বৈশ্বিক রাজনীতির তপ্ত হাওয়া কোন দিকে বইছে? গত কয়েক বছরে রাজনীতির ভরকেন্দ্র কি নড়ে গেছে? খোলা চোখেও কিছু বিষয় বেশ নজরে আসছে। গত শতকে মার্কিন-সোভিয়েত দ্বন্দ্ব শেষ হয়েছে। এর পর ইরাক ঘিরে শুরু হয়েছিল ইঙ্গ-মার্কিন আগ্রাসন- তেমন কোনো সমাধান ছাড়াই সেই আগুন নিভে যেতে না যেতেই টুইন-টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার জেরে যুক্তরাষ্ট্র শুরু করেছিল ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’। ‘অনন্তকাল’ লাগেনি দুই দশকের মাথায় সেই যুদ্ধে ‘তিক্ত’ সমাপ্তি হয়েছে। এ সময়টুকুর মধ্যেই আবার মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) তা-ব বয়ে গেছে। সম্প্রতি বৈশ্বিক রাজনীতির অঙ্গনে চীন-মার্কিন ঘিরে নতুন করে উত্তেজনা শুরু হয়েছে। যদিও চীন যখন থেকে বিশ্ববাজার দখল করতে চাইছে সে সময় থেকেই এ দুটি দেশের দ্বন্দ্ব লেগেই রয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি সেটি অস্ত্র প্রতিযোগিতার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এ কথা খোদ মার্কিন শীর্ষ কর্মকর্তারাই জোর গলায় বলছেন।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে নতুন করে যে টানাপড়েন তৈরি হয়েছে এর শুরু মূলত- যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের একটি প্রতিবেদন ঘিরে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, চীন নতুন হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে যা পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম। কিন্তু চীন এ দাবি জোর গলায় অস্বীকার করেছে। তারা বলেছে, এটি তাদের ধারাবাহিক পরীক্ষা ও সাধারণ মানের ক্ষেপণাস্ত্র যা পৃথিবীর কক্ষপথে স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়ার একজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলছেন, এ অস্বীকার
করার মধ্য দিয়ে চীন মূলত হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের বিষয়টি গোপন করতে চাইছেন। এই নিয়ে দুই দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি কথা চালাচালি চলছে। এদিকে মার্কিন দাবির পক্ষে পালে হাওয়া দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিক ও রাষ্ট্রদূত রবার্ট উড। তিনি বলেছেন, চীন খুব অল্প সময়ের মধ্যে পানির নিচ দিয়ে কাজ করতে পারে এমন ড্রোন ও পরমাণু শক্তিধর ক্ষেপণাস্ত্র হাতে পাবে। তিনি মনে করেন, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তা হবে এবং তখন পরিস্থিতি বদলে যাবে এবং শক্তির ভারসাম্য নষ্ট হবে। রবার্ট উড মনে করেন, গত ১০ বছরের মধ্যে চীন তার অস্ত্রভা-ার দ্বিগুণ করেছে। মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের ভাষ্য- চীনের হাতে এখনই দুইশর মতো পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে যেগুলোর মধ্যে কোনোটি আমেরিকায় পর্যন্ত আঘাত হানতে পারে। চলতি সপ্তাহেই পেন্টাগন আরও একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যাতে বলা হয়েছে- আগামী ১০ বছরের মধ্যে চীন অন্তত এক হাজার পারমাণবিক বোমা বানাবে। এ খাতে ব্যাপক পরিমাণ বিনিয়োগ বাড়িয়েছে বেইজিং। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের দাবি চীন বরাবরই খারিজ করে আসছে। এমন প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেই নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা এ সময়কে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সোভিয়েত-মার্কিন উত্তেজনার সঙ্গে তুলনা করছেন।
বিশ্ব রাজনীতিতে বড় পক্ষগুলোর মধ্যে সব সময় একটি ‘ঘুঁটি’র দরকার হয়। মার্কিন-চীন টানাপড়েনে সেই ঘুঁটির নাম হলো তাইওয়ান। তাইওয়ান নিজেদের স্বাধীন স্বায়ত্তশাসিত ও গণতান্ত্রিক অঞ্চল মনে করলেও চীন মনে করে, এটি তাদের থেকে ছিন্ন হয়ে যাওয়া প্রদেশ। প্রয়োজন হলেই তাইওয়ানকে তারা নিজেদের করে নিতে পারবে। গত এক দুই মাসের মধ্যে তাইওয়ান ঘরে উত্তেজনা তুঙ্গে রয়েছে। বেশ কয়েকবার চীনা যুদ্ধবিমান তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা সীমানা অতিক্রম করে দেখিয়ে এসেছে, ‘এই দেখ চাইলেই আমরা তোমাদের দখল করতে পারি’। আর যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তারা তাইওয়ানের পাশে রয়েছে। ইতোমধ্যে তাইওয়ান স্পষ্ট করেছে, গত ৪০ বছরের মধ্যে বর্তমানে চীন সবচেয়ে বেশি উত্তেজনা ছড়াচ্ছে। এই যখন সার্বিক পরিস্থিতি তখন ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টও জানিয়ে দিয়েছে- তারাও তাইওয়ানের পাশে আছে। অর্থাৎ বিশ্বে মেরুকরণ স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।
তাইওয়ান ছাড়া দক্ষিণ চীন সাগরে আধিপত্য নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের দ্বন্দ্ব রয়েছে। দিন যত যাবে এসব দ্বন্দ্ব হয়তো আরও প্রকট হবে। তবে নিকট ভবিষ্যতে সহসাই বড় যুদ্ধের আশঙ্কা করা হচ্ছে না। কিন্তু বিশ্বের মোড়লরা চাইবে, কার কাছে কত ‘বড় অস্ত্র’ আছে সেইটা দেখাতে।