে গঠিত এই অঞ্চলটিকে বিজেপি সরকার আবার ‘অষ্টলক্ষ্মী’ বলেও ডাকতে শুরু করে, আর তখন থেকেই ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে পুরনো সেই ‘সেভেন সিস্টার্স’ নামটির ব্যবহার।

শিলিগুড়ি করিডর তথা ‘চিকেনস নেক’
ভারতে সাড়ে চার বছর আগে বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে যখন প্রতিবাদ তুঙ্গে, তখন শার্জিল ইমাম নামে এক তরুণ অ্যাক্টিভিস্ট এক জনসভায় বলেছিলেন, ভারতের ‘চিকেনস নেক’ অবরোধ করে আসামকে পাকাপাকিভাবে দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলেই সরকার তাদের দাবি মানতে বাধ্য হবে!

মুম্বাই আইআইটি ও দিল্লির জেএনইউ-এর সাবেক ছাত্র, মেধাবী শার্জিল ইমামের সেই ভাষণের ভিডিও ভাইরাল হয়, যার জেরে দেশদ্রোহের অভিযোগে তাকে পরে জেলেও যেতে হয়, আর সেই কারাবাস থেকে তিনি আজও মুক্তি পাননি।

আসলে শার্জিলের প্রধান ‘অপরাধ’ ছিল- প্রকাশ্য ভাষণে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার খুব দুর্বল একটা জায়গায় তিনি আঘাত দিয়ে ফেলেছিলেন! বলেছিলেন ‘চিকেনস নেক’ বা মুরগির ঘাড় মটকে দেয়ার কথা!

একদা সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে বাকি দেশের মূল ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত করে রেখেছে যে সরু অংশটা, সেটাই আসলে ‘শিলিগুড়ি করিডর’ নামে পরিচিত।

ভারতের মানচিত্রে শিলিগুড়ি শহরের কাছে অবস্থিত এই করিডরটা অনেকটা বাঁকানো মুরগির ঘাড়ের মতো দেখায় বলে এই জায়গাটাকে অনেকে ‘চিকেনস নেক’ বলেও বর্ণনা করেন।

এই করিডরের সবচেয়ে সরু অংশটা মাত্র ২১ কিলোমিটার চওড়া, যার আশপাশেই রয়েছে অন্তত চারটি দেশের আন্তর্জাতিক সীমান্ত। এই দেশগুলো হলো চীন, নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশ।

বাকি ভারতের সাথে সেভেন সিস্টার্সের ভৌগোলিক সংযোগের এই সূত্রটায় যেহেতু ‘স্ট্র্যাটেজিক ডেপথে’র অভাব রয়েছে, সেটাই কিন্তু নিরাপত্তার দৃষ্টিতে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে একটা ‘ভালনারেবল’ বা বিপজ্জনক অবস্থায় রেখেছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক তথা ভারতীয় সেনার সাবেক মেজর জেনারেল ভি এস রানাডে মনে করেন, এই শিলিগুড়ি করিডরের ‘স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব’ হয়তো ভারত উপলব্ধি করেছে- কিন্তু অন্য দিকগুলো দিয়ে সেভেন সিস্টার্সকে আজও বাকি দেশের সাথে আত্মীকৃত করা যায়নি।

দিল্লির থিঙ্কট্যাঙ্ক আইডিএসএ-র জার্নালে ‘স্লেন্ডার ইজ দ্য করিডর’ নামে এক প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, ‘যে ইস্যুগুলো একটা দেশের বিভিন্ন অংশকে সংযুক্ত করে, সেটা এখানে কোথায়? এই করিডর দিয়ে আমরা কি (সেভেন সিস্টার্সকে) রাজনৈতিকভাবে বা জাতীয় আবেগের দিক থেকে জুড়তে পেরেছি?’

শিলিগুড়ি করিডরের কাছেই অবস্থিত দার্জিলিং-এর আদি বাসিন্দা ও ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা আবার এই সরু করিডরকে ভারতের জন্য একটি ‘সুযোগ’ হিসেবে দেখতে চান।

শ্রিংলা বলছেন, ‘ভারতের নেইবারহুড ফার্স্ট পলিসি (‘প্রতিবেশীরা সবার আগে’) আর ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি এখানে এসেই মিশেছে। আমি তো বলব শিলিগুড়ি করিডর হলো আসিয়ান, বিমস্টেক আর সার্কের সংযোগস্থল!’

