প্রবাসীদের স্বার্থ দেখাশোনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। বিশেষ করে বিদেশে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে যাওয়া কয়েক লাখ বাংলাদেশীর আদৌ কোনো অভিভাবক আছে বলে মনে হচ্ছে না। একের পর এক দেশ থেকে বাংলাদেশী শ্রমজীবীদের দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে, সে দেশে গ্রেফতার করে জেলে আটক রাখা হচ্ছে এবং গ্রেফতার এড়াতে অনেকেই বনে-জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। অথচ প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থের জোরেই অর্থাৎ রেমিট্যান্সে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে।
পত্রপত্রিকায় এ বিষয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে। প্রবাসীদের স্বার্থ রক্ষা, তাদের পেশাসহ স্বাভাবিক জীবনযাপনের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য সরকার এবং অন্যদের কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া দরকার সে বিষয়ে বারবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই কোনো কাজ হচ্ছে না।
সর্বশেষ খবরে জানা যায়, মালয়েশিয়ায় অন্তত দুই লাখ বাংলাদেশী শ্রমিক ‘অবৈধ’ হয়ে পড়ার কারণে গ্রেফতার, হয়রানি এবং দেশে ফেরত পাঠানোর মতো অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির শিকার অথবা বন-জঙ্গলে পালিয়ে থেকে অমানবিক জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছেন। অথচ মালয়েশিয়া সরকার অবৈধ শ্রমিকদের বৈধ করার জন্য বারবার সুযোগ দিয়েছে। কয়েক লাখ টাকা খরচ করে দালালের মাধ্যমে যাওয়া এসব শ্রমিককে বৈধ করার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার কোনো ভূমিকা রাখেনি। অভিবাসীদের বৈধ হওয়ার জন্য ২০১৭ সালে সর্বশেষ সুযোগ দিয়েছিল মালয়েশিয়া সরকার। সেই সুযোগ শেষ হয় ২০১৮ সালের ৩০ আগস্ট। নিবন্ধন করেও দালালদের প্রতারণার শিকার হয়ে অনেক বাংলাদেশী বৈধ হতে পারেননি। অবৈধ প্রবাসীদের ট্রাভেল পাস নিয়ে দেশে ফেরত যাওয়ার সুযোগ দেয় মালয়েশিয়া সরকার। ২০১৯ সালের ১ আগস্ট থেকে অবৈধ অভিবাসীদের দেশে ফিরতে মালয়েশিয়া সরকার ‘ব্যাক ফর গুড’ কর্মসূচি চালু করে। ওই কর্মসূচির মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ৩১ ডিসেম্বর। কিন্তু এখনো মালয়েশিয়ায় অবৈধ বাংলাদেশী আছেন দুই লাখের বেশি। তাদের পাঁচ শতাধিক বাংলাদেশী গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে দেশটির সরকার।
এ দিকে বৈধভাবে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়া বেশ কিছু দিন বন্ধ। নানা অনিয়ম ও সিন্ডিকেটের কারণে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী নেয়ার বিষয়টি ঝুলে আছে। অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়, বিপুল অর্থ ব্যয় করে দালাল বা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে যাতে বাংলাদেশী কর্মীরা যেতে না পারে মালয়েশিয়া সরকার সেটি নিশ্চিত করতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে বাস্তব কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
শুধু মালয়েশিয়াতেই বাংলাদেশী শ্রমিকরা সঙ্কটে নেই। মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম শ্রমবাজার সৌদি আরবেও আমাদের শ্রমিকদের একই অবস্থা। চলতি বছরের প্রথম ১৮ দিনেই এক হাজার ৮৩৪ জন বাংলাদেশী কর্মী সৌদি আরব থেকে ফিরে এসেছেন। এদের অনেকেই ধারদেনা বা শেষ সম্বল জমিটুকু বিক্রি করে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। বেশির ভাগ লোককেই যাওয়ার মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই ফিরতে হয়েছে। জানা যায়, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশীদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে বেশ কিছু দিন ধরে। শুধু ২০১৯ সালেই সৌদি আরব থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে ২৫ হাজার ৭৮৯ বাংলাদেশীকে। ওই বছরে বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরে এসেছেন মোট ৬৪ হাজার ৬৩৮ জন কর্মী। ২০১৯ সালে মালয়েশিয়া থেকে ১৫ হাজার ৩৮৯, আরব আমিরাত থেকে ছয় হাজার ১১৭, ওমান থেকে সাত হাজার ৩৬৬, মালদ্বীপ থেকে দুই হাজার ৫২৫, কাতার থেকে দুই হাজার ১২, বাহরাইন থেকে এক হাজার ৪৪৮ ও কুয়েত থেকে ৪৭৯ জন শূন্য হাতে দেশে ফিরেছেন।
এসব ঘটনায় যা স্পষ্ট সেটি হলো, আমাদের প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় তথা সরকার এবং বিদেশে আমাদের দূতাবাসগুলো দায়িত্ব পালনে চরমভাবে ব্যর্থ। ব্যর্থতা আছে আমাদের কূটনীতিরও। সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা। সরকার যদি দেশের চলমান অর্থনীতির চাকা সচল রাখার স্বার্থে জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে সব ধরনের অব্যবস্থা-অনিয়ম, সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা রুখে দিতে চায়, তাহলেই কেবল এ ক্ষেত্রে সুষ্ঠুতা ফিরে আসতে পারে।