একের পর এক ‘অবিশ্বাস্য’ পরাজয়ের পরও বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে ভোটে যাওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে বিএনপিতে বিভক্তি দীর্ঘদিনের। তবে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বিরাগভাজন হওয়ার আশঙ্কায় এতদিন ভোটপন্থিদের সঙ্গে এর বিরোধীদের দ্বন্দ্ব কিছুটা চাপা ছিল। সদ্য অনুষ্ঠিত ঢাকা-১৮ আসনের উপনির্বাচনের পর অনেকেই মুখ খুলতে শুরু করেছেন।
বিএনপির তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম পর্যন্ত একাধিক নেতার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা বলেন, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি কেন উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে- এ প্রশ্নের উত্তর তাদের জানা নেই। এই নেতাদের অনেকেই মনে করেন, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দি হওয়ার পর তার মুক্তির দাবিতে যথাযথ আন্দোলন না করা, নির্বাচনে যাওয়া, প্রার্থী চূড়ান্তকরণ, সংসদে যোগ দেওয়াসহ বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে।
যদিও বিভিন্ন সময়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তারা বিশ্বাস করেন সরকার পরিবর্তনের একমাত্র পথ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে হবে। এ জন্য তারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
মহাসচিবের এমন বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে দলের একজন ভাইস চেয়ারম্যান ও একজন যুগ্ম মহাসচিব বলেন, ক্ষমতাসীনরা নির্বাচনে অনিয়ম করবে আর আমরা শুধু চেয়ে দেখব- এটা হয় না। এটার নাম নির্বাচন বা রাজনীতি নয়। ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে বরং বিএনপিকে বলে দিচ্ছে- তোমরা ঠিক পথে নেই। এ বিষয়টি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে বুঝতে পারছেন বলে মনে হয় না।
দলের গুরুত্বপূর্ণ আরেক নেতা বলেন, দেশ ও দলের বাস্তব চিত্র তারেক রহমানের কাছে আছে বলে মনে করি না। দলের কিছু নেতাকে নিয়ে গঠিত বিশেষ একটি সিন্ডিকেটের দেওয়া ‘ভুল তথ্যের’ ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। এ কারণে দলের বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত ভুল হচ্ছে যার দায়ভার বহন করতে হচ্ছে তারেক রহমানকে। এ জন্য সাধারণ মানুষের কাছে বিএনপি ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ব্যাপকভাবে সমালোচিতও হচ্ছেন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমেদ প্রকাশ্যেই চলমান ব্যবস্থায় নির্বাচনে দলের অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, কেন আমরা এ ধরনের নির্বাচনে যাই? যখন নির্বাচনে যাওয়া উচিত না তখন যাই, যখন যাওয়া উচিত তখন যাই না। বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচনে অংগ্রহণের মধ্য দিয়ে বিএনপির অর্জন কী জানতে চাইলে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, নানা নির্যাতন, নিপীড়ন, হামলা মামলা সহ্য করে নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে প্রমাণ করতে আমরা সক্ষম হয়েছি বিএনপি গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণের ভোট ছাড়া ক্ষমতা পরিবর্তনের অন্য কোনো উপায় বিএনপির জানা নেই। আমরা মনে করি, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অচিরেই একদিন সব নির্যাতন নিপীড়ন শেষ হবে, দেশের মানুষ মুক্ত জীবনে ফিরে আসবে। আশা করি, আমাদেরই বিজয় হবে। খুলনা বিভাগের এক নেতা জানান, নির্বাচনে অংশগ্রহণ ইস্যুতে তৃণমূলের কোনো নেতাকর্মী পারতপক্ষে রাজি নন। এর পরও কেউ কেউ ভবিষ্যতের কথা ভেবে প্রার্থী হন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় বিভিন্ন উপজেলা, পৌর ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেয়রসহ ২৯টি পদের মধ্যে ১০টিতে দলের কেউ আগ্রহ দেখাননি। দলটির নেতাদের ভাষ্য, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হুমকি-ধমকিতে সৃষ্ট ভয়, গ্রেপ্তার-মামলার শঙ্কার কারণেই ভোটে আগ্রহ হারিয়েছেন নেতাকর্মীরা।
বিএনপির একাধিক নেতা জানান, খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিপক্ষে ছিল দলের বেশিরভাগ নেতাকর্মী। ওই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিএনপির সব মহলেই সমালোচনা এখনো চলমান। নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান (পদত্যাগ করেছেন), মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বরচন্দ্র রায় প্রচ- বিরোধিতা করেছিলেন। ওই ভোটে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করেননি।