নির্বাচন কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সরকারবিরোধী দলগুলোর জোটের দীর্ঘদিন রাজপথের কোনো কর্মসূচি নেই। তাদের অবস্থান অনেকটা এ রকম- নির্বাচন নেই তো তৎপরতাও নেই। বড়-ছোট বিভিন্ন দলের সমন্বয়ে সরকারবিরোধী কয়েকটি জোট তৈরি হলেও নির্বাচনের পর সেগুলো এখন রয়েছে শুধু কাগজেকলমে। নিষ্ক্রিয় থাকার কারণে দেশের অন্যতম বৃহৎ দল বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের অধিকাংশ শরিক দল দুটি অংশে বিভক্ত। একই নামে পৃথক দলও গঠন করেছে তারা। এর এক অংশ বিএনপির সঙ্গে, আরেক অংশ ঘোষণা দিয়ে জোট ত্যাগ করেছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন আরেক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও নামে আছে, কাজে নেই।
ঐক্যফ্রন্টের শরিক গণফোরামও দুই অংশে বিভক্ত। দুই অংশের নেতাকর্মীরা আলাদাভাবে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। জোটের কোনো তৎপরতা থাকায় ২০১৯ সালের ৮ জুলাই ঐক্যফ্রন্ট থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বের হয়ে যায় বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। জোট নিয়ে চুপ রয়েছে অন্য দুই শরিক জেএসডি ও নাগরিক ঐক্য। বর্তমানে নিজস্বভাবে বিভিন্ন ইস্যুতে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে রয়েছেন নাগরিক ঐক্যের শীর্ষ নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না। বাম ঘরানার কয়েকটি জোটকে ছোট আকারে রাজপথে দেখা গেলেও এখন তাদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে ঢিলেঢালা ভাব। বাকি জোটগুলো শুধু সংবাদ বিজ্ঞপ্তির বৃত্তে বন্দি।
গত একাদশ নির্বাচনের সময় নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত দল মিলে গঠিত হয়েছিল কয়েকটি সরকারবিরোধী জোট। বিএনপি-গণফোরামের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, সিপিবি-বাসদের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক বাম জোট ছাড়াও গঠিত হয়েছিল ছোট-বড় আরও কয়েকটি জোট। বিএনপির নেতৃত্বে ২০-দলীয় জোট আগে থেকেই ছিল। এ জোটের প্রধান দল বিএনপি এখন কঠিন সময় পার করছে। জোটটি রয়েছে কাগজেকলমে। বিএনপির সাংগঠনিক দুরবস্থার কারণে তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না জোটের শরিকরা। ফলে জোটের অন্যতম শরিক অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) নিশ্চুপ রয়েছে অনেক দিন। আর ঘোষণা দিয়ে ২০১৯ সালের ৭ মে জোট ত্যাগ করে আন্দালিব রহমান পার্থের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)।
একাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নানা নাটকীয়তা শেষে গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি, গণফোরাম, নাগরিক ঐক্য, জেএসডি ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। জোটটি বেশ সাড়া ফেলে রাজনৈতিক অঙ্গনে। নির্বাচনে অংশ নিয়ে ভরাডুবির কবলে পড়ে জোটটি। পরে এ জোটের ৭টি আসনে নির্বাচিতদের সংসদে যাওয়া, বিএনপির সঙ্গে ২০-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নে দেখা দেয় মতানৈক্য। পুনর্নির্বাচনের দাবি নিয়ে রাজপথে
কঠোর আন্দোলন বা আন্তর্জাতিক মহল থেকে কোনো চাপও সৃষ্টি করতে পারেনি ঐক্যফ্রন্ট। পুনর্নির্বাচনের দাবিতে বারবার কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে তা সফল করতে পারেনি জোটটি। ফলে জোটের ওপর আস্থা হারান বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও।
এ প্রসঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, আমাদের কারও কারও ক্ষমতায় যাওয়ার দিবাস্বপ্ন ছিল। স্বপ্নটা যখন ভেঙে গেছে, তখন জাগ্রত হয়ে, সোজা হয়ে সত্যটা দেখব এ রকম না অন্তর্দৃষ্টি ছিল, না দেখার মতো মন ছিল; বরং তারা ক্ষমতায় যেতে পারলাম না এই আশাভঙ্গের কারণে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। এ কারণেই নির্বাচন-পরবর্তীতে কোনো আন্দোলন হয়নি।
স্টিয়ারিং কমিটির আরেক সদস্য ও গণফোরামের একাংশের নেতা সুব্রত চৌধুরী বলেন, শরিকরা এখন নিজেদের দল গোছাতে ব্যস্ত। আর ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষনেতা ড. কামাল হোসেন ও আ স ম রব অসুস্থ। এছাড়া দীর্ঘদিন করোনার প্রকোপে বন্ধ ছিল রাজনৈতিক কর্মকা-। তাই আমরা বৈঠক করতে পারিনি কিছুদিন। তবে আমাদের মধ্যে বিভিন্নভাবে আলাপ-আলোচনা চলছে।
বিএনপি সূত্রে জানা যায়, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের বাস্তবতা ছিল একাদশ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। তবে নির্বাচনের পর জোটটি নিয়ে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন পরিক্রমায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটটি ১৮ দলীয় জোট হয়ে এখন ২০-দলীয় জোটে রূপান্তরিত হয়েছে। নতুন করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ ১৮ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে গত বছরের ২৭ জুন জাতীয় মুক্তি মঞ্চ নামে নতুন সংগঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন এলডিপির সভাপতি অলি আহমদ।
এই মঞ্চে ২০-দলীয় জোটের শরিক কল্যাণ পার্টি, জাগপা, খেলাফত মজলিসের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। এই মঞ্চ গঠনের পর বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় কর্নেল অলির। এ মঞ্চ করায় এলডিপি থেকে বড় একটি অংশ বের হয়ে যায়। এ অংশের নেতৃত্বে রয়েছেন সাবেক হুইপ, সাবেক বিএনপি নেতা আবদুল করিম আব্বাসী ও শাহাদত হোসেন সেলিম। অলির নেতৃত্বাধীন এলডিপির নেতাদের অভিযোগ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সংসদে যোগদানের মধ্য দিয়ে বিএনপির নেতারা কার্যত বিরোধী দলের মর্যাদা হারিয়েছেন। ২০-দলীয় জোটের সঙ্গে শুরু থেকেই আছে খেলাফত মজলিস। দলটির একজন সিনিয়র নেতা বলেন, জোট তো হয় নির্বাচনকেন্দ্রিক। আমাদের দেশে নির্বাচনের পরও জোট ক্রিয়াশীল থাকে। কিন্তু এর কোনো কারণ নেই। দুনিয়াব্যাপী যে জোট হয়, তা নির্বাচনকেন্দ্রিই হয়। বাংলাদেশে জোটের একটা বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। তবে এখন যে ২০-দলীয় জোট আছে, সেটার কার্যক্রম নেই।
বাম গণতান্ত্রিক জোট ক্ষুদ্র আকারে সক্রিয় রয়েছে রাজনীতির মাঠে। বিভিন্ন ইস্যুতে নিয়মিতভাবে কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে সক্রিয় জোটটি। এ জোটের শীর্ষ নেতা গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, বামপন্থিদের নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। শাসকশ্রেণির বাধা, লুটপাটের রাজনীতি, স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা বাম আন্দোলন বিকাশের প্রধান বাধা। এরপরও জনগণের কাছে বিকল্প শক্তি হিসেবে দাঁড়ানোর জন্য বামপন্থিরা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে ধীরে ধীরে।