বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। সমবায় সমিতি এমন একটি জনকল্যাণ ও উন্নয়নমূলক আর্থসামাজিক প্রতিষ্ঠান যার মধ্যে থাকে গণতন্ত্র, সম্মিলিত কর্মপ্রচেষ্টা, ব্যাপক উৎপাদন কর্মযজ্ঞ এবং সদস্যদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির প্রয়াস। আধুনিক কৃষির জন্য যে পুঁজি, ঝুঁকি এবং যৌথ মেধার দরকার তার জন্য প্রয়োজন গণমুখী কৃষিভিত্তিক সমবায় ব্যবস্থা। খাদ্যনিরাপত্তা ও মানুষের দারিদ্র্য দূর করতে হলে কৃষি সমবায়ের কোনো বিকল্প নেই। যথাযথ নীতি, স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা এবং সার্বিক সহযোগিতা পেলে কৃষি সমবায় খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করতে পারে। দারিদ্র্যবিমোচন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ বিপর্যয় প্রতিরোধ এবং খাদ্যনিরাপত্তাবলয় সৃষ্টিতে অন্যতম এবং উৎকৃষ্ট পদ্ধতি হলো সমবায়। এ জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সমবায় প্রতিষ্ঠা, সমবায় আন্দোলন সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেয়া।
সংবিধানের ১৩ (খ) অনুচ্ছেদে সম্পদের মালিকানার দ্বিতীয় খাত হিসেবে সমবায়কে স্বীকৃতি দেয়া হয় এবং সমবায়কে গণমুখী আন্দোলনে পরিণত করার ডাক দেয়া হয়েছিল। শুধু তাই নয়, দেশের জনগণের পুষ্টিচাহিদা পূরণে দরিদ্র, ভূমিহীন, নিম্নবিত্ত দুগ্ধ উৎপাদনকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণপূর্বক সমবায়ের মাধ্যমে সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে ‘সমবায় দুগ্ধ প্রকল্প’ নামে একটি দুগ্ধশিল্প উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে পাঁচটি দুগ্ধ উৎপাদনকারী এলাকায় দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপন করে। আজকের মিল্কভিটা তারই সুদূরপ্রসারী উদ্যোগের ফসল। জাতির পিতা সমবায় পদ্ধতিতে সমন্বিত ও যৌথ খামার প্রচলনের মাধ্যমে উন্নয়নের পাশাপাশি স্থানীয় রাজস্বে পল্লী-উন্নয়ন করতে চেয়েছিলেন।
যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনকালে সমবায়ের মাধ্যমে দেশের আর্থসমাজিক উন্নয়নের স্বপ্নের শুরু। তখন কৃষি, ভূমি ব্যবস্থাপনা, শিল্প উদ্যোগ, কৃষিঋণ বিতরণ – সব ক্ষেত্রে সমবায় কৌশল কাজে লাগিয়ে স্থায়ী অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার আকাক্সক্ষা জাগ্রত ছিল। সে জন্যই সংবিধানে সমবায়কে রাষ্ট্রীয় সম্পদের মালিকানার দ্বিতীয় খাত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। সে দর্শন ধারণ করেই সরকার প্রতিটি গ্রামে সমবায়ভিত্তিক মৎস্যখামারসহ গবাদিপশু, হাঁস-মুরগির খামার গড়ে তুলছে। সামাজিক বনায়ন, সমিতির মাধ্যমে পরিবেশের উন্নয়ন, তাঁত ও সেলাই, হস্তশিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, কুটিরশিল্প, মৃৎশিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ইত্যাদি উন্নয়নমূলক প্রকল্পও বাস্তবায়ন করছে। এখন সমবায়কে উৎপাদনমুখী কার্যক্রম পরিকল্পনায় নতুন করে সাজাতে হবে। দেশে সমবায় আন্দোলন ও গ্রামীণ অর্থনীতি বিকাশের স্বার্থে সমবায়কে সমগ্র গ্রাম-ইউনিয়ন পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে কৃষি ও ফলমূলভিত্তিক সমবায়, দুগ্ধখামার সমবায়, মৎস্যখামার সমবায়, গবাদিপশু ও হাস-মুরগি পালন সমবায়, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পভিত্তিক সমবায় এবং বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ভিত্তিক সমবায় সমিতি গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার সমবায় অধিদফতরকে শক্তিশালী করে একটি সমন্বিত ও সুষ্ঠু কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে তা তদারকি ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব। দেশের সব জাতীয়, কেন্দ্রীয় ও প্রাথমিক সমিতিগুলোকে ইউনিয়নের সদস্যভুক্ত করতে হবে। সমিতিগুলো নিয়মিত চাঁদা পরিশোধ করলে ইউনিয়নে অর্থ সঙ্কট হবে না। ইউনিয়ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচিসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে। সর্বোপরি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সৎ, অভিজ্ঞ, প্রকৃত সমবায়ীদের দিয়ে ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করতে হবে। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় লোকসানি শিল্পকারখানাগুলোকে সমবায়ের আওতায় শ্রমিক ও কর্মচারীদের মাধ্যমে পরিচালিত করতে হবে। তাহলে লোকসানি খাতগুলো রাজস্ব আয়ের খাত হিসেবে পরিগণিত হবে। এর মাধ্যমে সমবায়ীরাও দেশের অর্থনীতিতে অন্যতম ভূমিকা রাখতে পারেন।
সুষ্ঠু কর্মপরিকল্পনা, আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবে সমবায় খাতে প্রত্যাশিত অগ্রগতি আজ অবধি দৃশ্যমান হয়নি। সমবায় হিসেবে অন্যতম সফল প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটা এ ক্ষেত্রে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দেশের জনগণকে এখনো পুষ্টিচাহিদার জোগান দিয়ে যাচ্ছে। ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল ও স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনালগ্নে গঠিত সমবায় সমিতিগুলো হয় বন্ধ হয়ে গেছে নয়তো নিষ্ক্রিয় রয়েছে। কিছু সমিতির কার্যক্রম আছে মাত্র। নতুন সমিতি খুব একটা গঠিত হয় না। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের যা করণীয় তা হচ্ছে – দেশের নিষ্ক্রিয় মৃতপ্রায় সমবায় সমিতিগুলো পুনরুজ্জীবিত করতে একজন সমবায় বিশেষজ্ঞকে প্রধান করে এবং আরো দু’জন অভিজ্ঞ সমবায় গবেষককে সদস্য করে কমিশন গঠন করা যেতে পারে। কমিশন দেশের সমবায় সমিতির বিদ্যমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সমস্যা ও সম্ভাবনা নির্ণয় করে সরকারের কাছে করণীয় প্রস্তাবনা পেশ করবে। যেসব সমিতি আর পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব নয় তা বিলুপ্ত করার ঘোষণা দেবে এবং যেসব সমিতি পুনরায় চালু করা সম্ভব তা কোন প্রক্রিয়ায় চালু হবে তার প্রস্তাবনা সরকারের কাছে পেশ করবে। যে সব সমিতি বন্ধ রয়েছে তার কারণ অনুসন্ধানপূর্বক দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ারও সুপারিশ করবে এবং সমবায়ের বেহাত ও বেদখল হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ ছাড়া কমিশনকে সমবায় অঙ্গনে ন্যায়পালের ক্ষমতায়নের দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। সমবায় অধিদফতরের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে সমবায়ীদের কোনো অভিযোগ থাকলে তা কমিশনে পেশ করবে। কমিশন দায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। পাশাপাশি দেশের বিদ্যমান সমবায় আইন বিধিমালা প্রয়োজন অনুযায়ী সংশোধনের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব পেশ করতে পারবে। দেশের সমবায় খাতের পুনরুজ্জীবন এবং এ খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে সমবায় কমিশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে।
দারিদ্র্যবিমোচন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী একটি পরীক্ষিত স্বীকৃত মাধ্যম হচ্ছে সমবায়। বর্তমানে অর্থনীতির প্রায় সব শাখায় সমবায় তার কার্যক্রম বিস্তৃত করেছে। সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার ও ‘রূপকল্প-২০২১’ বাস্তবায়নে সমবায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, বিশেষ করে আর্থিক ও সেবা খাতে নতুন কার্যক্রম গ্রহণ এবং বিদ্যমান কার্যক্রমে গতিশীলতা আনয়নে সমবায় অধিদফতর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ, দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা আনয়ন, প্রশিক্ষণ ও সেবা প্রদানের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, অনগ্রসর ও পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন বিশেষত নারী উন্নয়নে সমবায় নিকট ভবিষ্যতে আরো গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখতে পারবে। পৃথিবীতে অনেক উন্নত রাষ্ট্রই সমবায়ের কৌশলকে অবলম্বন করে স্বাবলম্বী হয়েছে। বাংলাদেশও সমবায়ী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হলে, অনুপ্রাণিত হলে ড. আকতার হামিদ খানের প্রণীত পল্লী উন্নয়নের কৌশলকে কাজে লাগিয়ে দারিদ্র্যবিমোচনের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। একমাত্র সমবায়ী চেতনায় মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে যেকোনো কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারে। সরকারের রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়ন এবং বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে বিশ্ব দরবারে উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে সুনাম ও সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে সমবায় খাতের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে।
সমবায় আজ মৃতপ্রায় সংগঠনে পরিণত হয়েছে। সমবায়ের কার্যক্রম শুধু কাজীর গরু কেতাবে পরিলক্ষিত হওয়ার বিষয়ে পর্যবসিত হয়েছে। সমবায় আজ বাস্তবতা থেকে দূরে, সঙ্কটের আবর্তে পতিত। সমবায়ের আজ পুনর্জাগরণ দরকার। বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন, একমাত্র সমবায়েই দেশ থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণসহ স্বনির্ভরতা অর্জন করা সম্ভব। পৃথিবীর উন্নত দেশে সমবায় কাঠামো খুব মজবুত। তারা আধুনিক সমবায়ী ধারণাকে প্রাধান্য দিয়ে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা লাভ করেছে। সে ক্ষেত্রে আমাদের পিছিয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই। কেননা, উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায় অংশীদার আমরাও। ২০৪১ সালে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করে উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে আসীন হতে চাই আমরা। এ ক্ষেত্রে সমবায় আদর্শকে পুরোপুরি জাতীয়করণ করে শক্ত নীতিনির্ধারণী কর্মপন্থার অনুশীলন করে সমবায়কে সুদৃঢ় ভিত্তিতে বাস্তবে রূপদান করতে হবে। অধিকন্তু দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সর্বোপরি সুযোগ্য নেতৃত্ব ও আপসহীন মন-মানসিকতায় সমবায়কে প্রাতিষ্ঠানিকতা দিতে এগিয়ে আসতে হবে। ত্যাগী, সৎ, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতায় সমবায় গতি পাবে। তাই অনতিবিলম্বে সমবায় সংস্কার কমিটি গঠনপূর্বক কমিশনের মতামত, সুপারিশ ও প্রস্তাবনার আলোকে সমবায়কে যুগোপযোগীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পরিশেষে আমরা বলতে পারি, সমবায় শক্তিশালী হলে দেশে দুর্নীতি বন্ধ হবে। দেশে বেকারত্ব ও অরাজকতা কমে আসবে। এমনকি রাজনৈতিক সহিংসতাও কমে আসবে। প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমে আসবে। সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন – ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। তাই, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ সমবায় ভাবনার সফল বাস্তবায়নের জন্য বাস্তবতার নিরিখে সমবায় অধিদফতরকে যুগোপযোগী সংস্কার ও শক্তিশালী করে দ্রুত আধুনিকায়নের যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সমবায় খাতকে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে গণ্য করে সরকারকে দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক
সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি