বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে প্রথম রোগী শনাক্তের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল ৮ মার্চ। এরপর থেকে বেড়েই চলেছে জীবাণুনাশক পণ্যের চাহিদা। দেশের শীর্ষস্থানীয় দুটি উৎপাদক প্রতিষ্ঠান বলছে, কাঁচামাল সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী তারা বাজারে পণ্য সরবরাহ করতে পারছে না। আর এ সুযোগে বাজার ছেয়ে গেছে নকল জীবাণুনাশক পণ্যে।
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে চাহিদা এত বেড়েছে যে ৪/৫ গুণ বেশি দামে জীবাণুনাশক পণ্য বিক্রির অভিযোগও এসেছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো কয়েকটি জায়গায় এমন বেশি দামের কারণে ব্যবসায়ীদের জরিমানার ঘটনাও ঘটেছে।
একপর্যায়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে সাতটি কোম্পানির হ্যান্ড স্যানিটাইজারের দাম পর্যন্ত বেঁধে দিতে হয়েছে। তারপরেও এখনো অনেক জায়গায় অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রি হচ্ছে স্যাভলন কিংবা সেপনিলের মতো জীবাণুনাশক লিকুইডের বোতল।
একটি প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, জীবাণুনাশক সাবানসহ সব ধরনের পণ্যের বার্ষিক বাজার সর্বোচ্চ ৫শ’ কোটি টাকার মতো ছিল, যা এবার বছর শেষ ৫-৮ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়াবে বলে ধারণা করছেন তারা।
ঢাকার মগবাজারের অধিবাসী সানোয়ারা বেগম একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে তিনি হেক্সাসল ব্র্যান্ডের দুটি ৫০ মিলিলিটারের বোতল কিনেছিলেন আড়াইশ টাকায়, যদিও তার প্রকৃত মূল্য ছিল ৪০ টাকা করে মোট ৮০ টাকা।
সানোয়ারা বেগম বলেন, ‘আগে পাড়ার মুদি দোকানেও স্যাভলন পেতাম। হেক্সাসল বাসার সামনেই ছোটো ফার্মেসিতেই দেখতাম। কিন্তু মার্চের ১০/১২ তারিখে অনেক দোকান খুঁজে শেষে একটি বড় ফার্মেসিতে পেয়েছিলাম। কিন্তু দাম নিয়েছিলো আড়াইশ টাকা।’
আর একপর্যায়ে বাজারে কোন ধরনের জীবাণুনাশকই পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে এখন পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। উৎপাদক কোম্পানিগুলো বলছে, তারা সর্বোচ্চ উৎপাদন করেও চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করতে পারছেন না।
বরিশালের স্কুল শিক্ষক হোসনে আরা বলছেন, স্যাভলন ব্রান্ডের হ্যান্ড রাব অনেকদিন তিনি তার এলাকায় পাননি। তিনি বলেন, ‘এখন পাচ্ছি। তবে দোকানদাররাই বলছে, যে কম-কম নিন। কারণ কোম্পানিগুলো তাদের নাকি পর্যাপ্ত দিতে পারছে না।’
বাংলাদেশে যেসব কোম্পানি জীবাণুনাশক পণ্য উৎপাদন করে তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে স্কয়ার ও এসিআই। দুটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাই বলছেন, জীবাণুনাশক সাবান, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, হ্যান্ড রাব, জীবাণুনাশক লিকুইড অ্যান্টিসেপটিক, বেবি ওয়াইপসেরও মতো পণ্যগুলোর চাহিদা ব্যাপক বেড়েছে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে মাস্ক পড়া ও কিছুক্ষণ পরপর ২০ সেকেন্ড ধরে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ওপর। বাংলাদেশে সাধারণ সৌন্দর্য সাবান আর কাপড় ধোয়ার সাবানের ব্যবহার বেশি হতো। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে এসব সাবানের বিক্রির পাশাপাশি ব্যাপক বেড়েছে অ্যান্টিসেপটিক সাবানেরও।
এর বাইরে হ্যান্ড রাব ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবহার বেড়েছে বহুগুণ। এ পরিস্থিতিতে হঠাৎ করে বেশি দামে বিক্রি ঠেকাতে হস্তক্ষেপ করতে হয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে।
পাশাপাশি বাসাবাড়িতে লিকুইড অ্যান্টিসেপটিক ব্যবহার করে ফ্লোর পরিষ্কার এখন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ফলে এ ধরনের লিকুইডও ব্যাপকভাবে বিক্রি হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন ইস্কাটন এলাকার একজন দোকানদার লিটন মিয়া।
তিনি বলেন, ‘আগে দিনে ২/৩টা স্যাভলন লিকুইড বিক্রি করতাম। করোনা আসার পর কিছুদিন কোম্পানি থেকেই আনতে পারিনি উৎপাদন কম থাকায়। গত দু মাসে দিনে ৩০/৩৫টি করে বিক্রি করছি।’
বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় যেসব কোম্পানি জীবাণুনাশক পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করে তার মধ্যে আছে স্কয়ার, এসিআই, এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস, ইনসেপ্টা, ক্লিনজেল, গ্রিনল্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস ও অপসোনিন। এর মধ্যে এসিআইয়ের স্যাভলন বা হেক্সাসল এবং স্কয়ারের সেপনিল স্যানিটাইজারের বিক্রি বেড়েছে কয়েকশ গুণ।
স্কয়ার টয়লেট্রিজের হেড অফ মার্কেটিং জেসমিন জামান বিবিসি বাংলাকে বলছেন, আগে যেটি তারা বছরে ১৫-২০ টন উৎপাদন ও বাজারজাত করতেন। এখন সেই পণ্য প্রতিদিন ৬০-৭০ টন বাজারে সরবরাহ করতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘হ্যান্ড ওয়াশের চাহিদা বেড়েছে ৪/৫ গুণ, আর জীবাণুনাশক অন্য পণ্যগুলোর চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুণ। আমরা আসলে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহও করতে পারছি না। কারণ কারখানা ও কাঁচামালের ব্যাপার আছে। তবে বাজার চাহিদা মেটাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।’
অন্যদিকে, এসিআই কনজ্যুমার ব্রান্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আলমগীর বলছেন, তাদের স্যাভলন লিকুইড ও এন্টিসেপটিক ক্রিমের বাজার কোভিড ১৯ মহামারির আগে ছিল ৩৪ কোটি টাকার মতো। আগে দরকার ছিল ১০ লাখ মানুষের। এখন দরকার হচ্ছে ১৭ কোটি মানুষের। সুতরাং চাহিদাটা কেমন হয়েছে বুঝতেই পারছেন।
এসিআই বলছে, এ মূহুর্তে তাদের সাবান, স্যানিটাইজার, রাব, লিকুইড এন্টিসেপটিক, ওয়াইপস বাজারে আছে যেগুলো জীবাণুমুক্তকরণে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছে মানুষ।
আলমগীর বলছেন, করোনায় চাহিদা অনুযায়ী তারা সরবরাহ দিতে পারেননি। কারণ তারা আগে থেকেই এমন পরিস্থিতি হতে পারে বলে ধারণা করতে পারেননি।
‘তা ছাড়া লকডাউন ও ছুটির কারণে কন্টেইনারসহ নানা উপকরণ পাওয়া যাচ্ছিল না। আবার যেসব দেশ থেকে কাঁচামাল এনে থাকি সেসব দেশেও করোনা। ফলে কাঁচামাল সংকট। তবে আমরা আশা করছি, সামনের কয়েক সপ্তাহে উৎপাদন আরও অনেক গুণ বাড়াতে পারব আমরা’, বলছিলেন তিনি।
অন্যদিকে, এ দুটি প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছেন এমন একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘বাংলাদেশে করোনার আগে জীবাণুনাশক পণ্যের বাজার ছিল ৫শ’ কোটি টাকার মতো। এখন আমাদের যে অ্যাসেসমেন্ট তাতে এখন এটি অন্তত ৮ হাজার কোটি টাকার বাজার। বুঝতেই পারছেন বাজারটি কতটা বিস্তৃত হয়েছে। ফলে আমাদেরও ক্যাপাসিটি বাড়াতে হচ্ছে।’
সংকটের সুযোগ ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরগুলোতে অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়ে নকল জীবাণুনাশক পণ্য। প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির পণ্যের নামের সদৃশ নাম দিয়ে বিক্রি করার সময় অনেককে আটকও করেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা।
মে মাসেই চাঁদপুরে একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে নকল স্যাভলনের মজুত খুঁজে পায় পুলিশ এবং এ ঘটনায় আটক করা হয় কয়েকজনকে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, যশোরসহ অনেকগুলো জায়গাতে পুরো মাস জুড়েই নকল স্যানিটাইজারসহ নানা নিম্মমানের জীবাণুনাশক পণ্য বিক্রি হয়েছে ব্যাপক।
এসিআই নিজেও তাদের পণ্যের নকল করার ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে একটি বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করে। ঢাকাতেই গুলশানে দুটি ফার্মেসিকে নকল পণ্য রাখার দায়ে জরিমানাও করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।