মরণঘাতী করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর সারাদেশে খুলেছে সব ধরনের মার্কেট ও শপিংমল। কিন্তু ক্রেতার অভাবে ব্যবসা মন্দা যাচ্ছে মার্কেট ব্যবসায়ীদের। এমন পরিস্থিতিতে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে দোকান ভাড়ার বোঝা। এ অবস্থায় দুই মাসের দোকান ভাড়া মওকুফসহ করোনাকালীন অর্ধেক ভাড়ার দাবি তুলেছেন মার্কেট ব্যবসায়ীরা। দাবি পূরণে বিভিন্ন মার্কেটে চলছে মানববন্ধন, মিছিল ও লাগাতার বৈঠক। মালিক-ব্যবসায়ী দফায় দফায় বৈঠকেও মিলছে না সমাধান। মালিক পক্ষের একাংশ ভাড়া মওকুফ করলেও এখনো দাবি মানতে নারাজ অনেকেই। এ নিয়ে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে ব্যবসায়ীদের মাঝে।
ব্যবসায়ীরা জানান, করোনার কারণে পহেলা বৈশাখ ও ঈদুল ফিতরে কোনো ব্যবসা না হওয়ায় বড় লোকশনে রয়েছেন মার্কেট ব্যবসায়ীরা। সাধারণ ছুটি শেষে মার্কেট খুলে দেওয়া হলেও ক্রেতা নেই। ভাইরাস সংক্রমণের আতঙ্কে মানুষ মার্কেটমুখী হচ্ছেন কম। ক্রেতার অভাবে বেচা-বিক্রি একেবারেই তলানিতে ঠেকেছে। দোকান খোলা রাখার সময় বাড়ানো হলেও অবস্থা পরিবর্তন হয়নি। একদিকে আয় নেই, অন্যদিকে কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, দারোয়ানের বেতন, সার্ভিস চার্জসহ দোকান পরিচালনার বিভিন্ন খরচ টানতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। আরও রয়েছে বিদ্যুৎ বিল ও বিভিন্ন ঋণের বোঝা। এ অবস্থায় দোকান ভাড়া পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। তাই বাধ্য হয়েই এপ্রিল-মে মাসের ভাড়া মওকুফসহ করোনা পরিস্থিতিতে অর্ধেক ভাড়ার দাবি তুলেছেন তারা।
একই দাবিতে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের ইস্টার্ন মল্লিকা মার্কেট। দুই মাসের দোকান ভাড়া সম্পূর্ণ মওকুফ এবং জুন থেকে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত দোকান ভাড়া অর্ধেক করার দাবিতে গতকাল সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছেন মার্কেটের ব্যবসায়ীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মার্কেটের এক ব্যবসায়ী জানান, লকডাউন থাকায় এপ্রিল ও মে মাসে মার্কেট পুরোপুরি বন্ধ ছিল। ১ জুন থেকে মার্কেট খোলা থাকলেও করোনা সংক্রমণে ভিত্তিতে মার্কেটে বেচাকেনা নেই বললেই চলে। সমস্যার কথা জানিয়ে মার্কেটের দোকান মালিক সমিতির কাছে দুই মাসের ভাড়া মওকুফ এবং জুন মাস থেকে যতদিন করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয় ততদিন অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার জন্য আবেদন জানানো হয়েছে। আবেদনে মালিক সমিতি এখনো সাড়া দেয়নি। নিরুপায় হয়ে রাস্তায় নেমেছেন ব্যবসায়ীরা।
মার্কেট কর্তৃপক্ষ বলছেন, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আলোচনার মধ্য দিয়ে বিষয়টি সমাধান করা হবে। এবিষয়ে আলোচনা চলছে। শিগগিরই একটা সমাধানে পৌঁছা যাবে।
এদিকে একই দাবিতে রাজধানীর নিউমার্কেট-সংলগ্ন নিউ সুপার মার্কেটেও মালিকপক্ষ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে উত্তাপ বিরাজ করছে। লাগাতার আন্দোলনের মুখে গত মাসের শেষদিক থেকে মার্কেটের দোকান মালিক সমিতি দফায় দফায় বৈঠক করছে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। বৈঠকে এপ্রিল মাসের ভাড়া মওকুফের কথা হলেও এখনো তা কার্যকর হয়নি। এনিয়ে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে ব্যবসায়ীদের মাঝে।
মার্কেটের ব্যবসায়ী মো. গিয়াস উদ্দিন অপু বলেন, ঈদের পর মার্কেট খোলা হলেও অনেক দোকান রয়েছে, যাদের এক টাকাও বিক্রি হয়নি। অনেকেই মূলধন হারিয়ে সঞ্চয়ের টাকা ভেঙে ধার-কর্জ করে দোকান চালাচ্ছেন। আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মালিক পক্ষ থেকে এপ্রিল মাসের ভাড়া মওকুফের কথা বলা হলেও এখনো তা কার্যকর হয়নি। অন্যদিকে দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মালিক পক্ষের অসহিষ্ণুতায় হতাশ ব্যবসায়ীরা।
মার্কেটের রুমা ফেব্রিক্সসহ তিনটি দোকানের মালিক মো. আবুল খায়ের বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে এপ্রিল মাসের ভাড়া ও মে মাসের অর্ধেক ভাড়া মওকুফ করেছি। আমার মতো অনেকেই করেছেন। তবে মালিক পক্ষের একাংশ ভাড়া মওকুফ করতে রাজি না। তারা বলছেন, ব্যবসা ভালো হলে কেউ তো ভাড়া বেশি দেয় না, তবে মন্দ হলে আমরা কেন ভাড়া কম নেব।
এদিকে নিউ সুপার মার্কেট (দক্ষিণ) বণিক সমিতির সভাপতি মো. শহীদুল্লাহ শহীদ বলেন, আমরা দুপক্ষকে নিয়ে একের পর এক বৈঠক করছি। ব্যবসায়ীরা আমাদের কাছে দাবি জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন। তবে এটা মালিক ও ব্যবসায়ীদের মধ্যকার ব্যাপার। বণিক সমিতি এখানে সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। আমরা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। বেশিরভাগ মালিকই ব্যবসায়ীর দাবি বিবেচনায় নিয়েছেন।
ঢাকা নিউমার্কেট, ধানমন্ডি হকার্স মার্কেট ও চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটে ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভাড়া মওকুফ ও ভাড়া কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। চন্দ্রিমা সুপার মার্কেট দোকান মালকি সমিতির সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এপ্রিল ও মে মাসের অর্ধেক ভাড়া মওকুফ করা হয়েছে। এ ছাড়া আগামী ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত মাসিক ভাড়া ৩০ শতাংশ কমানো হয়েছে।
ঢাকা নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আমিনুল ইসলাম শাহীন বলেন, অনেক মালিক রয়েছেন যারা দোকান ভাড়া দিয়ে সংসার চালান। সবাই ভাড়া মওকুফ করতে পারছেন না। তবে আমরা তাদের সঙ্গে বেঠক করেছি। যাদের সামর্থ্য আছে তারা ভাড়া মওকুফ করছেন। আর বাকিরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনাসাপেক্ষে বিভিন্ন হারে ভাড়া কমিয়েছেন।
এর আগে গত সপ্তাহে নিউমার্কেটের পাশের নুরজাহান মার্কেটের ব্যবসায়ীরা একই দাবিতে আন্দোলন করেছেন। এ ছাড়া গাউসিয়া মার্কেট, চাঁদনী চক মার্কেট, ইস্টার্ন মল্লিকা, গুলিস্তান ঢাকা ট্রেড সেন্টারসহ রাজধানীর বেশ কিছু মার্কেটের ব্যবসায়ীরা দোকান মালিক সমিতির কাছে ভাড়া মওকুফের লিখিত আবেদন করেছেন। বিষয়টি সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে। ব্যবসায়ীরাও এখন আন্দোলনে। এর দেখাদেখি গুলিস্তান, উত্তরা ও মিরপুরসহ রাজধানীর অন্যান্য এলাকার মার্কেটগুলোয়ও ভাড়া মওকুফের দাবি তুলছেন ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন সবাইকে সমঝোতার মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন।
হেলাল উদ্দিন বলেন, ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে আমাদের বিষয়টি জানানো হয়েছে। তারা সহযোগিতা চেয়েছেন। বিষয়টি মূলত মালিক-ভাড়াটিয়ার মধ্যকার বোঝাপড়ার ব্যপার। এখানে আমরা কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারি না। তবে ব্যবসার সার্বিক পরিস্থিতি ও মানবিক দিক ভেবে ভাড়া মওকুফের বিষয়টি বিবেচনা করতে আমরা মালিকপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি। ইতোমধ্যে উত্তরাসহ অনেক এলাকার সিংহভাগ মার্কেটের মালিকদের রাজি করাতে পেরেছি। তাদের ধন্যবাদ জানাই। আশা করব বাকি মার্কেটগুলোও আমাদের আহ্বানে সাড়া দেবেন।
ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে হেলাল উদ্দিন বলেন, ইস্টার্ন মল্লিকায় যেটা ঘটেছে তা মোটেও কাম্য নয়। নিজেরা নিজেদের মধ্যে এ সমস্যার সমাধান করে নিতে হবে। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা যাবে না। মহামারীর সময় পারস্পরিক সহিষ্ণুতা বাড়াতে হবে। নিজেদের মতো করে নিজেরা কথা বলুন। বোঝাপড়া করে সমাধানে আসুন। ক্রান্তিকালের সময় সবাইকেই ধৈর্যশীল হতে হবে।