তবে যে দৃষ্টিতেই দেখা হোক, এই করিডর বা ‘চিকেনস নেক’ই যে সেভেন সিস্টার্সকে বাকি ভারতের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা অবস্থানে রেখেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর সক্রিয়তা
ভারতের সেভেন সিস্টার্সের নৈসর্গিক শোভা, প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে- কিন্তু পাশাপাশি বছরের পর বছর ধরে এই অঞ্চলটি যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনে বিক্ষুব্ধ থেকেছে, সেটাও কিন্তু বাস্তবতা।

বস্তুত সাতচল্লিশে ভারতের স্বাধীনতার পর (কাশ্মিরকে বাদ দিলে) দেশের যেখানে সবার আগে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন মাথাচাড়া দেয়, সেটি ছিল নাগাল্যান্ড। এ জেড ফিজো-র নেতৃত্বে নাগা ন্যাশনাল কাউন্সিল (এনএনসি) তাদের স্বাধীনতার লড়াই শুরু করে ১৯৫০-র দিকেই।

পরে এনএনসি ভেঙে এনএসসিএন তৈরি হয়েছে, সেই সংগঠনও মুইভা আর খাপলাং-এর অনুগত গোষ্ঠীতে ভেঙে দু’টুকরো হয়েছে- কিন্তু সার্বভৌম ‘নাগালিম’ বা গ্রেটার নাগাল্যান্ডের দাবিতে নাগাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন কিন্তু আজও পুরোপুরি থামেনি।

একইভাবে বিগত পঞ্চাশ বছরের বিভিন্ন সময়ে মণিপুরে কুকি-রা, আসামে ‘আলফা’, ডিমা-হাসাও বা একাধিক বড়ো গোষ্ঠী, মিজোরামে এমএনএফ এবং ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে বিভিন্ন উপজাতীয় গোষ্ঠী ভারত ও ভারতীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নানা দাবিতে অস্ত্র ধরেছে।

পাশাপাশি, এই রাজ্যগুলোর নিজেদের মধ্যেও সীমানা ও আরো নানা প্রশ্নে বারেবারেই বিরোধ দেখা দিয়েছে। আসাম-মেঘালয়, আসাম-ত্রিপুরা, অরুণাচল-আসাম কিংবা ত্রিপুরা-মিজোরামের মধ্যে দ্বন্দ্ব, অবরোধ কিংবা পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনাও বিরল নয় মোটেই।

সোজা কথায়, ‘সাত বোনে’র সংসারেও যে সব সময় শান্তি ছিল অথবা বোনে বোনে খুব মিল ও সদ্ভাব- সেটাও কিন্তু সত্যি নয় একেবারেই।

উত্তর-পূর্বের শিলচর শহরের বাসিন্দা ও লেখক-অধ্যাপক জয়দীপ বিশ্বাস এর একটা সহজ ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ‘আসলে বাকি ভারত এই সেভেন সিস্টার্সকে বোধহয় একটা ‘হোমোজিনিয়াস ইউনিট’ বা একই রকমের কাঠামোর অংশ হিসেবে দেখে। কিন্তু এই এলাকাটার মধ্যে কতো যে বৈচিত্র্য বা বৈপরীত্য, তার খেয়াল কতজন রাখেন?’

‘ধর্মই বলি বা ভাষা-সংস্কৃতি-খাদ্যাভ্যাস, এখানে একটা রাজ্যের সাথে আর একটার কিন্তু মিলের চেয়ে অমিলই অনেক বেশি। ত্রিপুরার সাথে নাগাল্যান্ডের যেমন কিছুই মেলে না, আবার আসামের সাথে মিজোরামের ফারাকটাই বেশি চোখে পড়ে।’

জাতিগত বা ধর্মীয় নানা ‘ফল্টলাইন’ই আসলে সেভেন সিস্টার্সে এই অস্থিরতার জন্ম দিয়েছে- এবং সেখানে অযথা ‘ইউফোরিয়া’ বা আনন্দোচ্ছ্বাসের কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই বলেই জয়দীপ বিশ্বাসের অভিমত।

অথচ ভারতের মূল ধারার মিডিয়াতে সেভেন সিস্টার্সকে নিয়ে চিরকাল সেরকমই একটা রঙিন ছবি আঁকার চেষ্টা হয়ে থাকে।

সেভেন সিস্টার্সের মধ্যেই যেমন মিজোরাম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ডের মতো রাজ্যে খ্রিষ্টানরা সংখ্যাগুরু। অরুণাচল প্রদেশ আবার বৌদ্ধ অধ্যুষিত।

আসামে হিন্দু অসমিয়া ও বাংলাভাষী মুসলিমদের মধ্যে দ্বন্দ্বের ইতিহাসও বহু পুরনো। মণিপুরে হিন্দু মেইতেই ও খ্রিষ্টান কুকিদের মধ্যে যে রক্তাক্ত সংঘর্ষ গত বছর শুরু হয়েছে তা এখনো থামার কোনো লক্ষণ নেই।

ত্রিপুরাতে ব্রিটিশ আমলের পূর্ববঙ্গ থেকেই বাঙালি হিন্দুদের আসার ঢল নেমেছিল, স্থানীয় উপজাতীয়দের সাথে তাদের বিরোধের আগুন আজও জ্বলছে ধিকিধিকি।

সেভেন সিস্টার্স তথা উত্তর-পূর্ব ভারতের একটা বিস্তীর্ণ অংশে রাষ্ট্রকে যে সেনা মোতায়েন করে সামিরক বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন (‘আফস্পা’) দশকের পর দশক ধরে বলবৎ রাখতে হয়েছে- সেটারও কারণ কিন্তু এগুলোই!

বাংলাদেশ আর সেভেন সিস্টার্স
মিজোরামের দু’দুবারের মুখ্যমন্ত্রী, মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের সর্বোচ্চ নেতা জোরামথাঙ্গা বছর দুয়েক আগে এই প্রতিবেদককে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বাংলাদেশের সাহায্য না-পেলে তাদের মিজো জাতীয়তাবাদী আন্দোলন কখনোই সাফল্যের মুখ দেখত না এবং মিজোরাম একটি পৃথক রাজ্য হিসেবেও হয়তো আত্মপ্রকাশ করতে পারত না।

আসলে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের (এমএনএফ) বিদ্রোহীরা ষাটের দশকের শেষে প্রায় তাদের জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশের ভূখণ্ডে (তখনকার পূর্ব পাকিস্তান) আশ্রয় পেয়েছিলেন, যা অব্যাহত ছিল প্রায় দীর্ঘ দু’দশক ধরে।

এমএনএফের প্রবাদপ্রতিম নেতা লালডেঙ্গা পূর্ব পাকিস্তান সরকারের আতিথেয়তায় ঢাকার লালমাটিয়া এলাকাতে একটি বাড়িতেই থাকতেন, আর ওই গোষ্ঠীর প্রশিক্ষণ শিবিরগুলো ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের সাজেক ভ্যালি ও তার আশেপাশের এলাকায়।

তখনকার তরুণ জোরামথাঙ্গা ছিলেন সুপ্রিম কমান্ডার লালডেঙার বিশ্বস্ত অনুচর ও ছায়াসঙ্গী। ১৯৮৭তে ভারতে মিজো শান্তি চুক্তির মাধ্যমে পৃথক মিজোরাম গঠনের পথ প্রশস্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি ও তার বহু সতীর্থ জীবনের বেশিটা সময় বাংলাদেশেই কাটিয়েছেন।

একই কথা খাটে আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী আলফা-র পরেশ বড়ুয়া, অনুপ চেতিয়া বা অরবিন্দ রাজখোয়ার মতো সর্বোচ্চ নেতাদের অনেকের ক্ষেত্রেই। তাদের সশস্ত্র আন্দোলনের অনেকটা সময়ই তারা ছিলেন বাংলাদেশের মাটিতে।

ত্রিপুরার সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী এনএলএফটি কিংবা ত্রিপুরা ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার্সের (যার নেতা বিজয় কুমার রাংখল এখন একজন মূল ধারার রাজনীতিক) সদস্যরাও অনেকেই বাংলাদেশের মাটিতে আশ্রয় পেয়েছেন, সেখান থেকেই পরিচালিত হতো তাদের কর্মকাণ্ড।

বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন (১৯৯১-৯৬ ও ২০০১-০৬) বাংলাদেশ সরকার অবশ্য কখনোই তাদের দেশের মাটিতে এই সব গোষ্ঠীগুলোর অস্তিত্ত্ব স্বীকার করেনি- আর এই ইস্যুটিও ঢাকা-দিল্লির দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিক্ততার জন্ম দিয়েছিল।

২০০৯-এ শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বের দ্বিতীয় মেয়াদে এই দৃশ্যপটে একটা নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে।

উগ্রবাদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করে হাসিনা সরকার একের পর এক বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাকে গোপনে বা প্রকাশ্যে ভারতের হাতে তুলে দিতে শুরু করে। বাংলাদেশের মাটিতে ওই সব গোষ্ঠীর প্রশিক্ষণ শিবিরও একে একে বন্ধ হতে থাকে।

আলফা নেতা পরেশ বড়ুয়া অবশ্য তার আগেই বাংলাদেশ ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি গেছেন। কিন্তু অনুপ চেতিয়া বা অরবিন্দ রাজখোয়ার মতো গোষ্ঠীর অন্য নেতারা ততদিনে ভারতে ফিরে এসে সরকারের সাথে ‘শান্তি আলোচনা’ও শুরু করে দিয়েছেন।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল তথা সেভেন সিস্টার্স যে নিরাপত্তাগত দৃষ্টিতে গত এক দশকে অনেকটাই স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ- তার পেছনে শেখ হাসিনা সরকারের অবদান ভারতের কর্মকর্তা ও পর্যবেক্ষকরাও তাই অকুণ্ঠে স্বীকার করেন।

সেভেন সিস্টার্সের জন্য শেখ হাসিনা সরকারের আর একটি বড় উপহার ছিল বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ভারতকে ব্যবহারের অনুমতি দেয়া।

এই দুটি বন্দর ব্যবহারের সুযোগ স্থলবেষ্টিত সেভেন সিস্টার্সকে শুধু সামুদ্রিক বাণিজ্যের নতুন দিগন্তই খুলে দেয়নি, ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে ভৌগোলিক দূরত্বও অনেক কমিয়ে দিয়েছে। মাতারবাড়ি বন্দর চালু হলে সেই সুযোগ আরো বাড়বে নিশ্চিতভাবে।

মিয়ানমারের মধ্যে দিয়ে ভারত যে কালাদান মাল্টিমোডাল প্রোজেক্ট বাস্তবায়নের কাজে হাত দিয়েছিল, সেটার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাও অনেক কমে গিয়েছিল বাংলাদেশ সরকারের ওই সিদ্ধান্তের ফলে।

কারণ মিয়ানমারের সিতওয়ে বন্দরের বদলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সড়কপথে পণ্য পরিবহন করা ছিল উত্তর-পূর্ব ভারতের জন্য তুলনায় অনেক সহজ।

ফলে এক কথায় বলতে গেলে ‘সেভেন সিস্টার্সে’র সার্বিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির নেপথ্যে বিশেষ করে বিগত দেড় দশকে বাংলাদেশের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।

বছর কয়েক আগে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘ভারতকে আমি যা দিয়েছি, তা তারা সারা জীবন মনে রাখবে!’

বহুল-আলোচিত সেই মন্তব্য নিয়ে পরে বহু চর্চা হলেও শেখ হাসিনা সে দিন ঠিক কী দেয়ার কথা বলেছিলেন, তা কখনোই ভেঙে বলেননি বা স্পষ্ট করেননি।

কিন্তু দুই দেশেই পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরা ধারণা করে থাকেন, তিনি সেদিন সেভেন সিস্টার্সে শান্তি ও প্রগতি ফিরিয়ে আনার দিকেই ইঙ্গিত করেছিলেন- ভারতের যে অঞ্চলটি ঢাকায় ক্ষমতার পালাবদলের পর আবার নতুন করে আলোচনায়!
সূত্র : বিবিসি

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com