রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ অপরাহ্ন

এবার জ্ঞানবাপী মসজিদ নিয়ে ষড়যন্ত্র

মাসুম মুরাদাবাদী
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ২২ মে, ২০২১
  • ১৬৪ বার

বেনারসের জ্ঞানবাপী মসজিদের বিরুদ্ধে উগ্রপন্থীরা ষড়যন্ত্রের জাল এমনভাবে বিছানো শুরু করেছে, যেভাবে বাবরি মসজিদের বিরুদ্ধে বিছানো হয়েছিল। যার পরিণামে জুলুমের শিকার হয়ে তাকে শহীদ হতে হয়েছে। অথচ ভারতে এমন একটি আইন বিদ্যমান রয়েছে, যা ভারতের সব ধর্মীয় স্থানসমূহকে হুবহু স্বরূপে অস্তিত্ব রক্ষার নিশ্চয়তা দেয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এখন ওই আইনকেও সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো তাদের ঘৃণ্য উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, ভারতের আদালত ব্যবস্থার একটি অংশ এই উগ্রপন্থীদের সহযোগিতা করছে। অনুভব করা যাচ্ছে, জ্ঞানবাপী মসজিদ খনন করার নির্দেশদাতা সিভিল জজ ওই ধারারই একজন। এ কারণেই তিনি নিজের ক্ষমতার গণ্ডি অতিক্রম করে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে এ নির্দেশ দিয়েছেন যে, তারা যেন জ্ঞানবাপী মসজিদের ভিতের জমির নিচের অংশের সার্ভে করায়। এই সার্ভের উদ্দেশ্য এ তথ্য জানা যে, এ মসজিদটি কোনো মন্দির ভেঙে তৈরি করা হয়েছে কি না। প্রকাশ থাকে যে, এ ব্যাপারে দাখিলকৃত আরজিতে বলা হয়েছে, এ মসজিদ হিন্দুদের জমিতে নির্মিত। আদালত সেখানে তাদের পূজা করার ও নতুন করে মন্দির নির্মাণের অনুমতি প্রদান করুক। আবেদনকারী দাবি করেছে, এ মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে কাশি বিশ্বনাথ মন্দিরের একটি অংশ ভেঙে। আদালত প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ডাইরেক্টর জেনারেলকে এ ব্যাপারে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন, যেখানে প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

কোনো আদালত মালিকানা অধিকারের কোনো মামলায় কোনো স্থাপনাকে খনন করা ও তার ভূগর্ভস্থ অবস্থা জানার অধিকার রাখে কি না- এ আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ। এটা উপেক্ষা করে উল্লিখিত সিভিল জজ এমন এক মামলায় তার ক্ষমতার গণ্ডি পেরিয়ে রায় দিয়েছেন, যা হাইকোর্টে শুনানির প্রক্রিয়াধীন রয়েছে এবং এলাহাবাদ হাইকোর্ট তার ওপর শুনানি শেষ করে তার রায় প্রস্তুত রেখেছে। এ কারণেই সিভিল জজের নির্দেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে পিটিশন দাখিল করা হয়েছে। সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ডের আইনজীবী পুনিত কুমার গুপ্ত নিম্ন আদালতের রায় চ্যালেঞ্জ করে এ দলিল উপস্থাপন করেছেন যে, এ ব্যাপারে জেলা কোর্ট বেআইনিভাবে নির্দেশ জারি করেছেন। গত ১৫ মার্চ হাইকোর্টের বিচারপতি প্রকাশ পান্ডিয়া এর ওপর নিজের ফায়সালা দিয়ে দিয়েছেন। আর এ বিষয়টি নিম্ন আদালতের এখতিয়ারভুক্তই ছিল না। জ্ঞানবাপী মসজিদ ব্যবস্থাপনা কমিটিও বেনারসের নিম্ন আদালতের রায় এলাহাবাদ হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করেছে।

বাহ্যত বেনারসের সিভিল জজের রায় বিধিবদ্ধ আদালতের কার্যক্রমবিরোধী। আর এটা উচ্চ আদালতের ক্ষমতাকেও চ্যালেঞ্জ করে। এখানে বড় প্রশ্ন হচ্ছে- এমন একটা সময় যখন ভারতে চতুর্দিকে হাহাকার চলছে এবং করোনাভাইরাসের ধ্বংসলীলা পুরো দেশকে তছনছ করে দিচ্ছে, তখন এই মারাত্মক সঙ্কটময় মুহূর্তে বেনারসের সিভিল জজের সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানো এ রায় দেয়ার অর্থ কী? এটা বাহ্যত নিজস্ব বা রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। এ সময়ই উত্তর প্রদেশ থেকে এ খবরও এলো, যোগি সরকার বাবরি মসজিদ ধ্বংস ষড়যন্ত্র মামলার অপরাধীদের সসম্মানে মুক্তি প্রদানকারী বিচারক এস কে যাদবকে উত্তর প্রদেশের ডেপুটি লোকায়ুক্ত নিযুক্ত করা হয়েছে। এ ‘পুরস্কার’ সিবিআই’র বিশেষ আদালতের ওই বিচারককে দেয়া হয়েছে, যিনি বাবরি মসজিদ ধ্বংস ষড়যন্ত্র মামলার অপরাধীদের বিরুদ্ধে দাখিলকৃত সব প্রমাণাদিকে ‘যথেষ্ট নয়’ বলে জানিয়েছিলেন। গত বছর ৩০ সেপ্টেম্বর যাদব তার অবসরে যাওয়ার দিন ৩২ জন অপরাধীর সবাইকে মুক্তি দিয়ে দেন, যাদের বিরুদ্ধে জোরালো প্রমাণের ভিত্তিতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছিল। ওই অপরাধীর মধ্যে বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি, মুরলি মনোহর জোশি ও উমা ভারতীও শামিল ছিলেন। এখানে এ কথা বলা নিষ্প্রয়োজন যে, এর আগে সরকার বাবরি মসজিদের মালিকানার রায় রামমন্দিরের পক্ষে প্রদানকারী সুপ্রিম কোর্টের সাবেক চিফ জাস্টিস রঞ্জন গগৈকে রাজ্যসভার সদস্য বানিয়ে পুরস্কৃত করেছে। এটা ভিন্ন কথা যে, তিনি শপথ গ্রহণের পর এখন পর্যন্ত রাজ্যসভার কোনো কার্যক্রমে অংশগ্রহণও করেননি এবং কোনো প্রশ্নও উত্থাপন করেননি। এর কারণ হচ্ছে, তিনি ভবনে প্রবেশ করামাত্রই বিরোধীদের পক্ষ থেকে লজ্জা লজ্জা স্লোগান উচ্চারিত হতে থাকে।

উল্লেখ্য, সুপ্রিম কোর্ট রামমন্দিরের পক্ষে বাবরি মসজিদের মালিকানার রায় প্রকাশ করতে গিয়ে এমন কিছু কথা বলেছিলেন, যেগুলোকে ভবিষ্যতে এমন বিতর্ক থেকে বাঁচার উপমা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। সুপ্রিম কোর্টে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট বেঞ্চ তাদের রায়ে ১৯৯১ সালের ওই বিশেষ আইনের উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন, যেখানে বলা হয়েছে- ১৫ আগস্ট, ১৯৪৭ অর্থাৎ ভারতের স্বাধীনতার সময় যেসব ধর্মীয় উপাসনাস্থল যে অবস্থায় ছিল, তা সংরক্ষণ করতে হবে এবং সেগুলোর হুবহু অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হবে। ওই আইনের আওতা থেকে বাবরি মসজিদকে এ কারণে আলাদা রাখা হয়েছে যে, এ বিষয়ে আগে থেকেই বিতর্ক চলে আসছিল এবং মামলাটি নিয়ে আদালতে শুনানি চলছিল। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকরা তাদের রায়ে লিখেছেন, অন্য কোনো মামলা এ আইন থেকে আলাদা করার অধিকার নেই। আর এটা আইনিভাবে এবং সাংবিধানিকভাবেই সম্ভব নয়।’ এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা লিখেছেন, ‘পেছনের দিকে ফিরে না যাওয়া সংবিধানের মৌলিক নীতির অন্তর্ভুক্ত। আর সেকুলারিজমও এমনই এক নীতি।’ ভারতে তৎপর সাম্প্রদায়িক ও ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলো মুসলমানদের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য তাদের ইবাদতের স্থানগুলো তছনছ করার যে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে তার উদ্দেশ্য হলো মুসলমানদের মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হওয়ার অনুভূতি সৃষ্টি করা।

এ কারণেই একের পর এক মোগল যুগে নির্মিত ঐতিহাসিক মসজিদগুলোর নিচে মন্দির তালাশের ভয়ঙ্কর অভিযান শুরু করা হয়েছে। যে সময় এ কলাম লেখা হচ্ছে, সে সময় মথুরার শাহী ঈদগাহ ও আগ্রার জামে মসজিদের বিরুদ্ধেও জ্ঞানবাপী মসজিদের মতো আদালতে আর্জি পেশ করা হয়েছে। আর ওই সব মামলাতেও জ্ঞানবাপী মসজিদের মতো মাটির নিচে সার্ভে করানোর আবেদন করা হয়েছে। আবেদনকারী আদালতে ওই জমির বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের জন্য আবেদন করেছে, যেখানে মথুরার বিশাল শাহী ঈদগাহ দাঁড়িয়ে আছে। এর পাশাপাশি এ দাবিও করা হয়েছে, আগ্রায় অবস্থিত জাহানারা মসজিদের নিচে খনন করা হোক। যাতে জানা যায়, তার নিচে কী লুকিয়ে আছে। সিভিল জজ জিওতি সিংয়ের সামনে উপস্থাপিত আবেদনে বলা হয়েছে, মূর্তি অনুসন্ধানের জন্য ভূগর্ভ পর্যন্ত পৌঁছা জরুরি। এ কথা সবাই জানে যে, সাম্প্রদায়িক ইতিহাসবিদরা স্বাধীনতার পর ভারতে এমন এক মনগড়া ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, যার উদ্দেশ্য মুসলিম শাসনামলের প্রতিটি স্থাপনার নিচে একটি হিন্দু মন্দির প্রমাণ করা। কোনো রকম প্রমাণ ছাড়া লেখা ওই কাল্পনিক ইতিহাসের না কোনো ভিত্তি আছে, না আছে কোনো উদ্ধৃতি।

আসুন, আরো একবার অযোধ্যা বিবাদ সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের দিকে ফিরে যাই। সেখানে ধর্মীয় স্থানসমূহের সংরক্ষণ সম্পর্কিত আইনের উদ্ধৃতি দিয়ে এ বাস্তবতার ওপর জোর দেয়া হয়েছে যে, ‘বর্তমান বা ভবিষ্যতে দণ্ড দেয়ার জন্য কোনো অবস্থাতেই ইতিহাস বা তার ভুলকে ব্যবহার করা যাবে না।’ কিন্তু জুলুমপ্রিয় গোষ্ঠী ক্রমাগত এমন প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে যে, তারা দেশের ভেতর আবারো এমন ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িকতার পরিবেশ সৃষ্টি করবে, যার ফলে মানুষ তাদের মূল সমস্যার কথা ভুলে যাবে। এ পরিবেশ বিশেষভাবে আগামী বছর থেকে শুরু হতে যাওয়া অ্যাসেম্বলি নির্বাচনগুলোর কথা মাথায় রেখে সৃষ্টি করা হচ্ছে। কেন না, যোগি সরকারের থলেতে ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই নেই। তাই তারা আবারো জনগণকে মন্দির-মসজিদের রাজনীতিতে ফাঁসিয়ে দিয়ে তাদের ভোট লুটে নিতে চাচ্ছে।

(মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু নিউজ থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব)

ahmadimtiajdr@gmail.com

লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com