হাজার হাজার বছর ধরে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা এই জমিতে আগুন ধরিয়ে এসেছে। ইউরোপীয়রা অস্ট্রেলিয়ায় আক্রমণ চালিয়ে উপনিবেশ স্থাপনের অনেক আগে থেকেই “সাংস্কৃতিক দহন” নামে পরিচিত অগ্নি ব্যবস্থাপনার কৌশলগুলো স্থানীয়ভাবে অনুশীলন করা হতো।
কুল বার্নিং বা হাঁটু-পর্যন্ত উচ্চতার আগুন জ্বালানোর প্রক্রিয়া এমনভাবে ডিজাইন করা হতো যেন সেই আগুন প্রতিনিয়ত পুরো ভূমিজুড়ে জ্বলতে থাকে।
এই আগুন ছোট ছোট ডালপালা থেকে শুরু করে শুকনো পাতার মতো দাহ্য উপাদান সবই পুড়িয়ে দেয়। এতে করে প্রাকৃতিক দাবানল আঘাত হানার আশঙ্কা কমে যায়।
গত বছর অস্ট্রেলিয়ার দাবানল সংকট শুরু হওয়ার পরে, এই কৌশলটি পুনরায় আরও ভালভাবে চালু করার আহ্বান বেশ জোরালোভাবে ওঠে। আর সেটি খুব শীঘ্রই চালু হওয়া উচিত ছিল, এমন যুক্তি দিয়েছেন একজন আদিবাসী জ্ঞান বিশেষজ্ঞ।
“বন জ্বলতে হবে,” শ্যানন ফস্টার বলেন। তিনি ডি’হারাওয়াল জনগোষ্ঠীর জ্ঞান রক্ষক, তার পূর্বসূরীদের রেখে যাওয়া তথ্যের ওপর নির্ভর করেন তিনি কাজ করেন।
এছাড়া তিনি ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি সিডনির (ইউটিএস) একজন আদিবাসী জ্ঞান বিষয়ক প্রভাষক। বংশ পরম্পরায় কয়েক পুরুষ ধরে আহরিত যেসব তথ্য তিনি মানুষকে বলে থাকেন তার বেশিরভাগই বন সম্পর্কিত।
“এটি একটি গ্রামকে টিকিয়ে রাখার ধারণা দেয়- আমরা আদিবাসী মানুষ হিসেবে যা কিছু করি তার কেন্দ্রবিন্দুতে এই বন টিকিয়ে রাখার ধারণাই থাকে। আমরা একটা গ্রাম থেকে শুধু কী নিতে পারি তার চাইতে, আমরা গ্রামকে কী ফিরিয়ে দিতে পারি, সেটা জরুরি।”
আজকের ‘সাদাসিধে’ কৌশল
আদিবাসী সংস্কৃতিতে, গ্রামকে ব্যক্তিরূপে প্রকাশ করা হয়। “এই পৃথিবী আমাদের মা। সে আমাদের বাঁচিয়ে রাখে,” ফস্টার বলেন।
সতর্কতামূলক আগুন জ্বালানোকে অগ্রাধিকার দেয়া ঠিক হবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত নিতে এই সম্পর্কটি সাহায্য করে। যদিও আধুনিক কালের কর্তৃপক্ষ, জীবন ও সম্পদ রক্ষার লক্ষ্যে বিপর্যয় হ্রাসকরণ প্রক্রিয়ায় আগুন জ্বালিয়ে থাকে।
তাদের সেই উদ্যোগ কাজ করছে না বলে জানান ফস্টার।
আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক দহন, পরিবেশের ছন্দের সঙ্গে তাল রেখে কাজ করে, এর দ্বারা মার্সুপিয়াল এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীরা আকৃষ্ট হয়, ফলে আদিবাসীরা শিকার করতে পারে।
“কুল বার্নিং বা শীতল দহন পৃথিবীর ঘাটতি পূরণ করে এবং জীববৈচিত্র্য বাড়ায় – আগুনের ছাই জমিকে উর্বর করে এবং পটাসিয়াম উৎপাদনক্ষমতা বাড়ায়। এটি সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের একটি জটিল চক্র।”
