ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের দশম দিনে গতকাল মস্কো ও কিয়েভের মধ্যে অস্ত্রবিরতি নিয়ে টানাপড়েন লক্ষ করা গেছে। ইউক্রেনের দুটি শহর থেকে সাধারণ মানুষকে সরিয়ে নিতে সাময়িক অস্ত্রবিরতি ঘোষণা করেছিল মস্কো, তাতে সায় দিয়েছিল কিয়েভ। কিন্তু রাশিয়া সেই অস্ত্রবিরতি না মেনে গোলাবর্ষণ অব্যাহত রেখেছে বলে জানিয়েছে ইউক্রেনের কর্তৃপক্ষ। এতে সাধারণ মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার জরুরি কাজটি স্থগিত রাখা হয়েছে বলেও জানিয়েছে স্থানীয় মেয়র। খবর বিবিসি, রয়টার্স।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর খবরে বলা হয়, ইউক্রেনের বন্দরনগরী মরিপল ও ভলনোবাখায় গত কয়েকদিন নির্বিচারে গোলাবর্ষণ করেছে রুশ বাহিনী। এতে সেখানে ভয়াবহ মানবিক সংকট দেখা দেয়। পরিস্থিতি মোকাবিলায় দুটি শহর থেকে বেসামরিক লোকদের সরিয়ে নিতে সাময়িক অস্ত্রবিরতির ঘোষণা দেয় রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। ঘোষণা অনুযায়ী ৫ মার্চ স্থানীয় সময় ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত মরিপল ও ভলনোবাখ অস্ত্রবিরতি শুরু হওয়ার কথা ছিল। সাধারণ মানুষকে সরিয়ে নিতে ‘মানবিক করিডোর’ খোলার ব্যাপারেও সম্মত হয়েছিল তারা। শহর দুটির বাসিন্দাদের জন্য গাড়িবহরও প্রস্তুত ছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাশিয়া অস্ত্রবিরতি লঙ্ঘন করে গোলাবর্ষণ চালু রাখে বলে জানায় কিয়েভ।
মরিপলের নগর কাউন্সিল টেলিগ্রাম পোস্টে জানিয়েছে, যেখানে মানবিক করিডোরের শেষ হয়েছে- সেই জাপোরিজিয়া অঞ্চলে দুপক্ষের মধ্যে লড়াই চলছে। এ ছাড়া মরিপল শহরেও গোলাবর্ষণ অব্যাহত রয়েছে বলে দাবি করেছে নগরের ডেপুটি মেয়র সেরহি ওরলভ।
বিবিসিকে তিনি বলেন, রুশরা আমাদের ওপর বোমা ফেলা অব্যাহত রেখেছে। এটা পাগলামি ছাড়া আর কিছুই না। মরিপলে যুদ্ধবিরতি হচ্ছে না, এমনকি মানবিক করিডোরেও যুদ্ধবিরতি মানা হচ্ছে না। ওরলভ আরও বলেন, অস্ত্রবিরতি কার্যকর হলে সর্বোচ্চ ৯ হাজার লোককে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হতো।
এদিকে বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, স্বল্প সময়ের অস্ত্রবিরতির মধ্যে ভলনোবাখা থেকে মাত্র ৪০০ জনকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। শহরটি ছোট হলেও সেখানে ২০ হাজার লোক বাস করে। যুদ্ধবিরতি কার্যকর না হওয়ায় হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুর মুখে রয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন হুমকি দিয়ে বলেছেন, ইউক্রেনের আকাশকে ‘নো ফ্লাই জোন’ ঘোষণা করার অর্থ এই যে আমরা মনে করব, তারা ইউক্রেন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। যে কেউ এমন পদক্ষেপ নিলে আমরা তা আমাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করব। গতকাল টেলিভিশন ভাষণে এ বিষয়ে কথা বলার পাশাপাশি পুতিন এটিও বলেন যে, রাশিয়াতে সামরিক শাসন জারি করার কোনো পরিকল্পনা তার নেই।
এর আগে গত শুক্রবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোর কড়া সমালোচনা করেছেন। কিয়েভের পক্ষ থেকে ইউক্রেনের আকাশকে নো ফ্লাই জোন হিসেবে ঘোষণার অনুরোধ করা হলে ন্যাটো তা খারিজ করে দেয়। এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। একই সঙ্গে ন্যাটোকে দুর্বল ও ঐক্যহীন জোট হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, তাদের কাছে ইউরোপের স্বাধীনতার কোনো দাম নেই।
এদিকে দশ দিনে রুশ বাহিনী ইউক্রেনের বেশ কয়েকটি শহর বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। এর মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের বড় শহর খারকিভের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, যা এ পর্যন্ত মস্কো বড় অর্জন হিসেবে দেখছে। এ ছাড়া কেরিনিভ, সুমি ও মরিপলের চারদিকে রুশ বাহিনী ঘিরে রেখেছে। যে কোনো সময় এই শহরগুলোর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে রুশ বাহিনী।
রুশ বাহিনীর আক্রমণের মুখে থাকা ইউক্রেনের খেরসনে মস্কোবিরোধী বিক্ষোভে হাজারো লোক অংশ নিয়েছে। প্রায় দুই হাজার লোকের ওই বিক্ষোভে ‘রাশিয়া ঘরে ফিরে যাও’, ‘খেরসন ইউক্রেনের’ আওয়াজ তোলা হয়। এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রুশবিরোধী বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। বিবিসি জানিয়েছে, সুইজারল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, লন্ডনে আন্দোলনাকারীরা মস্কোবিরোধী বিক্ষোভ করেছে। বিশ্বের বড় শহরগুলোয় রুশবিরোধী বিক্ষোভ হলেও সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেদে রুশপন্থিদের বিক্ষোভের খবর দিয়েছে বিবিসি।
এদিকে রুশ আগ্রাসনের ১০ দিন রুশ আক্রমণের মুখে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে ইউক্রেনের সেনা ও আপামর জনসাধারণ। কিয়েভ অভিমুখে রুশ সেনাদের দীর্ঘ সাঁজোয় বহরের খবর পাওয়া গেলেও কিয়েভ এখনো ইউক্রেনের সেনাদের দখলেই রয়েছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বলেছেন, ‘আমি পালায়নি, কিয়েভেই আছি।
উল্লেখ্য, ন্যাটোতে যোগদানের ইস্যু নিয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ধারাবাহিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ বাহিনী ইউক্রেনে সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করে। গতকাল জাতিসংঘ জানিয়েছে এ পর্যন্ত ৩৫১ জন বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছে। এ ছাড়া দশ লাখের বেশি লোক এই যুদ্ধে শরণার্থী জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন।