খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে শক্তভাবেই বিএনপির হাল ধরেছিলেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। জ্যেষ্ঠ নেতাদের নিয়ে জাতীয় নানা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ভালোভাবে সামালও দিচ্ছেন তিনি। তাতে ছন্দপতন ঘটে মির্জা আব্বাসের সাম্প্রতিক একটি বক্তব্য কেন্দ্র করে কিছু নেতার ‘বাড়াবাড়িতে’। সেই পরিস্থিতি এখন এতটাই ‘ঘোলাটে’ হয়েছে যে, দলের মধ্যে বিভক্তি ‘চরমভাবে’ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান আমাদের সময়কে বলেন, দলের মধ্যে কোনো একটি বিষয় নিয়ে কথা হতেই পারে, তাই বলে তাকে বিভক্তি বলা কোনোভাবেই ঠিক হবে না।
গত ১৭ এপ্রিল এক ভার্চুয়াল সভায় নিখোঁজ বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীকে নিয়ে মির্জা আব্বাসের বক্তব্যের বিষয়টি জাতীয় রাজনীতিতে
আলোচনায়ই আসেনি; কিন্তু কয়েক নেতা তার ওই বক্তব্যকে পুঁজি করে ঘোলাটে পরিস্থিতি তৈরি করেছেন। দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী নেতা মির্জা আব্বাসকে বক্তব্যের ব্যাখ্যা চেয়ে এমন ভাষায় চিঠি দেওয়া হয়েছে, যা তার জন্য বিব্রতকর।
এই পরিস্থিতি কেন তৈরি হলো তার খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায়, বিএনপিতে এখন অত্যন্ত প্রভাবশালী বলে পরিচিত স্থায়ী কমিটির তিন নেতাই মূল কারণ। দলে আধিপত্য ধরে রাখার জন্য মির্জা আব্বাসসহ দলের স্থায়ী কমিটির অন্তত তিন সদস্য, তিন ভাইস চেয়ারম্যান ও চার যুগ্ম মহাসচিবকে কোণঠাসা করতে চান তারা। তাই মির্জা আব্বাসকে বিতর্কিত করতে তার বক্তব্য ইস্যু করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে এখন বিএনপিতে ‘আমদানি ও খান্দানি’ নাম দুটি শব্দ বলাবলি হচ্ছে। অর্থ্যাৎ যারা জিয়াউর রহমানের আমল থেকে বিএনপিতে আছেন কিংবা বিএনপিতে এসেই রাজনীতির হাতেখড়ি; তাদের বলা হচ্ছে খান্দানি। আর যারা অন্য দলের রাজনীতি করে ’৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার আগে-পরে দলে যোগ দিয়েছেন তাদের বলা হচ্ছে ‘আমদানি’। অর্থ্যাৎ তারা অন্য দল থেকে আমদানি হয়ে বিএনপিতে এসেছেন।
তবু উদ্ভূত এ পরিস্থিতির জন্য মির্জা আব্বাস কি দায়ী নন? কারও মতে, মির্জা আব্বাসের বক্তব্য এমনই। এটি তার স্বভাবসুলভ বক্তব্য। তার অতীত বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে এটিই প্রমাণ হবে। তিনি দলের ভেতরে থেকে দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছেন- এমন প্রমাণ কেউ দিতে পারেননি। তার পরও দলের নেতা-কর্মীদের অনেকেই মনে করেন, সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের নেতা হয়ে তার আরও সহনশীল হওয়া উচিত। বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। তার বক্তব্যে যাতে কেউ বিভ্রান্তির সুযোগ তৈরি করতে না পারে।
মির্জা আব্বাসের ওই বক্তব্যের পর দলের মধ্যে দুটি ধারার দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করেছে। এক পক্ষ মির্জা আব্বাসের বক্তব্য স্বাভাবিক মনে করছে, কেউ কেউ সমালোচনা করলেও তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে চিঠি দেওয়াকে শোভনীয় মনে করেননি। তাদের মতে, স্থায়ী কমিটির সভায় আলোচনা এবং তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে সহজ সমাধান দেওয়া যেত। অপরপক্ষ মনে করেন, দলের সবার জবাবদিহিতা থাকা উচিত। তাই ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। অবশ্য, কেউ কেউ বলেন, অতীতে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাদের অনেকেই বেফাঁস বক্তব্য দিয়েছেন, যাদের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার প্রশ্ন আসেনি।
দলের গুরুত্বপূর্ণ দুই ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, তারেক রহমান দল পুনর্গঠন করে সংগঠন আরও শক্তিশালী করছেন। অন্যদিকে দলের একটি অংশ বিভেদ তৈরিতে ব্যস্ত রয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন সকালে ‘ভালো নির্বাচন’ হচ্ছে যারা বলেছিলেন, তাদের ব্যাপারে দল কেন ব্যবস্থা নেয়নি। কূটনীতিক উইংয়ের চরম ব্যর্থতার জন্য কে দায়ী? যাদের কারণে সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া মার্কিন মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ পেল না বিএনপি, তারা তো জবাবদিহিতার বাইরে আছেন।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল আমাদের সময়কে বলেন, ‘বিএনপিতে বিভক্তির কোনো সুযোগ নেই। তবে নেতাদের ব্যক্তিগত রেশারেশি ও ঈর্ষা পরিহার করা উচিত। ওপরে ওপরে লোক দেখানো ঐক্য দেখালে চলবে না, পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও আন্তরিকতার মাধ্যমে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে হবে। সে চেষ্টা আমাদের সবার করতে হবে। এটা আমাদের সবাইকে বুঝতেও হবে।’
তিনি বলেন, ‘একটা কথা সবাইকে বুঝতে হবে, মির্জা আব্বাস বিএনপি ও জিয়াপরিবারের পিলার। দলের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে জিয়াপরিবার এবং বিএনপির আস্থাভাজন নেতা। যদি কেউ হিংসা বা ঈর্ষার কারণে তার ক্ষতি করার চেষ্টা করে, আমার বিশ্বাস সেটি আমাদের দলের চেয়ারপারসন ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান গভীরভাবে বিবেচনা করবেন।’
বিএনপির নেতাদের মধ্যে যারা দলের জন্মলগ্ন থেকে রাজনীতি করছেন কিংবা যাদের রাজনীতি বিএনপিতে শুরু; তাদের অনেকেই এখন কোণঠাসা। স্থায়ী কমিটিতে এমন অনেক আছেন, যাদের বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ খুবই কম। দলীয় কর্মসূচিতে তেমন আসেন না। নয়া পল্টন কার্যালয়ে তাদের দেখা মেলে না। ওই নেতারা বলে বেড়ান- তারা-ই এখন দলের সব। সব সিদ্ধান্ত তারা নেন। তাদের সিদ্ধান্তই তারেক রহমানের সিদ্ধান্ত। মূলত ওই নেতারাই দলের একটি অংশের নেতাদের কোণঠাসা করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
নয়াপল্টন ও গুলশান কার্যালয় সংশ্লিষ্ট নেতাদের সূত্রে জানা যায়, কিছুদিন আগে দুই ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম, শওকত মাহমুদকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ এনে শোকজ করা হয়েছিল। মূলত তারা সরকারবিরোধী আন্দোলনের পক্ষের নেতা; কিন্তু তারেক রহমানকে ভুল বুঝিয়ে ওই শোকজ করা হয়েছিল। সেই শোকজ দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত রুহুল কবির রিজভী পাঠানোর কারণে তারও সমালোচনা করা হয়েছে। অবস্থাটা এমন জায়গায় গিয়েছে, দলের কিছু নেতা সাপ হয়ে ছোবল মারে, আবার ওঝা হয়ে ঝাড়ে। মাঝখান দিয়ে বিতর্কিত হন তারেক রহমান।
চেয়ারপারসনের এক উপদেষ্টা বলেন, দলের যারা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের লোক, তাদের নানাভাবে বিতর্কিত করার চেষ্টা চলছে। একপর্যায়ে জিয়াপরিবারের আস্থাভাজন নেতাদের হাইকমান্ডের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে ষড়যন্ত্রকারী নেতারা তাদের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছেন।
খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার দিন থেকে বিএনপি যৌথ নেতৃত্বের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে; কিন্তু খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে তাদের অনেক সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল না বলে মনে করেন নেতাকর্মীরা। নেতাকর্মীদের অভিযোগ- খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর ড. কামালের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট গঠন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপ, কোনো দাবি না মানলেও নির্বাচনে অংশগ্রহণ, নির্বাচনের পরের দিন ফল প্রত্যাখান ও প্রতিবাদে কর্মসূচি না দেওয়া, সংসদে যোগদান ইত্যাদি কোনোটাই সাধারণ নেতাকর্মীদের মনের মতো হয়নি। যার দায়ভার দলের সিনিয়র নেতারা কেউই নেননি। বরং অনেক নেতাকেই বলতে শোনা যায়- এসব ভুল সিদ্ধান্তের জন্য তারেক রহমান দায়ী।