ঢাকার এক বুদ্ধিজীবী বন্ধুর সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ হচ্ছিল। তিনি আওয়ামী লীগের একজন অন্ধভক্ত। রোজই আমরা টেলিফোনে পরস্পরের কুশল জিজ্ঞাসা করি। আজও করলাম। তিনি বিষণ্ন কণ্ঠে জানালেন, শারীরিকভাবে ভালো আছি ভাই, কিন্তু মনের কষ্টে জর্জরিত। করোনা পরিস্থিতি রোজই ভয়াবহ থেকে ভয়াবহতর হচ্ছে। পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ আপনিও দেখেছেন। অনাহারে মৃত মানুষের লাশ রাজপথে পড়ে থাকত। সে অবস্থা এখনো হয়নি। হলে বিস্মিত হব না। দিনের পর দিন লকডাউনে থাকার ফলে কর্মহীন নিম্নধ্যবিত্তের কোমর ভেঙে গেছে। মধ্যবিত্তও বাঁচার উপায় দেখছে না। খেটে খাওয়া মজুর ও দিনমজুরের অবস্থা ভেবে দেখুন।
বন্ধু বললেন, ব্রিটিশ আমলের পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ ও মন্বন্তরে পঞ্চাশ লাখ লোক মারা গেছে। প্রতিটি মৃত্যুতে অসাধু ব্যবসায়ীরা হাজার টাকা মুনাফা করেছে। এ অসাধু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগসাজশ ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ গভর্নর স্যার জন হার্বাটেরও। তদন্তে তার দুর্নীতি ধরা পড়ার পর তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। ব্রিটিশ গভর্নরের বিবেক নাড়া দিয়েছিল। বর্তমান অসাধু ব্যবসায়ী এবং তাদের আমলা ও রাজনৈতিক পেট্রনদের কোনো বিবেক নেই। তারা এ মৃত্যু-মহামারির সময়েও দু’হাতে লুটপাট করে চলেছেন। কদাচিৎ কেউ ধরা পড়লে রাজনৈতিক লেবেলের জোরে রক্ষা পেয়ে যান। কাউকে বিবেক তাড়নায় আত্মহত্যা করতে হয় না।
মহাযুদ্ধকালীন বাংলা সন পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছিল বিদেশি সরকার। এবার করোনা মহামারি সৃষ্টি করেছে স্বয়ং প্রকৃতি। সরকার প্রাণপণে চেষ্টা করছে প্রকৃতির রুদ্র রোষ থেকে তার দেশের মানুষকে বাঁচাতে। দুঃখ হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য। কী অক্লান্ত পরিশ্রম করে, অনেক বাধা-বিঘ্ন পেরিয়ে দেশটাকে তিনি গড়ে তুলেছিলেন, বিরোধী লোকরা স্বীকার না করুক, তিনি গরিব মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছিলেন। কিন্তু প্রকৃতির ক্রোধ মুহূর্তেই সব তছনছ করে দিল। এখন শুধু মৃত্যু, মৃত্যু বাড়ছে। মহামারি থেকে মানুষকে বাঁচাতে যে কঠোর লকডাউন দেওয়া হচ্ছে, তাতে প্রাত্যহিক মৃত্যু সংখ্যা কমছে না, মানুষের দুর্গতি বাড়ছে। কর্মহীন মানুষ ঘরে বসে কাতরাচ্ছে ক্ষুধার জ্বালায়। তারা আইন ভেঙে ঘর থেকে বেরোচ্ছে।
পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষের সময় অবিভক্ত বাংলার সরকারপ্রধান ছিলেন খাজা নাজিমউদ্দীন, খাদ্য ও বেসামরিক সরবরাহ মন্ত্রী ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। সরকার সর্বত্র লঙ্গরখানা খুলেছিল ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য। তখন বিরোধী দলে ছিলেন ফজলুল হক। তিনি অন্য বিরোধী দলকে নিয়ে সর্বদলীয় খাদ্য কমিটি গঠন করেছেন। এ সর্বদলীয় কমিটি অবিভক্ত বঙ্গের বহু স্থানে অনাহারী মানুষের জন্য খাদ্য বিতরণের উদ্দেশ্যে বেসরকারি লঙ্গরখানা খুলেছিলেন। কংগ্রেস নেতা কিরণ শঙ্কর রায়, হিন্দু মহাসভার শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিসহ বহু নেতা এ সর্বদলীয় ফুড কমিটিতে ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টি তখন অবিভক্ত। তারা নিজস্ব লঙ্গরখানা খুলেছিলেন।
পঞ্চাশের অবস্থা থেকে বর্তমান অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং আরও ভয়াবহ। এ মহামারি এতই সংক্রামক যে, রোগীর সেবা দূরে থাকুক, তার কাছে যেতে নিকট আত্মীয়-স্বজনরা আতঙ্কবোধ করেন। কোটিপতি করোনা রোগীর লাশ ঘরে পড়ে রয়েছে। তার শেষ কৃত্য করার জন্য ছেলেমেয়েরাও এগিয়ে আসেনি। এ ধরনের একটি ক্রুর ও ভয়ংকর রোগের মোকাবিলায় মনে হয় কারোরই কিছু করার নেই। তবে কথাটা সম্পূর্ণ সত্য নয়, হাসিনা সরকার তাদের সাধ্যমতো রোগ-প্রতিরোধের জন্য কাজ করছে। সাধ্যের বাইরে গিয়েও করেছেন। পশ্চিমা দেশগুলো কঠোর স্বাস্থ্যবিধি এবং ততোধিক কঠোর লকডাউন দিয়ে পরিস্থিতি অনেকটা সামাল দিয়েছে। সম্পূর্ণ সামাল দিতে পারেনি। ব্রিটেনে এখনো লকডাউন রয়েছে। তুলে নেওয়া হবে ১৯ জুলাই তারিখে। আমেরিকা, ইতালি, জার্মানি, ভারতে করোনা বাংলাদেশের মতোই বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে করোনা গোড়ার দিকে পারেনি, এখন মৃত্যুর দীর্ঘ মিছিল তৈরি করে চলেছে। এ ব্যাপারে সরকারকে দোষ দেওয়ার আগে বাংলাদেশের হতভাগ্য মানুষের উচিত নিজেদের কপালকে দোষ দেওয়া।
দীর্ঘকালীন লকডাউনে গেলে কাজ করতে না পারার দরুন অনেকে রুটি-রুজির অভাবে মারা যাবেন। লকডাউন না মানলে করোনায় মরবেন। বাংলাদেশের মানুষ এখন রুজি-রুটি হারিয়ে মৃত্যুর মুখে। অন্যদিকে করোনা তাদের ছোবল মারছে। এ অধিক জনসংখ্যার দেশে সাধারণ মানুষকে আইন মানানো অসম্ভব। ঢাকার রাস্তায় যানবাহন ও লোকজনের ভিড় দেখে মনে হচ্ছে, লকডাউন তো কেউ মানছে না। মানছে অল্প কিছু লোক।
ব্রিটেনে ও ইউরোপে দীর্ঘ লকডাউনের সময় অসংখ্য বেসরকারি সাহায্য সংস্থা গড়ে উঠেছিল, যারা ফুড প্যাকেজ তৈরি করে অভাবীদের ঘরে ঘরে তা বিলি করেছিলেন। ভারতেও বেসরকারি পর্যায়ে খাদ্য বিলির ব্যবস্থা হয়েছিল, কিন্তু বাংলাদেশে এমন কিছু বড় ধরনের বেসরকারি পর্যায়ে হয়েছে বলে আমার জানা নেই। শেখ হাসিনা সরকারিভাবে এক বিরাটসংখ্যক অভাবী পরিবারের মধ্যে খাদ্য বিতরণের ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু করোনা এখন যেভাবে প্রতিটি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে বিপন্ন জনগোষ্ঠীকে রক্ষায় সরকারি প্রয়াস সাধ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
এ ক্ষেত্রে যত সামান্যই হোক, বেসরকারি প্রচেষ্টা যুক্ত হওয়া উচিত। দেশে ধনী ব্যক্তির অভাব নেই। এ করোনার মৃত্যু মিছিলের মধ্যেও নাইট ক্লাবে সুন্দরী ফিল্ম তারকা ধরে নিয়ে আমোদ-স্ফুর্তি করার মতো ধনী ব্যবসায়ীর যখন অভাব নেই, তখন দেশের বিপন্ন মানবতা রক্ষায় তাদের কাছ থেকে মোটা চাঁদা নিয়ে দুর্গত ত্রাণে মোটা তহবিল গঠন করা যেত। এটা পারতেন আমাদের সুশীল সমাজ। তারা ধনী নন, কিন্তু ধনী সমাজের সঙ্গে তাদের আত্মীয়তা রয়েছে। ড. কামাল হোসেন বা ড. ইউনূস উদ্যোগী হলে শুধু দেশের ধনীদের কাছ থেকে নয়, বিদেশের বড় বড় সওদাগর, রাজা-রানির কাছ থেকেও মোটা টাকা পাওয়া যেত। ড. ইউনূস এখন কোথায়? মনে হয় একেবারে নিখোঁজ মানুষ। দেশের মানুষের এত বড় বিপদে নোবেলজয়ী গরিবের বন্ধু কোথায় হারিয়ে গেলেন! এ সময় আলাদীনের রত্নগুহায় বসে দেশের মানুষের জন্য একটি বাণীও তো দিতে পারতেন। না, তিনি কোথায় হাওয়া হয়ে গেলেন।
করোনার এ বিপদের দিনগুলোতে হাওয়া হয়ে গিয়েছিলেন ড. কামাল হোসেনও। সহসা তার গলার আওয়াজ পাওয়া গেছে। বহুকাল পর ধ্যানমগ্ন যোগীর মতো তিনি ধ্যানভঙ্গ করেছেন, বলেছেন, ‘এ সরকার করোনা প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়েছে। বাজেট থেকে অর্থ কেটে সেই অর্থ করোনা প্রতিরোধে ব্যয় করা উচিত।’ সুশীল সমাজের নেতা হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে কথাটা বলেছেন। নইলে তিনি জানতেন, সরকার তার সাধ্যের বাইরে গিয়ে করোনা প্রতিরোধের চেষ্টা করছে। বিদেশের যেখানে পাওয়া যায়, সেখান থেকেই করোনার টিকা কিনছে, আগে ভারত থেকে টিকা এনেছে। এখন চীন থেকেও টিকা কিনছে। হাসপাতালগুলোর অক্সিজেন সংকট কাটাতে চেষ্টা করছে।
বাজেটের অন্য খাত থেকে কেটে এনে আর কত অর্থ পাওয়া যেত? তার চেয়ে বহুগুণ বেশি অর্থ ব্যয় করেছে সরকার করোনা প্রতিরোধে। হাসিনা সরকার করোনা প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়নি। সফল হয়েছে বলি না। সর্বশক্তি নিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। করোনার সমস্যাটা শুধু দেশের নয়, সারা বিশ্বের। বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে বাংলাদেশও এ বিশ্বদানবের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। প্রবল বন্যায়ও মানুষের পাশে ছিল হাসিনা সরকার। এখন বিপর্যয় যত বড় হয়ে থাকুক, সরকারের হাল যদি শেখ হাসিনার হাতে থাকে, তাহলে দেশ এ বিপর্যয়ও কাটিয়ে উঠবে এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। বর্তমানে করোনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রূপগঞ্জের অগ্নিকাণ্ড।
তবে প্রসঙ্গক্রমে একটি কথা বলতে পারি, হাসিনা সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের দুর্নীতি এখন প্রবাদে পরিণত হয়েছে। আরও কয়েকটি মন্ত্রকের মন্ত্রী প্রমাণ করেছেন, তারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ারও যোগ্য নন। এদের সরানো দরকার। মন্ত্রিসভায় বড় ধরনের রদবদল দরকার। এটি সব দেশের সরকার করে থাকে। সন্দেহ নেই, করোনা বাংলাদেশে একটি জাতীয় দুর্যোগ। দেশে গণতন্ত্রমনা বিরোধী দল থাকলে তাদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করে জাতীয় দুর্যোগ প্রতিরোধ করা যেত। তাতে জনগণের মনোবল বৃদ্ধি পেত। ব্রিটেনে নাৎসি হামলা চলাকালে চার্চিল সব গোঁয়ার্তুমি ত্যাগ করে বিরোধী লেবার ও লিবারেল দলকে নিয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছিলেন। এ জাতীয় সরকারের ডেপুটি প্রধানমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব দিয়েছিলেন বিরোধী লেবার পার্টির নেতা ক্লিমেন্ট এটলিকে। এমনকি মার্কসবাদী বিভানকেও তিনি মন্ত্রিসভায় নিয়েছিলেন।
আমাদের মতো দেশে এসব কথা লিখে লাভ নেই। আমাদের রাজনীতি এখনো সামন্তবাদী। গণতান্ত্রিক উদারতা তাতে নেই। শেখ হাসিনার কাছে আরজ করি, তিনি তার মন্ত্রিসভায় রদবদল ঘটান। অযোগ্য মন্ত্রিদের বাদ দিন। কিচেন কেবিনেটের একজন মারা গেছেন। আরেকজন বহাল তবিয়তে আছেন। তাকে দয়া করে দূরে রাখুন। মন্ত্রিসভার দলীয় চরিত্র বদলান। মহাজোটের চরিত্র ফিরিয়ে আনুন। সংগঠনেও রদবদল ঘটান। জাতীয় দুর্যোগকে জাতীয় মহাশক্তি দ্বারা রুখে দাঁড়ান। প্রথমেই দরকার এ রদবদল দ্বারা জাতির মনোবল ফিরিয়ে আনা। আমার পরামর্শ শেখ হাসিনা গ্রহণ না করুন, বলতে যে পারলাম এটাই আমার শান্তি।