নাগরিকত্ব সংশোধন আইন এবং নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি করোনাভাইরাস মহামারির কারণে পর্দার আড়ালে চলে গেলেও খুব শিগগিরই নিশ্চিত তা মাথা তুলে দাঁড়াবে আবার। দেশভাগের ইতিহাসে নাগরিকত্বকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিতর্ক নতুন করে আগ্রহের সৃষ্টি করেছে। পণ্ডিতজন এবং মিডিয়া বিশ্লেষকদের মনে সিলেট গণভোটের বিষয়ে নতুন করে ইতিবাচক ধ্যান-ধারণা প্রকাশিত হয়েছে। অনেক পণ্ডিতজন যুক্তি দিয়েছেন যে, আসামে ‘বিদেশি সমস্যা’ ও এনআরসি আপডেট করার দাবিকে ঘিরে যে রাজনীতি তা ১৯৪৭ সালের সিলেট গণভোটে পাওয়া যায়, যা আসাম রাজ্যের বিভক্তি সৃষ্টি করেছিল। ভারতের অনলাইন দ্য প্রিন্ট-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে মালিনি ভট্টাচার্য আরো লিখিছেন, এই ঘটনার ৭৩তম বার্ষিকী ৬ই জুলাই। এ সময়ে হিন্দু সিলেটিদের কমপক্ষে দুটি প্রজন্মের জীবন ও তাদের গন্তব্য স্থায়ীভাবে পাল্টে গিয়েছিল। তারা বর্তমানের বাংলাদেশ, তাদের মাতৃভূমি ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং অবিভক্ত আসামে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিলেন। দেশভাগের পরে এসব মানুষের পরিণতি কোনো গল্প নয়- এটা স্বীকৃত।
মূলধারার দেশবিভাগের ইতিহাসে এসব ভালোভাবে বর্ণিত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় দেশভাগের প্রধান কারণ ছিল হিন্দু-মুসলিম ইস্যু। কিন্তু আসামে এই বিভাগের মূলে ছিল জাতি ও ভাষাগত বিষয়। আসামের উপ-জাতীয়তাবাদের ধারণার ওপর ভিত্তি করে সব সময়ই ‘বিদেশি বিরোধী আন্দোলন’ এবং আসামে এনআরসি করার সিদ্ধান্ত এসেছে জাতি-ভাষাভিত্তিক উগ্র জাতীয়তাবাদ থেকে, যা শুরু হয়েছিল দেশভাগের পরই ‘বাঙাল খেদাও আন্দোলন’ নামে। এ বিষয়টি যখন ‘মুসলিমবিরোধী’ এবং নরেন্দ্র মোদি সরকারের সামপ্রদায়িক পরিকল্পনা বলে মনে করা হলো তখনই প্যান-ইন্ডিয়ান বোদ্ধারা তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করলেন।
রাষ্ট্রহীন সিলেটি হিন্দু
নাগরিকত্ব ইস্যুতে সামপ্রদায়িকতা নিন্দনীয়। বিস্ময়কর যা থাকে তাহলো, কীভাবে জাতি-ভাষার ওপর ভিত্তি করে উগ্র জাতীয়তাবাদকে বৈধতা দেয়া হলো। এমনকি আসামীয় সমপ্রদায়ের হতাশার প্রকাশ স্বাভাবিকীকরণ করা হয়েছে। তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় বাঙালিদের দ্বারা হুমকিতে পড়েছে বলে মনে করা হয়। এই ভারসাম্যহীন ধারণার একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, বাস্তুচ্যুত এই সমপ্রদায়কে কেন্দ্র করে যে ধারণা তা ত্রুটিপূর্ণ। বিজ্ঞজন এবং জনপ্রিয় একটি ধারণা আছে যে, হিন্দু সিলেটিরা অবশ্যই সমজাতীয় এবং সুবিধাভোগী সমপ্রদায়। ঔপনিবেশিক সময় থেকেই অনেক দশকে আসামের সঙ্গে মিশে যাওয়ায় তাদেরকে এমনটা বলা হয়। প্রতিটি সমপ্রদায়ের দৃশ্যমান সুযোগ সুবিধা আছে। এটা শুধু একাকী তাদের কোনো বৈষম্য ও দুর্ভোগের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো উচিত নয়।
বর্তমান বাংলাদেশের একটি অংশ সিলেট। আসলে এটি পরিচিত ছিল শ্রীহট্ট নামে, যার আক্ষরিক অর্থ সমৃদ্ধিশালী। ঔপনিবেশিক শাসনের সময়ে প্রশাসনিক কারণে সিলেটকে বৃটিশরা কখনো বাংলায় কখনো আসামের মধ্যে ফেলতেন। ঐতিহাসিকভাবে এটা ছিল বাংলার অবিভক্ত অংশ এবং ১৮৭৪ সাল নাগাদ বৃটিশ ইন্ডিয়ার ফ্রন্টিয়ার অঞ্চল। ওই সময়ে তারা যোগ দিয়েছিল নতুন করে অর্জিত আসাম ভূখণ্ডের সঙ্গে। নতুন এই অঞ্চলের সঙ্গে সিলেটকে আসাম প্রদেশের মুখ্য কমিশনার যুক্ত করান প্রাথমিকভাবে রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য এবং আসামকে অর্থনৈতিকভাবে টেকসই প্রদেশ হিসেবে তৈরি করার জন্য।
কিন্তু আসামের সঙ্গে সিলেটের এই যুক্ত হওয়ার বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ করতে থাকেন ওই অঞ্চলের হিন্দু বাঙালিরা। কারণ, তারা চাইছিলেন আসামের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চেয়ে উন্নত বাংলায় ফিরে যেতে।
আসামের অভিজাত শ্রেণি দেখতে পেলো ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালিরা তাদের কর্মক্ষেত্রে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এবং আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক সমপ্রীতি তাদের কারণে লঙ্ঘন হবে বলে মনে করা হতো। তাই আসামের অভিজাতরা এ উদ্যোগের বিরোধিতা করেন। ১৯০৫ সালে যখন বঙ্গভঙ্গ হলো, তখন সিলেটকে পূর্ব বাংলা এবং আসামের অংশ করা হলো। ১৯১২ সালে তাকে আবার বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে আসামের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
ইতিহাসজুড়ে লক্ষ্যবস্তু
যখন দেশভাগের পরিকল্পনা করা হলো এবং হিন্দু-মুসলিমের মতো মিশ্র জনসংখ্যার এই অঞ্চল কীভাবে ভাগ হবে এমন প্রশ্ন এলো, তখন আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি এবং তখনকার আসামের প্রাইম মিনিস্টার গোপিনাথ বোরডোলোই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেন। তিনি ঔপনিবেশিক সরকারকে পটালেন সিলেটকে পূর্ব পাকিস্তানের কাছে ফিরিয়ে দিতে। এর ফলে ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ই জুলাই একটি গণভোট হয় সিলেটে। এতে ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৮১৫ বৈধ ভোটারের মধ্যে ৪ লাখ ২৩ হাজার ৬৬০ জন ভোট দেন। জে বি ভট্টাচার্য এবং বিনায়ক দত্তের মতো অনেক বোদ্ধা উল্লেখ করেছেন যে, সিলেট গণভোট নিয়ে বড় রকমের বিতর্ক তৈরি হয়ে গেল। কারণ, মুসলিম লীগের তরফ থেকে ভয়ভীতি প্রদর্শনের কারণে এক লাখ ২৩ হাজার ১৫৫ জন ভোটার ভোট দেননি। তাদের বেশির ভাগই বৃক্ষরোপণ কর্মী এবং প্রধানত হিন্দু। এই গণভোটের পরে সাড়ে তিনটি থানা পাথরকান্দি, বদরপুর, রাতাবাড়ি এবং করিমগঞ্জ বাদে সিলেটের বাকি অংশ হস্তান্তর করা হলো পূর্ব পাকিস্তানের কাছে। আসাম থেকে সিলেটকে বিচ্ছিন্নকরণকে ইতিহাসবিদ সুজিত চৌধুরী আসামের অভিজাত শ্রেণির জন্য ‘ঈশ্বর প্রদত্ত সুযোগ’ বলে অভিহিত করেছেন। এই অভিজাত শ্রেণি চাইছিল তাদের নিজেদের ভাষার, নিজেদের মতো করে একটি সমজাতীয় প্রদেশ।
সুজিত চৌধুরী স্বীকার করেন, আসামের অভিজাত শ্রেণির মধ্যে এই আত্মপ্রসাদ ছিল স্বল্পমেয়াদি। কারণ, হিন্দু সিলেটিরা এ সময়ে শরণার্থী হতে শুরু করলেন। সীমান্তে মুসলিমদের ভীতিপ্রদর্শন ও টার্গেট করার কারণে দেশভাগের পর পরই অবিভক্ত আসামে ছোটা শুরু করলেন এসব হিন্দু। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার জন্য চাপ দেয়া সত্ত্বেও বোরডোলোই সরকার শুধু শরণার্থীদের বসতির জন্য জমি দিতেই অস্বীকার করেনি, একই সঙ্গে সব অ-আসামীয় সমপ্রদায়ের ক্ষেত্রেও একই নীতি নিয়েছিল, যদিও এসব মানুষ আসামে বহু প্রজন্ম ধরে বসবাস করে আসছিল।
১৯৪৮ সাল থেকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাজুড়ে পর্যায়ক্রমে টার্গেট করা হচ্ছে হিন্দু বাঙালিদের। অনেকে এতে প্রাণ হারিয়েছেন। জীবিকা, সহায় সম্পদ হারিয়েছেন। ১৯৬০-এর দশকে শুরু হওয়া ভাষা বিষয়ক দাঙ্গা, ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত আসাম আন্দোলন মাঝে মাঝেই রাষ্ট্র সমর্থিত কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে, যেখানে হিন্দু বাঙালিদের হত্যা করা হয়েছে। তাদেরকে মেডিকেল এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পালাতে বাধ্য করা হয়েছে। এমনকি জীবনের ভয়ে তারা চাকরি থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। এদের মধ্যে যারা সামাজিক ও অর্থনৈতিক কিছু পুঁজির মালিক হয়েছিলেন তারা এসব দাঙ্গাকালে কলকাতা পালিয়ে যান। সেখানেই তাদেরকে স্বাগত জানানো হয় নি। তাদেরকে দেখা হতো ‘প্রবাসী বাঙালি’ (অনাবাসী বাঙালি) হিসেবে। মজার বিষয় হলো, ১৯৮৩ সালে নিলি গণহত্যার পূর্ব পর্যন্ত আসামের বাঙালি মুসলিমরা হিন্দু আসামিদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ এক মিত্রতা গড়ে তোলে। এতে একজাতীয় আসাম প্রদেশের দাবি জোরালো হয়েছিল।
হিন্দু সিলেটিরা এখন
আসামে সিলেটি হিন্দুদের দুর্দশার কথা তুলে ধরার চেষ্টাকালে আমি মুসলিমদের দুর্দশার কথা এড়িয়ে যেতে চাই না। বরং আসামে বিদেশি বিরোধী আন্দোলন জটিল হয়েছে। পুরো দেশে বেশির ভাগ হিন্দু সিলেটিদের কাছে স্বদেশের ধারণা রয়ে গেছে অধরাই।
বিস্ময়ের বিষয় হলো এই দুর্ভোগের কথা বৃহত্তর বোদ্ধা সমপ্রদায়ে ঘাটতি আছে। সিলেট গণভোটের বার্ষিকী রাজনৈতিক সহমর্মিতা প্রকাশের জন্য একটি উত্তম সুযোগ। দার্শনিক-তাত্ত্বিক জুডিথ বাটলারের যুক্তি অনুযায়ী, যেকোনো সময়ে একটি সমাজের বিদ্যমান বিশেষ আদর্শের জন্য একজন বৈধ ব্যক্তিকে আহ্বান করা। আরো বৃহত্তরভাবে বলা যায়, ভূখণ্ডহীন সিলেটি হিন্দুদের কথা সম্ভবত ভুলেই থাকা হবে। কারণ, রাজনৈতিকভাবে তারা কোনো ঘটনা নয়।
(লেখক আজিম প্রেমজি ইউনিভার্সিটির এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর)