২০০১ সালের ১ অক্টোবর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। দলের নেতারা মনে করেন, ওই নির্বাচনের পর দেশে আর অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। তাই ওইদিনকে ‘উপলক্ষ’ হিসেবে ধরে নির্দলীয় সরকারের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি আলোচনা করতে যাচ্ছে দলটি। এর মাধ্যমে নিরপেক্ষ সরকারের গুরুত্বটা জাতির সামনে তুলে ধরবেন দলের নীতিনির্ধারকরা। তারা বলছেন, এটিই হবে নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিতে প্রথম র্কসূচি; এর পর ধাপে ধাপে আরও কর্মসূচি আসবে।
দলের নেতারা বলছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যাতে নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করা যায়, তা-ই একমাত্র ভাবনা। এ লক্ষ্যে কর্মপন্থা ঠিক করতে একের একের বৈঠক করছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ নীতিনির্ধারকরা। কর্মপন্থা চূড়ান্ত করার পর পরিস্থিতি বুঝে রাজপথে আন্দোলন কর্মসূচি দেবেন তারা। এ লক্ষ্যে ঘরোয়াভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সমাজের বিশিষ্টজন সঙ্গে নিয়ে সভা-সেমিনার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। গত শনিবার দলের নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির
ভার্চুয়াল বৈঠকেও এই নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এজন্য আগামী ১ অক্টোবর সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনটি বেছে নিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। ২০০১ সালের ওইদিন নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে বিএনপি।
গতকাল রবিবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০১ সালের ১ অক্টোবর বাংলাদেশে সর্বশেষ নিরপেক্ষ ও জনগণের অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই দিবসটি নির্বাচনকালীন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আবশ্যকতাকে তুলে ধরার জন্য আগামী ১ অক্টোবর প্রেসক্লাবের মিলনায়তনে একটি আলোচনাসভা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।’
দলটির একাধিক নেতা জানান, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার দাবিটি শুধু বিএনপির দাবির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবীদের মাঝেও ছড়িয়ে দিতে চায় দলটি। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলনে যাওয়ার বার্তা দিয়ে এরই মধ্যে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির দুই দফায় ছয়দিন ধরে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছে দলটি।
গতকাল শনিবার স্থায়ী কমিটির বৈঠকে জাতীয় নির্বাহী কমিটি, বিভিন্ন জেলার সভাপতি ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাদের মতামত নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়েছে। পরে সিরিজ বৈঠকের নেতাদের দেওয়া মতামতের একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করতে মহাসচিবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, ‘সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাহী কমিটির ধারাবাহিক মতবিনিময় সভায় সদস্যদের মতামতের সারসংক্ষেপ আগামী জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভায় উপস্থাপনের জন্য মহাসচিবকে অনুরোধ করা হয়।’
স্থায়ী কমিটির বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার দাবিতে বিএনপি দেশের পেশাজীবীদেরও মতামত নেবে। এ লক্ষ্যে আগামী ৮ অক্টোবর বিভিন্ন পেশার নেতার সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মতবিনিময় করবেন। এই মতবিনিময়ের আগে কাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টায় গুলশান চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আইনজীবীদের সঙ্গেও তারেক রহমান মতবিনিময় করবেন। এ ছাড়াও ২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় পেশাজীবী সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবে বিএনপি। এসব অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব ও স্থায়ী কমিটির নেতারা অংশ নেবেন।
এদিকে সিরিজ বৈঠকের পর থেকে দলীয় নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন। নেতাকর্মীদের এই উজ্জীবিত ধারা ধরে রাখতে চান নীতিনির্ধারকরা। সে লক্ষ্যে দলের সিনিয়র নেতাদের সারাদেশ সফরে পাঠানোর চিন্তা করা হচ্ছে। পাশাপাশি অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদেরও জেলা সফরের কথা ভাবা হচ্ছে।
দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা বলেন, বিএনপি নেতারা বিভিন্ন সময়ে দেশের বিভিন্ন জেলা সফর করলেও অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সভাপতি- সাধারণ সম্পাদকরা সেদিক থেকে পিছিয়ে আছেন। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করতে হলে এসব নেতার তৃণমূল সফল জরুরি হয়ে পড়েছে। শুধু তা-ই নয়, দলের সর্বত্র শৃঙ্খলা ও ঐক্য ফেরানোর ওপর গুরুত্বরোপ করা হয়েছে।
দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা মনে করেন, চূড়ান্ত আন্দোলনে নামার আগে দলের পুনর্গঠন কাজ শেষ করতে হবে। এর পর প্রতিটি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনকে জনগণের স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে একযোগে রাজপথে নামতে হবে। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনকেই আন্দোলনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বিশেষ করে, ছাত্রদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে ছাত্রদলকে ক্যাম্পাসে কর্মসূচি করতে হবে। এসব করা না গেলে কোনো আন্দোলনই সফল হবে না। কারণ সব সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। বিগত দিনে ছাত্র, শ্রমিক ও যুবকরাই আন্দোলনের পরিবেশ তৈরি করেছে।
দলের এক ভাইস চেয়ারম্যান আমাদের সময়কে বলেন, আন্দোলন সফল করতে সাংগঠনিক শক্তি ও দলের নেতাকর্মীদের ইচ্ছা উভয়ই থাকতে হবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক দেশ ও সংস্থাগুলোরও সমর্থন আদায় করতে হবে। বৈশ্বিক রাজনীতির দিকে খেয়াল রেখে পরিকল্পনা করতে হবে। প্রতিটি দেশের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে দলের সিনিয়র ও তরুণ নেতাদের সমন্বয়ে পৃথক ডেস্ক থাকতে হবে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে বিষয়টি দেখভাল করতে হবে। দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা জানান, আন্দোলন সফল না হলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও এই সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে। সেই নির্বাচনের ফলও ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতোই হবে। এটা হলে বিএনপির টিকে থাকা কঠিন হবে। এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘আমরা দীর্ঘকাল যদি ভালো থাকতে চাই, দেশের জনগণকে মুক্ত করতে চাই- স্বল্প সময়ের জন্য একটা মরণকামড় দিতে হবে। দেশপ্রেম জাগ্রত করে গণআন্দোলন সৃষ্টির মাধ্যমে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে সকলকে প্রস্তুতি নিতে হবে।’