মঙ্গলবার, ০৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১১:৫৯ পূর্বাহ্ন

জ্বালানি তেল আমদানি নিয়ে সংকটে সরকার

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ১০ মার্চ, ২০২২
  • ১২১ বার

রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রভাবে মহাসংকটে পড়তে যাচ্ছে সরকার। আমদানিনির্ভর জ্বালানি তেল সংগ্রহ এবং সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে এর ভয়াবহ প্রভাব পড়বে।

রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জ্বালানি তেল আমদানি এবং দেশে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা নিয়েই এখন শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সরকারের ভর্র্তুকি দেওয়ার পরও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় জ্বালানি তেলের বিক্রিতে প্রতিদিন অন্তত ৬৫ কোটি টাকা লোকসান গুনছে সংস্থাটি। ফলে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে অর্থের সংস্থান হলেও যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তেল সংগ্রহ বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়বে।

সম্ভাব্য সংকটের বিষয়ে বিপিসির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ আমাদের সময়কে বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে অভ্যন্তরীণ বাজারে বিপিসির লোকসান বাড়ছে। বিশেষ করে দেশের অভ্যন্তরীণ প্রধান জ্বালানি ডিজেলে অনেক বেশি লোকসান হচ্ছে। ফার্নেস অয়েল ছাড়াও অন্যান্য জ¦ালানি তেলে লোকসান করছে বিপিসি। তিনি বলেন, এভাবে চলতে থাকলে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প থাকবে না। তবে এই মুহূর্তে জ¦ালানি তেলের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি সমন্বয়ের কোনো ভাবনা সরকারের নেই। তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রতিদিন ৬৫ কোটি টাকা লোকসান করছে বিপিসি।

বিপিসির এক কর্মকর্তারা জানান, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বর্তমানে ডিজেলে লিটারপ্রতি ২০ টাকা এবং ফার্নেস অয়েলে লিটারপ্রতি ১১ টাকা লোকসান হচ্ছে। এভাবে চললে প্রতি মাসে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা লোকসান হবে, যা বছর শেষে ২৪ হাজার কোটি টাকায় ঠেকবে। অবশ্য এই হিসাব নিশ্চিত করে বলা যায় না। তেলের দাম আরও বাড়বে বা কমবে কিনা তা সম্পূর্ণ নির্ভর করবে আন্তর্জাতিক বাজারের তেলের দামের ওপর। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী দেখা যায় আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল ডিজেলের দাম ১৫৬ দশমিক ৫৬ টাকা। তবে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল ছাড়া বিপিসি অকটেন আমদানিতে কোনো লোকসান করছে না বলে জানা গেছে।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সীমান্ত পথে জ্বালানি তেল পাচার হয়ে যাচ্ছে- এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিভাগের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, জ্বালানি তেলের পাচার রোধে এবং সিস্টেম লস কমাতে সীমান্ত এলাকার জেলা প্রশাসকদের নজরদারি বাড়াতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ভারতে ডিজেলের দাম বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় ৩৫ টাকা বেশি। বিশ্বব্যাপী সংকট দেখা দেওয়ায় নতুন করে বাংলাদেশ থেকে ভারতে ডিজেল পাচার হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, এর আগে ভারতের তুলনায় যখন বাংলাদেশে ডিজেলের দাম কম ছিল তখন ভারত থেকে বাংলাদেশে আসা ট্রাকগুলো যাওয়ার সময় ট্যাংক লোড করে তেল নিয়ে যেত। সরকার সেটা বন্ধ করেছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে পণ্য নিয়ে আসা ট্রাকগুলো তাদের ট্যাংকে ওই পরিমাণ তেল নিতে পারবে যতটুকু দিয়ে সে বাংলাদেশ সীমান্ত পার হতে পারবে। তিনি বলেন, পাচার ঠেকানো ছাড়াও সরকার নজরদারি বাড়িয়েছে, যেন কেউ তেল মজুদ করতে না পারে। পেট্রোল পাম্পগুলো স্বাভাবিক সময়ে যতটুকু তেল সংগ্রহ করত তারচেয়ে বেশি না করতে পারে। ওই কর্মকর্তা বলেন, জ্বালানি বিভাগ সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে জ্বালানির বাজার স্বাভাবিক রাখতে। তিনি বলেন, আমাদের সবচেয়ে বেশি সংকট সৃষ্টি করে সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীরা । জ্বালানি তেল নিয়ে যেন কেউ সুযোগ নিতে না পারে সেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশে জ্বালানি তেল সংগ্রহ ও সরবরাহ নিয়ে বড় ধরনের বিপর্যয় হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ সরকারের সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ম তামিম বলেন, ইউক্রেনের যুদ্ধকে ঘিরে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে আগামী দিনগুলোয় বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি না হলে অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি দুইশ ডলার পর্যন্ত উঠে যেতে পারে। যা আমাদের জন্য প্রচ- বিপর্যয়ের সৃষ্টি করবে। তার ধারণা, পরিবহন থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ সব কিছুতেই রেশনিং হবে তখন। কারণ অত উচ্চমূল্যে সরকার বাইরে তেল বিক্রি করতে পারবে না। পরিবহন বা বিদ্যুতের খরচ তা হলে এত বেড়ে যাবে যে, তা জনমানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে।

বিপিসি সূত্রে জানা যায়, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বিপিসি মুনাফার তহবিল থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা চেয়ে চিঠি দেয়। গত ২০ জানুয়ারি এক হাজার কোটি দেওয়ার পর বিপিসি আর কোনো টাকা অর্থ মন্ত্রণালয়কে দিচ্ছে না। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ক্রমশ বাড়তে থাকায় আর টাকা দিতে পারবে না অর্থমন্ত্রণালয়কে জানিয়ে দিয়েছে বিপিসি। বিপিসির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, অর্থমন্ত্রণালয়ের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এক হাজার কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়। বাকি চার হাজার কোটি টাকা ১০ ফেব্রুয়ারি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তেল আমদানিতে বিপিসির অর্থ সংকটের কারণে সেই টাকা আপাতত দিতে পারছে না বিপিসি।

জ্বালানি বিভাগের অপর এক কর্মকর্তা বলেন, বিশ্বজুড়ে মহামারী করোনা ভাইরাসের সময় আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত ও পরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম অনেক কমে গিয়েছিল। তখন বিপিসি দেশের বাজারে বেশি দামে তেল বিক্রি করায় মুনাফা করে। সেই মুনাফা থেকে বিপিসি সরকারের কোষাগারে ১০ হাজার কোটি টাকা জমা দেয়। পরে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পুনরায় ৫ হাজার কোটি টাকা চাওয়া হলে বিপরীতে এক হাজার কোটি দিয়ে আর টাকা দিতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয়।

উল্লেখ্য, রাশিয়া থেকে বাংলাদেশ সরাসরি তেল কেনে না। রাশিয়া প্রতিদিন প্রায় ১১ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপাদন করে। বর্তমানে সারা বিশে^ যে তেল উৎপাদিত হচ্ছে তার প্রায় ১২ শতাংশই রাশিয়ার। রাশিয়ার তেল যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। এ ছাড়া ইউরোপের ৪০ শতাংশ গ্যাস যায় রাশিয়া থেকে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশও জ্বালানি তেল সরবরাহ করে থাকে। বর্তমানে যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার তেল বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় তেলের বাজারে একটা অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ তেল কেনে মূলত কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ থেকে।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com