রবিবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ১২:২৭ পূর্বাহ্ন

৭ বাংলাদেশীর পাসপোর্ট ভিসা বাতিল, ৫ জনকে দেশে ফেরত

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৯
  • ৩৪৮ বার

ব্রুনাইয়ের শ্রমবাজারে বাংলাদেশী দালালচক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে উভয় দেশের সরকার। ব্রুনাইয়ে গিয়ে নামে-বেনামে কোম্পানি খুলে ভালো বেতনের কথা বলে বাংলাদেশ থেকে বৈধ-অবৈধভাবে শ্রমিক নিয়ে যাওয়া, তাদের কাজ না দিয়ে রাস্তায় ছেড়ে দেয়া, নির্যাতন করা, ভিসা ট্রেডিং, জাল ভিসা তৈরি, নারী কেলেঙ্কারি ও মাদক কারবারসহ নানা অপরাধে জড়িত কমপক্ষে ৭ বাংলাদেশীর পাসপোর্ট ও ভিসা বাতিল করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৫ জনকে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে ব্রুনাই সরকার। বাকি ২ জন পলাতক। একই অপরাধে গত কয়েক দিন আগে ব্রুনাই ইমিগ্রেশন পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে জেলে রয়েছেন ২ জন। তাদের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেসে চার্জ গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। এর বাইরে আরো কমপক্ষে ২০ বাংলাদেশীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে ব্রুনাই সরকার। অনেকে গ্রেফতার এড়াতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে শুরু করেছেন। ব্রুনাইয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, দালালচক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ হাইকমিশন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে কয়েক দফা চিঠি দিয়েছেন। একইভাবে ব্রুনাই সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরেও চিঠি দিয়েছেন তারা। কিন্তু দালালচক্রের বিরুদ্ধে আশানুরূপ ব্যবস্থা না নেয়ায় বেপরোয়া হয়ে পড়েন বাংলাদেশী দালালচক্র। হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের বাসায়ও হামলা করেছেন তারা। গত আগস্ট মাসে কয়েক দফায় ১৫ জনের বেশি বাংলাদেশীর (মানবপাচার-ভিসা ট্রেডিংয়ে জড়িত) পাসপোর্ট বাতিল করে দেশে ফিরিয়ে আনতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তালিকা দেয়া হয়। ইতোমধ্যে ৭ জনের পাসপোর্ট বাতিল করে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ব্রুনাই সরকারকে সংশ্লিষ্টদের দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশ হাইকমিশনের পক্ষ থেকে ব্রুনাই লেবার ডিপার্টমেন্ট ও ইমিগ্রেশনে দালালচক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানিয়ে যোগাযোগ অব্যাহত রাখে। এ অবস্থায় সম্প্রতি মানবপাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত বাংলাদেশীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে থাকে ব্রুনাই সরকার। ব্রুনাইয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশন সূত্র জানায়, সম্প্রতি মানবপাচারের অভিযোগে মো: মেহেদী হাছান (বিজন), সোহরাব খান (বিজে ০৭৩৭৮১৮), মো: সোহেল আহমেদ (বিপি ০১৯৬৫২২), মো: মনির হোসেন (বিএ ০৩৩৩১৬০), এম এ শফিক (এএফ ০৮৫৬৮১৬৩), মো: আসিফ (বিএফ ০৯৬৬৭৩০), জজ মিয়া, রাসেল আহমেদ ও মোহাম্মদ মুক্তারকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। জেলে রয়েছেন মো: আব্দুর রহিম (বিআর ০১৯১৫০৬, আইসি ৫১-৪৫৩৩২৪) ও আব্দুল্লাহ আল মামুন (অপু)। পলাতক রয়েছেন- কামরুল হাছান (বিপি ০১২১৪৭৭), মো: ইলিয়াছ মিয়া (বিআর ০৩৩৩২৫৪), ইসমাইল সরদার (বিএম ০১৯৩২৭৭), শাহেদ আহমেদ মজুমদার (বিএন ০৪৯০২১৩)। তাদের মধ্যে শেষের জন মালয়েশিয়ায় পালিয়ে গেছেন। এছাড়া গ্রেফতার এড়াতে দেশে পালিয়ে এসেছেন সাইফুল ইসলামসহ (বিটি ০৬৭২১২২) কয়েকজন।

বাংলাদেশ হাইকমিশনের শ্রম উইংয়ের ফার্স্ট সেক্রেটারি মো: জিলাল হোসেন এসব তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, বর্তমানে ব্রুনাই সরকার দালালচক্রের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে মানবপাচার, ভিসা জালিয়াতিসহ নানা অপরাধমূলক অভিযোগ রয়েছে তাদের গ্রেফতারে স্থানীয় প্রশাসন সক্রিয় রয়েছে। আমরা চাই যেকোনো মূল্যে ব্রুনাই শ্রমবাজার দালালমুক্ত হোক। কারণ তাদের নেতিবাচক কার্যক্রমে বাংলাদেশের সুনাম নষ্ট হচ্ছে।
কার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ

ব্রুনাই বাংলাদেশ হাইকমিশন সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে ব্রুনাইয়ে যেসব কর্মী গিয়েছেন তাদের বড় একটি অংশ সেখানে নামে-বেনামে কোম্পানি খুলে বসেছেন। এসব কোম্পানির নামে ভিসা বের করে বাংলাদেশ থেকে বৈধ-অবৈধ পন্থায় বিপুল টাকার বিনিময়ে শ্রমিক নিয়ে যাচ্ছে। উল্লেখযোগ্য কিছু দালালের অপরাধমূলক কার্যক্রম তুলে ধরা হলোÑ
মেহেদী হাসান বিজন : ব্রুনাইয়ে শ্রমিক হিসেবে গিয়ে নামে-বেনামে ৫-৬টি কোম্পানি খুলেন তিনি। ২০১৭ সালে ব্রুনাই শ্রম উইংয়ে ১৩৫টি ভিসা সত্যায়নের জন্য দাখিল করেন। কিন্তু শ্রম উইং খোঁজ খবর নিয়ে দেখে প্রজেক্টে কোনো কাজকর্ম নেই। এটি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান। শ্রম উইং ভিসায় সত্যায়ন না দিলে পরবর্তীতে তিনি ‘বডি কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে এসব কর্মীকে ব্রুনাইয়ে নিয়ে যান।। চলতি বছর ৫ শ’ কর্মী ব্রুনাইয়ে নিয়ে যান তিনি। এদের মধ্যে দুই শতাধিক কর্মীই কাজ বা বেতন পাননি। এর মধ্যে মাসুদ মিয়া নামের (বিএম ০৮৯৫৯৩৮) একজন দুর্ঘটনার শিকার হলে ইন্স্যুরেন্স না থাকায় তাকে বিনা চিকিৎসায় জোরপূর্বক দেশে পাঠিয়ে দেয় এবং বাংলাদেশ হাইকমিশনে অভিযোগ করে। এছাড়া তার নেয়া কর্মীরা কাজ না পাওয়ায় ৮-১০ জন মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে ২ জনের অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ব্রুনাই আদালত ২ বছরের সাজা দেয়। অনেককে আবার ২ লাখ টাকা করে নিয়ে মালয়েশিয়া পাচার করে দেয় মেহেদী হাসান বিজন। অনেকের ভিসা আবার ব্রুনাই সরকার বাতিল করে দেয়ায় তারা বাংলাদেশে ফেরত আসে। এরই মধ্যে আবার বিজনের বিরুদ্ধে মালয়ে এক নারীর সম্ভ্রমহানির অভিযোগে মামলা হয়। মেহেদী হাসান বিজনের বিরুদ্ধে নানাবিধ অভিযোগ ও ভিসা জালিয়াতির কারণে তার সব কোম্পানি ব্রুনাই সরকার কালো তালিকাভুক্ত করে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ব্রুনাই ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাকে গ্রেফতার করে দেশে পাঠিয়ে দেয়।

আব্দুর রহিম : বিজনের মতো একই ধরনের অপরাধে জড়িত আব্দুর রহিম। তার নামসর্বস্ব কোম্পানিতে ‘বডি কন্ট্রাক্টের’ মাধ্যমে তিনি এক হাজারের বেশি কর্মী ব্রুনাইয়ে নিয়ে গেছেন। কিন্তু কোনো কাজ দিতে না পারায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন অনেকে। কারো কারো অন্য জায়গায় কাজ জুটলেও মাসে ৫০-১০০ ডলার করে দিতে হয় তাকে। ভিসা জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে ব্রুনাই সরকার আব্দুর রহিমের কোম্পানি কালো তালিকাভুক্ত করে। তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ হাইকমিশনে শতাধিক অভিযোগ রয়েছে এবং ব্রুনাই ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ এসব অভিযোগ তদন্ত করে তাকে আটক করে। আব্দুর রহিম বর্তমানে ব্রুনাই জেলখানায় রয়েছেন।

ইলিয়াছ মিয়া : তিনিও তার নামসর্বস্ব কোম্পানিতে ৩ শতাধিক শ্রমিক ‘বডি কন্ট্রাক্টে’ (অবৈধভাবে) ব্রুনাই নিয়ে যান। এসব শ্রমিকেরও একই অবস্থা। নানা অভিযোগে গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছেন তিনি।

শাহেদ আহমেদ মজুমদার : তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশী শ্রমিকদের নির্যাতন, অবৈধ পন্থায় ব্রুনাই ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্ট হতে ভিসা সংগ্রহ, হাইকমিশনের ভেতরে ব্রুনাইয়ের এক ব্যবসায়ীকে মারধর, ব্রুনাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডকুমেন্ট জালিয়াতি করে বিনা ভিসায় বাংলাদেশ থেকে শিল্পী নিয়ে যাওয়া, স্থানীয় নিয়োগকর্তার সিল স্বাক্ষর জাল করে ‘বডি কন্ট্রাক্টে’ লোক নেয়াসহ জাল জালিয়াতির বহু অভিযোগে অভিযুক্ত। তার পাসপোর্ট বাংলাদেশ সরকার বাতিল করেছে। গ্রেফতার এড়াতে তিনি মালয়েশিয়ায় পালিয়েছেন বলে জানা গেছে।
ইসমাইল সরদার : তিনিও ‘বডি কন্ট্রাক্টে ‘ ব্রুনাইতে তিন শতাধিক শ্রমিক নিয়ে গেছেন। প্রতারণার একই অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধেও। তার কোম্পানিগুলোও ব্রুনাই সরকার কালো তালিকাভূক্ত করেছে। তাকে গ্রেফতারে খুঁজছে ব্রুনাই পুলিশ। এ অবস্থায় পলাতক রয়েছেন তিনি।

সোহরাব খান : তিনি ‘বডি কন্ট্রাক্টে’ ব্রুনাইয়ে শ্রমিক নেন। তাদের অনেকে কাজ না পেয়ে সেদেশে ভিক্ষা করছেন । অনেকে আবার মাদক কাবরারে জড়িয়ে পড়েছেন। সোহরাবের মাধ্যমে অনেকে মালয়েশিয়ায়ও পাচার হয়েছেন। ব্রুনাই সরকার তাকে গ্রেফতার করে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে।
মো: সোহেল আহমেদ : তার বিরুদ্ধেও ‘বডি কন্ট্রাক্টে’ শ্রমিক নেয়া, ব্রুনাই লেবার ডিপার্টমেন্টের ডকুমেন্ট জালিয়াতিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। সেদেশের সরকার তাকেও গ্রেফতার করে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে।

সাইফুল ইসলাম : ভিসা ট্রেডিং ও ব্রুনাই থেকে শ্রমিকদের মালয়েশিয়ায় পাচারের অভিযোগ রয়েছে। গ্রেফতার এড়াতে সম্প্রতি তিনি দেশে পালিয়ে এসেছেন।
কামরুল হাছান : কাজ দিতে না পারলেও ‘বডি কন্ট্রাক্টে’ ৩-৪ লাখ টাকার বিনিময়ে ব্রুনাইয়ে শ্রমিক নিয়ে যান তিনি। তার কোম্পানিগুলো কালো তালিকাভুক্ত করেছে ব্রুনাই প্রশাসন। তিনি এখন পলাতক।

মো: মনির হোসেন : ‘বডি কন্ট্রাক্টে’ শ্রমিক নিয়ে কাজ না দেয়া এবং শ্রমিকদের সাথে নানা প্রতারণার অভিযোগে বাংলাদেশ হাইকমিশন তাকে ৯ হাজার ডলার জরিমানা করে। তিনি এতে ক্ষিপ্ত হয়ে শম উইংয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্রুনাই পুলিশের কাছে মামলা করেন। তবে পরবর্তীতে তার অপরাধ বিবেচনায় নিয়ে তাকে গ্রেফতার করে দেশে পাঠিয়ে দেয় ব্রুনাই পুলিশ।

মো: আসিফ : তার বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ ছাড়াও গাড়ির পার্টস চুরির অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগের সত্যতা মেলায় তাকেও গ্রেফতার করে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয় সম্প্রতি।

আব্দুল্লাহ আল মামুন (অপু) : ‘বডি কন্ট্রাক্টে’ কর্মী নেয়া, ভিসা জালিয়াতিসহ মানবপাচারের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তাছাড়া এক মালয় নারীর সম্ভ্রমহানির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ব্রুনাইয়ে মামলা চলমান রয়েছে। তাকে ব্রুনাই ইমিগ্রেশন পুলিশ গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের প্রক্রিয়া চলছে।

এছাড়া এম এ শফিক, জজ মিয়া, রাসেল আহমেদ ও মোহাম্মদ মুক্তারসহ সাম্প্রতিক সময়ে আরো কিছু বাংলাদেশী শ্রমিককে ভিসা জালিয়াতি ও মানব পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার হয়ে দেশে পাঠানো হয়েছে। এর বাইরে অনেকেই পালিয়ে আসছেন বলে জানা গেছে।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com