ঢাকা শহরের যান চলাচলে শৃঙ্খলা ফেরাতে নেওয়া হয় ৫২ কোটি টাকার প্রকল্প। এ প্রকল্পের পুরো টাকাই এখন জলে যাওয়ার উপক্রম। প্রথমে ঘটে সার্ভার কম্পিউটার ও সফটওয়্যার চুরির ঘটনা। এখন কাটা পড়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ট্রাফিক সিগন্যালকে সার্ভারের সঙ্গে যুক্ত করা তার। সম্প্রতি সিটি করপোরেশনের উচ্ছেদ অভিযানে ওই তার কাটা পড়েছে। গত বছর চুরি হওয়া পৌনে তিন কোটি টাকা দামের সার্ভার কম্পিউটার ও বিশেষায়িত সফটওয়্যারের হদিস এখনো মেলেনি।
সর্বশেষ খবর সার্ভার কম্পিউটার আবার কেনা হলেও এখনো সফটওয়্যার ‘কাস্টমাইজ ও কনফিগার’ করে ইনস্টল করা হয়নি। জাপানের কারিগরি দল আইটিএস সংযোজন করছে। কিন্তু প্রযুক্তি হস্তান্তর না হওয়ায় বাংলাদেশে দক্ষ জনবলও নেই। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, পুরো টাকাই জলে যাওয়ার উপক্রম।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) চার ট্রাফিক বিভাগের হিসাবে রাজধানীতে ব্যস্ত মোড়ের সংখ্যা ৬২। সেখানে মাত্র চারটিতে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার সিগন্যাল স্থাপন করে যানজট নিরসন কতটা সম্ভব তা নিয়ে প্রকল্পের শুরুতেই প্রশ্ন তুলেছিল ডিএমপি। পুরো টাকা জলে যাচ্ছে কিনা- এ প্রশ্নে ডিটিসিএ বলছে, চারটি আইটিএস স্থাপন করা হচ্ছে সমীক্ষার অংশ হিসেবে। সফল হলে সব মোড়ে একই রকম সিগন্যাল বসবে।
রাজধানীর সড়কে ট্রাফিক সিগন্যাল থাকলেও তা কার্যকর নয়। ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারায় চলে যানবাহন। ২০০২ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বিশ^ব্যাংকের অর্থায়নে ৭০টি মোড়ে সিগন্যাল বাতি স্থাপন করা হলেও সেসব টেকেনি। ২০১৫ সালে বনানী থেকে মৎস্য ভবন পর্যন্ত ১১ পয়েন্টে সিগন্যাল বাতিতে গাড়ি চালানোর চেষ্টাকালে তীব্র যানজট দেখা দেয়। ফলে মাত্র ছয় ঘণ্টার মাথায় ভন্ডুল হয় সেই প্রচেষ্টা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৫ সালে ৩৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘ঢাকা ইন্টিগ্রেটেড ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট’ প্রকল্প নেওয়া হয়। পরে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫২ কোটি ৮ লাখ টাকায়। এ প্রকল্পে ১৮ কোটি টাকা ৮৬ লাখ টাকা ঋণ দিচ্ছে জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা (জাইকা)। বাকি টাকা বাংলাদেশের। প্রকল্পটি ২০১৮ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে দুই দফা সময় বাড়ে। গত জুনে কাজ শেষের লক্ষ্যও পূরণ হয়নি।
প্রকল্পের আওতায় ২০১৯ সালে গুলশান-১, মহাখালী, পল্টন ও ফুলবাড়িয়া (গুলিস্তান) মোড়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ট্রাফিক সিগন্যাল বা আইটিএসের যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে। এর জন্য বিশেষায়িত তারের সংযোগ, পোল ও বাতি স্থাপন করা হয়েছে। আড়াই বছর ধরে সেগুলো বেকার পড়ে আছে। চলতি মাসে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরশেনের ডিশ এবং ইন্টারনেটের তারের জঞ্জাল অপসারণ অভিযানে মহাখালী ও গুলশানের আইটিএসের সংযোগ তার কাটা পড়েছে। পল্টনে তার কাটা পড়েছে মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজে।
বিদ্যমান ট্রাফিক সিগন্যালে নির্ধারিত সময়ে লাল-সবুজ-হলুদ বাতি জ্বলে। কিন্তু আইটিএস সিগন্যাল এলাকার ২৫০ মিটারের মধ্যে থাকা গাড়ির সংখ্যা উচ্চ রেজ্যুলেশনে তোলা ছবি সংযুক্ত কম্পিউটারে বিশ্লেষণ করে গুনতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে নির্ধারিত সময়ে নয়, গাড়ির সংখ্যা ও ঘনত্বের ভিত্তিতে লাল-সবুজ-হলুদ বাতি জ্বালায়, রাস্তা বন্ধ করে। মোড়ের এক পাশের রাস্তার যানবাহন পার হওয়ার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে অপর পাশের রাস্তার যানবাহনকে চলাচলের সংকেত দেবে। উন্নত দেশগুলোয় এ পদ্ধতিতেই শহর এলাকায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
ডিটিসিএর কর্মকর্তারা বলেছেন, তার কাটা পড়ার বিষয়টি দুই সিটি করপোরেশন, মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা ডিএমটিসিএল এবং ঢাকা ওয়াসাকে জানানো হয়েছে। তারা তার সংযোগ দিলেই কাজ শুরু হয়ে যাবে। পরামর্শক নিয়োগ হবে। আগামী ছয় থেকে আট মাসের মধ্যে আইটিএস চালু করা সম্ভব হবে।
এর আগে প্রকল্পের গোডাউনের কড়া পাহারা থেকে সার্ভার কম্পিউটার চুরি যাওয়ার ঘটনায় মামলা করেছিল ডিটিসিএ। সংস্থাটির তদন্ত কমিটি চুরির জন্য দায়ী করেছিল ‘সুযোগ সন্ধানী ব্যক্তি’কে। থানাপুলিশ ও গোয়েন্দারাও চুরির রহস্য কিনারা করতে পারেনি।
প্রকল্প পরিচালক বলেছেন, নতুন সার্ভার কম্পিউটার কেনা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, কম্পিউারের দাম ৯ লাখ টাকা। সফটওয়্যার ‘কাস্টমাইজ’ ও ‘কনফিগার’ করে ইনস্টল করার খরচ ধরা আছে দুই কোটি ৬২ লাখ টাকা।