ফস্টার বলেন, “এই দহন বাস্তুসংস্থানে একটি বৈচিত্র্য তৈরি করে এবং এর ফলে অনুকূল জলবায়ু সৃষ্টি হতে পারে। সফট বার্নিং অথবা ক্ষীণ দহন বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা বাড়ায়- এটি পরিবেশকে একটি বিশেষ বায়ুমণ্ডলীয় স্তরে উষ্ণ করে তোলে এবং ওই স্তরে গরম এবং শীতল বাতাসের সংঘর্ষে ঘনীভবন হয় এবং বৃষ্টিপাত ঘটে যা আগুন নিরসনে সহায়তা করে।”
সিডনিতে থাকা তার প্রবীণ আদিবাসী সদস্যরা অতিমাত্রায় বেড়ে ওঠা ঝোপঝাড় এবং অত্যন্ত শুকনো ডালপালা দেখে বেশ কয়েকবার সতর্ক করেছিলেন যে একটি বিশাল দাবানল আসতে যাচ্ছে।
“এই পরিস্থিতিকে তারা একটি শিশুর এলোমেলো চুলের সাথে তুলনা করে বলেন যে এই চুলকে পরিপাটি করা প্রয়োজন।”
এজন্য তারা অনুমতি চাইলে, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তাদের সাংস্কৃতিক দহন করতে নিষেধ করেছিল।
যেখানে সাংস্কৃতিক দহন ব্যবহৃত হয়
সতর্কতামূলক দহন পদ্ধতির কোন গৎবাঁধা নিয়ম নেই কারণ অস্ট্রেলিয়ার ভূমি কাঠামো একেক জায়গায় জায়গায় একেকরকম। তা সত্ত্বেও, কয়েকটি রাজ্য অন্যান্য কৌশলের সাথে সাংস্কৃতিক দহন চালু করে বলে জানিয়েছেন দাবানল এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ সমবায় গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান নির্বাহী ডঃ রিচার্ড থর্নটন।
“উত্তর অস্ট্রেলিয়ায় এক বড় ধরণের ভিন্নতা রয়েছে, যেখানে আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক দহন যথেষ্ট পরিমাণে হয়ে থাকে। দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে এটি কখনও কখনও স্থানীয় সম্প্রদায়ের প্রয়োজন এবং ইচ্ছা অনুযায়ী হয়।”
১৭৮৮ সালে অস্ট্রেলিয়া উপনিবেশিক রাষ্ট্র হওয়ায় পর ধীরে ধীরে সাংস্কৃতিক দহনের রীতি নির্মূল করা হয়েছিল। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এটি পুনরায় চালু করার পদক্ষেপ দেখা গেছে। অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় উদ্যানের সাবেক বনরক্ষী এবং সহযোগী অধ্যাপক নোয়েল প্রিস, মধ্য অস্ট্রেলিয়ার সংরক্ষিত পার্কগুলোর জন্য প্রথমবারের মতো অগ্নিকাণ্ডের ম্যানুয়াল লেখেন।
তিনি বলেন যে, মেলবোর্নের কিছু অংশে এখনও সাংস্কৃতিক দহন অনুশীলন করা হয়, তবে দক্ষিণ-পূর্ব অস্ট্রেলিয়ার বেশিরভাগ স্থানে তা থেমে গেছে কারণ কিছু বিপদজনক অঞ্চলে গাছপালা জন্মেছে, যেখানে শীতল দহন কাজ করে না।
“এর অর্থ ‘নোংরা গ্রাম’ সম্পর্কে আদিবাসীদের অত্যন্ত গভীর জ্ঞান ছিল, যেই গ্রামকে ভালভাবে পোড়ানো দরকার,” বলেছেন জেমস কুক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক প্রিস।
প্রাচীন অনুশীলনের কিছু ত্রুটি
অধ্যাপক প্রিস বলেছেন, সাংস্কৃতিক দহনের কারণে ভূ-গর্ভে জ্বালানীর পরিমাণ ১০ টন থেকে কমে এক টনে নেমে আসতে আসতে পারে। তবে এই দহন কেবলমাত্র মাঝারি মাত্রার আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে, তাই বিপর্যয় কমানোর এই দহন একযোগে করা প্রয়োজন।
তারপরও, এটি কেবল ঝুঁকি কমাতে পারে: “বিপর্যয়কর আর্দ্রতা এবং তীব্র বাতাস কোনটাই সাম্প্রতিক আগুন থামাতে পারেনি।”
“আদিবাসীদের তাদের দেশ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, সুতরাং এখানে পুনরায় শেখার একটি প্রক্রিয়া রয়েছে যা অত্যন্ত দরকারি এবং গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তারপরও এটি প্রাচীন কালের বিষয় যা যথেষ্ট নয়,” তিনি বলেন।
বিশেষজ্ঞরা একমত হন যে, সাংস্কৃতিক দহনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, এর আংশিক কারণ হতে পারে যে উপনিবেশের ফলে নানা ক্ষেত্রে বিকাশ ঘটেছে এবং মানুষের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটেছে, যার কারণে শত শত বছর আগের তুলনায় আমাদের এখনকার প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন।
অধ্যাপক প্রিস এমন অঞ্চলে ছিলেন, যেখানে পরিস্থিতি এমন ছিল যে এক পর্যায়ে শীতল সাংস্কৃতিক দহন কোন সঠিক উপায় ছিল না।
বড় ধরণের আগাছাগুলো গাছের আগা পর্যন্ত ছাউনির মতো ছড়িয়ে গেছে, এগুলো পোড়াতে উষ্ণ আগুনের দরকার কারণ শীতল দহন এই দাহ্য স্তরগুলো সরাতে পারবে না—বলেন ড. থর্নটন।
তিনি আরও বলেন যে, ফায়ারস্টিক্সের মতো কয়েকটি সংস্থা নিজেদের জায়গার মধ্যে একেকটি আদিবাসী দহন পদ্ধতি নিয়ে কাজ করেছে।
তবে অন্যরা যদি এটি আরও বড় আকারে করতে চায় তবে সব সম্প্রদায়ের সম্মতির ভিত্তিতেই তা হওয়া দরকার।
“আমাদের নিশ্চিত করা দরকার যে আগুন, মানুষের সম্পদ পুড়িয়ে ফেলতে পারে এবং এর সামগ্রিক অনুশীলন পুরো সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গিকে ছোট করবে তাই আমাদের সুরক্ষা কাঠামোর মধ্যে কাজ করা নিশ্চিত করতে হবে যেটা প্রতিরোধ করা যাবে।”
এগিয়ে যাওয়ার পথ
প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন চলমান দাবানল সংকট সম্পর্কে একটি “তদন্তের” প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ দাবানলের কারণে এ পর্যন্ত ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং এক কোটি হেক্টর এলাকা পুড়ে গেছে।
ড. থর্নটন মনে করেন, যখন এই দাবানল চলতেই থাকে তখন প্রতিটি অঞ্চলে থাকা প্রবীণ আদিবাসীদের সাথে কথা বলা এবং তাদের পরামর্শ শোনা প্রয়োজন। তবে তিনি যেসব জাতীয় দাবানল গবেষণা কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনায় কাজ করেছেন তার কোন বোর্ডে কখনও কোনো আদিবাসীকে বসানো হয়নি।
শ্যানন ফস্টার সরকারী সংস্থাগুলির সাথে একসাথে কাজ করতে আগ্রহী, তবে তিনি উন্নয়নের সম্প্রসারণ নিয়ে বেশ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন: “এত জমি ধ্বংস হয়ে গেছে যে, এখন উন্নয়নকর্মীরা সেখানে গিয়ে বলতে পারে যে আমরা এই জমিতে বসতি গড়তে চাই। যেহেতু জমি সাফ হয়ে গেছে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “আদিবাসীরা এতদিন এই জায়গাটির দেখাশোনা করেছে – এটি এখন ধ্বংস হয়ে গেছে। কারণ কেউ আমাদের সেটি দেখাশোনার অনুমতি দেয়নি,” তিনি যোগ করেন। বিবিসি।