দেশের সব বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ, হাসপাতাল, ক্লিনিক পরিচালিত হচ্ছে ১৯৮২ সালের একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে। ৩৮ বছরের পুরনো অধ্যাদেশটি বর্তমান প্রেক্ষাপটে একেবারেই অকার্যকর। অধ্যাদেশটির পরিবর্তে একাধিকবার বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা আইন তৈরির উদ্যোগের কথা জানা গেলেও তা ভেস্তে গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কার্যকর আইন না থাকায় বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ, হাসপাতাল ও ক্লিনিকের মান এবং স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে বারবারই প্রশ্ন উঠছে। অভিযোগ উঠছে রোগীদের জিম্মি করার। এ ধরনের একটি অকার্যকর অধ্যাদেশ দিয়ে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাত সরকারের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ কতটা সম্ভব প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। করোনার সংকটকালে এ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি আরও প্রকাশ্যে এসেছে। এ অবস্থায় বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে অধ্যাদেশের পরিবর্তে একটি যুগোপযোগী আইন প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, বেসরকারি হাসপাতালগুলো কার্যকরভাবে পরিচালনায় ১৯৮২ সালে তৈরি হয় ‘দ্য মেডিক্যাল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স’। এই অধ্যাদেশের ১৩ ধারায় বলা আছে একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক কিংবা একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ অধ্যাদেশের কোনো ধারা লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা জরিমানার করা যাবে। অধ্যাদেশ অনুযায়ী তৈরি করা শিডিউলে একজন অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক বা সমমানের চিকিৎসকের ফি ৪০ টাকা নির্ধারণ করা আছে। এটা প্রথম দর্শনীর ফি। দ্বিতীয় দর্শনীর ফি ২০ টাকা। বাড়িতে গিয়ে রোগী দেখার ফি ৮০ টাকা। শুধু চিকিৎসকদের ফি-ই নয়, ছোট-বড় অপারেশন, অ্যানেসথেশিয়া, ইসিজি, এক্স-রেসহ সব কিছুর ফি নির্ধারিত আছে অধ্যাদেশটিতে। একটি মেজর অপারেশনের ফি নির্ধারণ আছে ২ হাজার টাকা।
সেই সঙ্গে নির্ধারিত রয়েছে ইউরিন টেস্ট, প্রেগন্যান্সি টেস্টসহ ১০৫ ধরনের ল্যাবরেটরি টেস্টেরফিও। এই শিডিউল সময়ে সময়ে সংশোধন করার দায়িত্ব দেওয়া আছে সরকারের ওপর। কিন্তু বিগত ৩৮ বছরে শিডিউল সংশোধন হয়নি, পরিবর্তন হয়নি এ মূল্য তালিকার। আবার মূল্য তালিকার প্রত্যেকটি হাসপাতালের মানুষের কাছে দৃশ্যমান হবে এমন জায়গায় টাঙানোর কথা। কিন্তু দু’বছর আগে সেটিও টাঙানো হতো না। এক ধরনের বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা। অথচ দেশে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারী জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা নেন।
এ অবস্থায় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার দাবিতে ২০১৮ সালে হাইকোর্টে একটি রিট করেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট বশির আহমেদ। ২০১৮ সালের ২৪ জুলাই এ রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বিভিন্ন পরীক্ষার মূল্য তালিকা উন্মুক্ত স্থানে ১৫ দিনের মধ্যে প্রদর্শনের, ১৯৮২ সালের অধ্যাদেশের ধারা ১৪ এবং ১৬ অনুযায়ী চিকিৎসা ব্যায় শিডিউল রিভাইজড ও নতুন করে চিকিৎসা ব্যয় শিডিউল বিধি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে নির্দেশ দেন।
এ ছাড়া হাসপাতাল এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহার না করে বাণিজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশ দেন। সব জেলা সদরের হাসপাতালে ৩০ বেডের আইসিউ/সিসিইউ স্থাপনের প্রকল্প তৈরি ও বাস্তবায়ন করতে বলেন। এসব আদেশ পালন না করায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও পরিচালককে (হাসপাতাল) গত ৮ জানুয়ারি সশরীরে হাইকোর্টে হাজির হতে হয়। তারা নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন করার কথা জানান। কিন্তু হাইকোর্টের আদেশও বাস্তবায়ন করেনি সংশ্লিষ্টরা।
এ ব্যাপারে বশির আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘১৯৮২ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী প্রতি বছর প্রতিটি টেস্ট, অপারেশন, ডাক্তার ফি-এসব বিষয়ে মূল্য নির্ধারণ করার কথা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। কিন্তু সেটা তারা বিগত ৩৮ বছরেও করেনি। যার ফলে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকগুলো ইচ্ছামতো ব্যবসা করছে। যে কোনো টেস্ট বা অপারেশনের গলাকাটা দাম নিচ্ছে। ঢাকা মেডিক্যালে যে টেস্ট ২০০ টাকা সেটি অ্যাপোলা, ইউনাইটেড বা স্কয়ারে গেলে লাগে ২ হাজার টাকা। কিন্তু সরকার যদি একটা মূল্য নির্ধারণ করে দিত, তা হলে এটা করতে পারত না।’
তিনি বলেন, ‘প্রায় দেড় বছর আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জানিয়েছে, তারা একটি নতুন আইনের খসড়া তৈরি করেছে। এটা মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর আদালতে দাখিল করবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তারা সেটা দাখিল করেনি। সবাই বড় বড় কথা বলে কিন্তু কাজ করে না। যার কারণে এই বেহালদশা।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৮২ সালের এ অকার্যকর অধ্যাদেশের পাশাপাশি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের অধীনে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাত। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের অধীনে মাঝে মাঝেই কিছু অভিযান পরিচালিত হয় হাসপাতালগুলোয়। কিন্তু এ অধ্যাদেশ ও আইন দিয়ে বিশাল এ সেক্টরের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। যার প্রমাণ মেলে চলমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ভূমিকা ও নানা দুর্নীতির ঘটনায়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকার বড় কারণ আইনে দুর্বলতা। অধ্যাদেশ যখন করা হয়েছিল, তখন দেশে হাতেগোনা কয়েকটি বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ছিল। বর্তমানে তার অবয়ব বেড়েছে কয়েক গুণ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালের সংখ্যা ৬৫৪। আর বেসরকারি হাসপাতালের সংখ্যা ৫ হাজার ৫৫। তবে সারা দেশে এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি অনিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে। সেসব হাসপাতালের তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ করা হয় না। আবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এসব হাসপাতালের বিষয়ে তদারকিও দুর্বল। ফলে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতে এক রকম হ-য-ব-র-ল অবস্থা বিরাজ করছে।
এ ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা মোজাহেরুল হক বলেন, বেসরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানে সরকারের তদারকি বাড়াতে হবে। শুধু অনুমোদন দিয়েই দায়িত্ব শেষ করলে হবে না। সেই অনুমোদন নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে কিনা সে বিষয়টিও নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ১৯৮২ সালের অধ্যাদেশ দিয়ে এ সময় বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা পরিচালিত হতে পারে না। ওই অধ্যাদেশে বিধান লঙ্ঘনের কারণে রিজেন্টের মতো হাসপাতালকেও সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে ৫ হাজার টাকা জরিমানা বা ছয় মাসের জেল দেওয়া সম্ভব। আইনটি যুগোপযোগী করতে হবে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবার মান নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল বলেন, বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাত পরিচালনার জন্য দেশে লাকসই, যুতসই আইন নেই। ১৯৮২ সালের অধ্যাদেশ আর ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের মাধ্যমে সরকার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সে জন্য বেসরকারি হাসপাতাল, মেডিক্যাল কলেজ, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার কীভাবে চলবে তার একটা গাইড লাইন তুলে ধরে আইন করতে হবে।
তিনি বলেন, সরকারি ব্যবস্থাপনায় সব মানুষের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব নয়। এটা কোনো দেশেই সম্ভব হয়নি, এ দেশেও সম্ভব নয়। তবে তাই বলে বেসরকারি খাত তাদের ইচ্ছামতো চলতে পারে না। এ ক্ষেত্রে আইনের মাধ্যমে সরকারকে নির্ধারণ করে দিতে হবে, প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে চলবে। সে জন্য আইন করতে হবে। আর এটা সরকার ইচ্ছা করলে দু-এক মাসের করা যেতে পারে।
ডা. ইহতেশামুল হক আরও বলেন, করোনাকালে আমাদের দুটি বড় দুর্বলতা উন্মোচিত হয়েছে। এক সরকারি খাতে আইসিইউ, সিসিইউসহ নানা সংকট এবং দ্বিতীয়ত বেসরকারি লেভেলে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এ নিয়ন্ত্রণের জন্য যেমন লোকবল বাড়াতে হবে, তেমনি প্রত্যেককে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতে অনেক দুর্বলতা রয়েছে। যেগুলো দূর করতে হলে স্বাস্থ্য খাতের একটা বড় ধরনের সংস্কার দরকার। এ জন্য একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়ে এগোতে হবে। একজন ডিজি, একজন মন্ত্রী বা একজন সচিবকে সরিয়ে এ সেক্টরের দুর্নীতি রোধ সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন পুরো সিস্টেমটা আধুনিকায়ন ও ঢেলে সাজানো।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত পাঁচবার বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা আইন তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনোটিই আলোর মুখ দেখেনি। এর পেছনে এক শ্রেণির ডাক্তারের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রথমবার ১৯৯১ সালে আইনটি সময়োপযোগী করার জন্য খসড়া করা হয়েছিল। ১৯৯৮ সালে এসে আবার খসড়া করা হয়। নতুন করে ড. মোশাররফ হোসেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালে উদ্যোগ নেন ২০০৩ সালে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর ২০১১ সালে মহাজোট সরকারও উদ্যোগ নিয়েছিল। সর্বশেষ ২০১৬ সালে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা আইন করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু আজও আইন তৈরি সম্ভব হয়নি।
দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) গত ৭ ফেব্রুয়ারি ‘বেসরকারি চিকিৎসাসেবা : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এ গবেষণা প্রতিবেদনেও আইনের দুর্বলতার কথা তুলে ধরা হয়। এ অবস্থায় বেসরকারি হাসপাতাল, মেডিক্যাল কলেজ ও ক্লিনিক নিয়ন্ত্রণে আইন জরুরি বলে মনে করছেন অনেকেই।