২২ অক্টোবর এশিয়াবিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ সাব-কমিটিতে এশিয়ার মানবাধিকার বিষয়ে ঐতিহাসিক শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। শুনানিতে যখন শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান এবং ভারতের আসাম রাজ্যের মানবাধিকারের উদ্বেগজনক অবস্থা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল, তখন ভারতের অধিকৃত কাশ্মিরের চলমান অবরোধ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। এবারই প্রথম মার্কিন কংগ্রেসে কাশ্মির সঙ্কটের প্রতি এত বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
৫ আগস্ট ভারত সরকার কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করার পর থেকে সেখানে যোগাযোগের ওপর অবরোধ আরোপ করা হয়েছে এবং সেটেলার কালোনিয়াল প্রজেক্টে ভয়ভীতি ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বিশ্বের সর্বাধিক সেনা পরিবেষ্টিত সামরিক অঞ্চলটিকে নজিরবিহীন পন্থায় আন্তর্জাতিকীকরণ করা হয়।
আমেরিকান হাউস সাব-কমিটিতে শুনানি করা হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। পলিসি সার্কেলে কাশ্মির ইস্যুটি কিভাবে আলোচিত হচ্ছে, এটা তার একটি ইঙ্গিত। কেবল ৫ আগস্টের পরে নয়, কাশ্মিরে ব্যাপক রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের বিষয়টি প্রত্যক্ষদর্শীরা গুরুত্বসহকারে তুলে ধরতে পারবেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধি ফ্রান্সিসকো বেনকসমি ভারতে বিনা বিচারে আটক, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর উদ্বেগজনক আঘাত করার ব্যাপারে কথা বলেন। কংগ্রেস সদস্যরা যোগাযোগের ক্ষেত্রে অবরোধ আরোপ করার যৌক্তিকতা নিয়ে কঠিন প্রশ্ন করেছেন।
পেনসিলভানিয়া থেকে আগত কংগ্রেস প্রতিনিধি সুসান ওয়াইল্ড বলেন, ‘যদি সেখানে কোনো স্বচ্ছতা না থাকে, তাহলে সেখানে কিছু লুকানো হচ্ছে।’ নিতাশা কাউল এবং অঙ্গনা চ্যাটার্জিসহ কাশ্মির বিষয়ে দক্ষ পণ্ডিতরা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের উত্থান এবং এর সাথে নাৎসিবাদের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেন। সাথে সাথে তারা কাশ্মিরে জোরপূর্বক গুম করার প্রবণতা, ধর্ষণ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং নির্যাতনের বিষয় তুলে ধরেছেন। ৫ আগস্ট থেকে কাশ্মিরে আমেরিকার কূটনীতিকদের প্রবেশের অনুমতি না দেয়ার কথা স্বীকার করে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলিস ওয়েলস এবং ব্যুরো অব ডেমোক্র্যাসির সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড লেবার, রবার্ট ডেস্ট্রোসহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে ভারতের টকিং পয়েন্টস-এর কাছে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিভঙ্গিসহ ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের গুরুত্বকে জোর দিয়ে উল্লেখ করা হয়। তা সত্ত্বেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কাশ্মিরের জন্য রাতারাতি যা করেছেন তাকে সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের জন্য কাশ্মিরিরা যে আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে আসছিল তারই সমান অর্জন বলা যায়।
গত ৫০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো গত মাসে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ কাশ্মির ইস্যু নিয়ে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় মোদি হিউস্টন এবং নিউ ইয়র্কে বৃহত্তম প্রতিবাদ বিক্ষোভের মুখে পড়েন। কাশ্মির নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আগে কখনো এত বড় প্রতিবাদ বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক ডজন নির্বাচিত কর্মকর্তা কাশ্মিরের মানবাধিকার সঙ্কটের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তারা সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমালোচনা করেছেন।
মোদির কার্যক্রম ও তৎপরতার কারণে প্রকারান্তরে কাশ্মিরিরা রাজনৈতিকভাবে পরিতৃপ্ত এবং তারা নতুন করে সতেজ হয়ে উঠেছেন। কাশ্মিরিরা চলমান হুমকির ব্যাপারে এখন পুরোপুরি প্রস্তুত বা সতর্ক। উল্লেখ্য, তাদের পরিবারগুলো উগ্র জাতীয়তাবাদী সরকারের মোকাবেলা করে আসছে। তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি, কাশ্মিরিদের আশা আকাক্সক্ষার বিষয়টি দেখভাল করার জন্য আহ্বান জানানোর অগ্রভাগে। তারা কাশ্মির ইস্যুটিকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ‘একমাত্র দ্বিপক্ষীয়’ বিরোধের লেন্স দিয়ে দেখা থেকে বেরিয়ে আসতে চান।
