শিশুর জন্য মায়ের দুধের বিকল্প কিছু নেই। এর শ্রেষ্ঠত্ব সর্বজনবিদিত। এটি এমন এক জিনিস, যার কোনো খারাপ দিক নেই। কিন্তু বুকের দুধ নিয়ে আমাদের রয়েছে নানা রকম ভুল ধারণা ও কুসংস্কার। ফলে মায়ের ওপর চলে আসে নানা রকম নিষেধাজ্ঞা। এই করবে না, ওইটা করা যাবে না। এটা খাবে না তো, ওটা ভালো না। ইত্যাদি। কোনো সমস্যা তো মায়ের দোষ, দুধের দোষ- এ ধারণা থেকে যেন বেরই হতে পারছি না আমরা। এ রকম কিছু ভুল ধারণা সবার সঙ্গে শেয়ার করছি এ লেখার মধ্য দিয়ে-
অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাবে বিশেষ করে নতুন মায়েরা এমনিতে উদ্বিগ্ন ও অস্থির থাকেন। বাচ্চা একটু কান্না করলেই মনে হয়, সন্তান বুঝি ঠিকমতো দুধ পাচ্ছে না। আসলে তা ঠিক নয়। ক্ষুধা ছাড়াও কান্না করার অনেক কারণ রয়েছে। শুধু খেয়াল রাখুন, ওজন বাড়ছে কিনা আর দিন-রাত মিলিয়ে ছয়বার বা তার বেশি প্রস্রাব করে কিনা।
‘শালদুধ খাওয়ানো উচিত নয়। এটা ফেলে দিতে হবে’- এমন প্রচলিত কুসংস্কার খুবই ভয়ঙ্কর। আসলে শালদুধ হলো শিশুর প্রথম খাবার এবং প্রথম টিকা। এতে প্রচুর প্রোটিন ও ভিটামিন থাকে। আছে এমন সব উপাদান, যা রোগ জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, শিশুর মস্তিষ্ক গঠন ও বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
বুকের দুধ না দিয়ে মধু, মিছরির পানি, শরবত বা গ্লুকোজের পানি দেওয়া বিপজ্জনক। এতে শিশুর ইনফেকশন হওয়ার আশঙ্কা বহুগুণ বেড়ে যায়। আদর্শ কাজ হলো- যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এবং অবশ্যই এক ঘণ্টার আগে বুকের দুধ খাওয়ানো।
অনেকেই মনে করে, মা ঝাল-মসলা দিয়ে খাবার খেলে শিশুর নাকি পেটব্যথা হবে, গ্যাস হবে। আবার অনেকের ধারণা, ঘি ও সুজি খেলে মায়ের বুকে বেশি দুধ হবে, তবে ডাল, মটরশুঁটি জাতীয় খাবার চলবে না-এ ধারণার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। মা ঝাল-মসলা, চায়নিজ-দেশি- যে কোনো খাবারই খেতে পারেন। কাজেই পছন্দসই খাবার না দিয়ে মাকে দুর্বল করবেন না। কারণ দুর্বল মা শিশুকে প্রয়োজনীয় পরিমাণ দুধ দিতে অসমর্থ হবে। ফল শিশুর নানা রকম সমস্যা তৈরি হওয়া।
‘মায়ের বুকের দুধের সঙ্গে উপরি, আলগা, তোলা দুধ কিংবা সুজি বা এই জাতীয় খাবার দিলে শিশুর পুষ্টি ও স্বাস্থ্য ভালো হবে’- এমন ধারণা রয়েছে অনেকের। আসলে মায়ের বুকের দুধ এমন এক সুষম খাদ্য, যা প্রথম ছয় মাস খাওয়ালে সে সময়ে অন্য কোনো খাবার, পানীয়, মধু, চালের গুঁড়ো, সুজি, চিনির পানি, এমনকি সাধারণ পানি- কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই। বিদেশি নামিদামি বেবি ফুড খেলে শিশুর পুষ্টি বেশি হবে এমন অপধারণাও কাউকে কাউকে প্রলুব্ধ করে।
অনেকে মনে করেন, সিজারিয়ান অপারেশন করালে বুকের দুধ দেওয়া যাবে না। এটাও ভুল ধারণা। অপারেশনের পর পোস্ট অপারেটিভ রুমে নিয়ে গিয়ে শিশুকে সহজেই বুকের দুধ খাওয়ানো যায় এবং সেটাই উচিত কাজ। বুকে দুধ কম এলে অনেক ক্ষেত্রে মাকে ‘অপয়া’ হিসেবে অপবাদ দেওয়া হয়। এমন অপবাদে মা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং এ মানসিক সমস্যাই মায়ের বুকে দুধ না আসার গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এ ক্ষেত্রে মা এবং পরিবারের সবাইকে মনে রাখতে হবে, সন্তান জন্মগ্রহণের পর দুধ আসা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এবং মায়ের পুষ্টি যদি নিশ্চিত করা যায়, তা হলে দুধ আসবে। অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম ও মানসিক অশান্তি মায়ের বুকের দুধ তৈরি প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে। অনেক মা বুকের সৌন্দর্য নষ্ট হওয়ার ভয়ে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে চান না। অথচ পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য হলো মায়ের কোলে শিশুর হাসি। অযথা এই চিন্তা আপনার শিশুর হাসি কেড়ে নিতে পারে। স্তন ক্যানসারের ভয় রয়েছে অনেক মায়ের। আসল সত্য হলো, শিশুকে বুকের দুখ খাওয়ালে স্তন এবং সারভাইকাল (জরায়ুমুখ) ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা অনেকাংশে কমে যায়। নবজাতক অনেক সময় ঘনঘন, অল্প অল্প পায়খানা করে যা স্বাভাবিক ঘটনা। কেউ কেউ রয়েছেন, যারা একে ডায়রিয়া বলেন। আবার সত্যি সত্যি শিশুর ডায়রিয়া হলেও তারা মায়ের দুধ খাওয়ানোকে দায়ী করেন।
অনেক সময় দুধ স্তনে জমে শক্ত হয়ে যায়, প্রচ- ব্যথা হয়। অনেকে দুধে বাতাস লাগা বা হাওয়া লাগা কিংবা হাও লাগাও বলেন, ঝাড়-ফুঁক, কবিরাজি করান। মাটির প্রলেপ লাগাতে দেখা যায় অনেক এলাকায়। অন্ধ কুসংস্কার। বুকের দুধ গেলে বের করে দিলে বেশিরভাগ সময় এ সমস্যার সহজ সমাধান হয়ে যায়।
অনেক মা হেপাটাইটিস-বি পজিটিভ। কেউ কেউ ডায়াবেটিসে ভুগছেন। অনেকেই এদের ক্ষেত্রে বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করে দেন। ধারনা এই যে, শিশুরও জন্ডিস হবে, ডায়াবেটিস হবে। এটাও একটা বড় ভুল। শুধু মায়ের বুকের দুধ খাওয়ালে এ রোগ মা থেকে শিশুর আক্রান্ত হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। বরং বুকের দুধের সঙ্গে অন্য কিছু খাওয়ালে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। মায়ের জ্বর, কাশি, সর্দি, ডায়রিয়া, অ্যালার্জিসহ সব সাধারণ অসুখেও বুকের দুধ খাওয়াতে পারবে। বুকের দুধের মাধ্যমে এসব রোগ মা থেকে শিশুর আক্রান্ত হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। ‘ফিডারে কৌটার দুধ খাওয়ালে শিশু ভালো খায়’- এ কথা প্রায়ই শুনতে হয়। কথা সত্য। কারণ কৌটার দুধ খেতে বুকের দুধের চেয়ে সুস্বাদু আর ফিডারের নিপল দিয়ে খাওয়া অনেক সহজ। কিন্তু এর ফলে শিশু আর বুকের দুধ চোষে না, যা মায়ের বুকের দুধ তৈরি কমিয়ে বা বন্ধ করে দেয়।
খুঁজলে এ রকম আরও অনেক পাওয়া যাবে। আমাদের এসব ভুল ও বুকের দুধবিরোধী ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং শিশুকে প্রথম ছমাস শুধু বুকের দুধ খাওয়াতে হবে।
লেখক : নবজাতক ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