তালেবান গত ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর থেকেই যে অনেক প্রশ্ন দেশটির সাধারণ মানুষের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম নারীর অধিকার। শরিয়াহ আইনের দোহাই দিয়ে তালেবানের গত শাসনামলে আফগানিস্তানের নারীদের যেভাবে অবদমন নির্যাতন চলেছে তাতে এই প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক। আগের অভিজ্ঞতা থেকে দেশটির অনেকেই বলছেন, এবারও তালেবান শাসনে আফগান নারী ও শিশুদের চরম মূল্য দিতে হতে পারে। বিশেষ করে নারীশিক্ষা, তাদের কর্মসংস্থান ও চলাফেরার ওপর আবারও হয়তো কট্টরপন্থিতার কোপ পড়তে যাচ্ছে।
যদিও এবার ক্ষমতা নিয়েই তালেবান ঘোষণা করেছে, আফগানিস্তানে এখন থেকে নারী অধিকার রক্ষা করা হবে। নারীরা শরিয়াহ আইন মেনে যে কোনো চাকরি করতে পারবে। শিক্ষার জন্য তারা যেতে পারবে স্কুল-কলেজেও। শুধু ছেলে মেয়ে একসঙ্গে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারবে না। কিন্তু তালেবানের গত কিছুদিনের কার্যক্রমে তাদের এই ঘোষণা যেন কেবল কথার কথাই হয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যে আফগানিস্তানে অনেক নারী তালেবানদের দ্বারা হত্যা আক্রমণের শিকার হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। এমনকি কঠোরভাবে দমন করা হয়েছে নারীদের মিছিলও।
বিবিসির তথ্যানুযায়ী, গত শনিবারই আফগানিস্তানের মধ্যাঞ্চলীয় ঘোর প্রদেশের ফিরোজকোহতে বানু নেগার নামে এক অন্তঃসত্ত্বা পুলিশ সদস্যকে সন্তান ও স্বজনদের সামনেই গুলি করে হত্যা করেছে তালেবান। এ নিয়ে কথা বললে প্রতিহিংসার শিকার হওয়ার ভয়ে স্থানীয় কেউ মুখ খুলছেন না। তবে নিহতের পরিবারের মাধ্যমে বিবিসির হাতে আসা ছবিতে দেখা গেছে, বানু নেগারের বাড়ির এক কক্ষে দেয়ালে রক্ত ছড়িয়ে আছে। রক্তাক্ত মরদেহের মুখও ক্ষতবিক্ষত। আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা বানু নেগার ঘোর প্রদেশের একটি কারাগারে নিয়োজিত ছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে তালেবান ক্ষমতা নেওয়ার পর কারামুক্ত হওয়া তাদের সদস্যরা এই খুন করেছে। বিবিসি তালেবান কর্তৃপক্ষের কাছে এই ঘটনার ব্যাপারে মন্তব্য জানতে চাইলে তারা তদন্ত হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
দেশটির আরও অনেক জায়গায় নারীরা তালেবান যোদ্ধাদের প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। রাজধানী কাবুলসহ বিভিন্ন শহরের রাস্তায় একাকী কোন নারী দেখলেই তাদের থামিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, পুরুষ সঙ্গীবিহীন কেন সে রাস্তায় বেরিয়েছে। খোদ কাবুলে হামলা হয়েছে নারী বিচারকদের ওপরেও। বিবিসি জানায়, গত রবিবার শহরের একটি বাস স্ট্যান্ডের কাছে বন্দুকধারীদের হামলায় ২ নারী বিচারক নিহত ও দুইজন আহত হয়েছে। রয়টার্স বলছে, আফগানিস্তানের নারী বিচারকরা এককালে যাদের কারাদ- দিয়েছিলেন, কাবুল পতনের পর তালেবানের হাতে মুক্ত হয়ে এখন প্রতিশোধের নেশায় ঘুরছেন সেই বন্দিরা। জীবনের ভয়ে দেশটির আড়াইশ নারী বিচারকের কেউ কেউ এরই মধ্যে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। ইউরোপে পালানো এক নারী বিচারক বলেন, এখন তালেবান দেশজুড়ে বন্দিদের মুক্তি দিয়েছে। যেটা নারী বিচাররকদের জীবনকে বিপদের মধ্যে ফেলেছে। কাবুলে আমার বাসায় তালেবান এসে জিজ্ঞেস করেছিল : আমি কোথায়? এদেরকেই আমি কারাদ- দিয়েছিলাম।
এর আগে গত রবিবার কাবুলে নিজেদের অধিকারের পক্ষে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন বহু নারী। কিন্তু কাঁদানে গ্যাস ও পিপার স্প্রে ছুড়ে সে মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে তালেবান। গ্রেপ্তারও করা হয়েছে বেশ কয়েকজন নারীকে। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া নারীরা জানান, তালেবান তাদের মাথায় বন্দুক দিয়ে আঘাত করেছে। তাদের হামলায় অনেকে রক্তাক্ত হন।
তালেবান শাসনে তোপের মুখে পড়েছেন দেশটির নারী সাংবাদিকরাও। ইতিমধ্যে অনেক নারী সাংবাদিক প্রাণে বাঁচতে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার উইদাউট বর্ডার্স গত বুধবার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আফগানিস্তানে ২০২০ সাল পর্যন্ত নারী সাংবাদিকের সংখ্যা ছিল ৭০০ জন। সেই সংখ্যা কমতে কমতে বর্তমানে ৩৯ জনে এসে ঠেকেছে। সম্প্রতি শীর্ষ এক তালেবান নেতাকে নারী অধিকার নিয়ে প্রশ্ন করা সাংবাদিক বেহেস্তা আরঘান্দ প্রাণ ভয়ে কাতার পালিয়েছেন বলে খবর এসেছে। বেহেস্তার সঙ্গে তার পরিবারও রয়েছে। তবে আগামী দিনে দেশে ফিরতে পারবেন, সেই আশাতেই রয়েছেন তিনি।