বিশ্বের কয়েকশ’ শহরে কাশ্মিরিদের সমর্থনে প্রতিবাদ বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ৫ আগস্টের আগে যেসব লোক কাশ্মিরের কথা শোনেননি, তারাও এখন কাশ্মিরিদের সমর্থনে সমবেত হচ্ছেন এবং তারা কাশ্মির সঙ্কটের সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ চান। প্রগতিশীল এবং আন্তঃধর্মীয় কোয়ালিশন বিশ্বব্যাপী কাশ্মির এবং অন্যান্য ফ্যাসিবাদবিরোধী, উপনিবেশবিরোধী, দখলদারিত্ববিরোধী এবং যুদ্ধবিরোধী গ্রুপগুলোর মধ্যে সম্পর্কের ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠেছে।
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ভারতের ভুল হিসাবের কারণে কাশ্মিরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের বিষয়টি বিশ্ববাসীর কাছে নতুন করে উপস্থাপিত হয়েছে। একই সাথে, কাশ্মির যে প্রকৃতপক্ষে একটি বিরোধপূর্ণ অঞ্চল এবং রাজনৈতিক সমাধানের অপেক্ষায় রয়েছে এ কথা বিশ্ববাসী আবার উপলব্ধি করতে পেরেছে। বছরের পর বছর ধরে ভারত কথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের ছদ্মাবরণে কাশ্মিরকে আইন ও নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে ‘অভ্যন্তরীণ’ বিষয় বলে সেখানে হস্তক্ষেপ করে আসছিল। ভারত এক দিকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের মর্যাদা লাভের মিথ্যা বড়াই করে আসছে; অপর দিকে স্বাধীনতাকামী কাশ্মিরিদের ওপর বর্বরোচিত নির্যাতন চালিয়ে আসছে।
কাশ্মিরের বহু মানুষকে হত্যা অথবা তাদের ওপর ছররা গুলিবর্ষণের মাধ্যমে নির্যাতন ও মানবাধিকার লংঘনের বিষয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রকাশ করার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তেমন একটা উচ্চবাচ্য করতে দেয়নি ভারত। সম্ভবত ভারত সরকার মনে করেছে, এবারো তাদের রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনকে ভিন্নভাবে দেখা হবে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আগ্রহী বার্নি স্যান্ডার্স ‘কাশ্মিরি জনগণের ইচ্ছার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে’ কাশ্মিরের ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘ প্রস্তাব বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছেন। যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টি তাদের নেতা জেরেমি করবিনের প্রতি কাশ্মিরে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের ‘প্রবেশের’ ব্যবস্থা করার আহ্বান জানিয়ে কাশ্মিরের ব্যাপারে একটি জরুরি প্রস্তাব পাস করেছে। লেবার পার্টি কাশ্মিরের জনগণের জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবি জানিয়েছে। ভারতের উগ্রজাতীয়তাবাদী হিন্দু সরকার আন্তর্জাতিক নিন্দা মোকাবেলায় সর্বাত্মক প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। ভারত আক্রমণাত্মক কূটনীতির মাধ্যমে ৮০ লাখ মানুষের কণ্ঠ রোধ করার ব্যাপারে কোনো যুক্তিসঙ্গত জবাব দিতে পারেনি। পাকিস্তানের হস্তক্ষেপ ও সন্ত্রাসবাদের ব্যাপারে তাদের পুরনো যুক্তিও ধোপে টেকেনি।
‘ওই অঞ্চলের মানুষের স্বার্থেই সেখানে অবরোধ আরোপ করা হয়েছে’ বলে চিৎকার করেও ভারত মিত্রদের কাছে অবরোধের যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে পারেনি। শুনানির সময় অ্যামনেস্টির বেনকসমি এ ব্যাপারে অনেক কথা বলেছেন। তিনি বলেন, একটি অঞ্চলে পর্যটনের উন্নয়নে শিশু, রাজনৈতিক নেতা, যুবকদের আটক করা এবং সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে জনগণকে কার্ফুর মধ্যে নিক্ষেপ করার বিষয় সম্পূর্ণ অচিন্তনীয়।’
তা সত্ত্বেও ভারতীয় লবি পাকিস্তানি জুজুর কথা উত্থাপন না করে পারেনি। কাশ্মিরের ব্যাপারে ভারতের টকিং পয়েন্টগুলোতে যখন ব্যাপক গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছে, তখনো ভারতের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, কাশ্মিরের বাইরে থেকে সংগঠিত করে পাকিস্তানের জন্য এসব প্রক্সি দেয়া হচ্ছে। ভারতীয় সাংবাদিক আরতি টিকূ সিং শুনানিতে ভারতের তৎপরতাকে সমর্থন করে বলেছেন, পাকিস্তানের ‘আইএসআই টিম’ কাশ্মিরের প্রতি তৃণমূল পর্যায়ে সংহতি জানানোর জন্য এসব বিষয় সংগঠিত করেছে। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি এবং দেয়ালের লিখন দেখতে অস্বীকৃতি ও অসামর্থ্য কাশ্মির নিয়ে ভারতের অবস্থানকে স্পষ্ট করে দিয়েছে।
লেখক : লাফায়েট কলেজের সাউথ এশিয়ান হিস্ট্রি সহকারী অধ্যাপক
আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার