বাংলাদেশে মহাবিপন্ন প্রাণী শকুনের সংখ্যা বাড়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন এ খাতের গবেষকরা। সর্বশেষ ২০১৪ সালের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট শকুনের সংখ্যা ছিল ২৬০টি। কিন্তু এ বছরের শুরুতে শকুন শুমারিতে দেখা গেছে, গত কয়েক বছরে শকুনের ১০টি ছানা জন্ম হয়েছে।
প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন বলছে, দেশে পাওয়া একমাত্র প্রজাতি বাংলা শকুনের প্রজননের হার ৭১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এক সময় বাংলাদেশে সাত প্রজাতির শকুন ছিল। কিন্তু তার মধ্যে রাজ শকুন পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গত ৪০ বছরে একটিও রাজ শকুন দেখা যায়নি দেশের আকাশে।
বাকি ছয় প্রজাতির মধ্যে দু’টি প্রজাতি হিমালয়ান শকুন ও ইউরেশীয় শকুন মূলত পরিযায়ী। শীত মৌসুমে আসে এবং এপ্রিল মাস পর্যন্ত থাকে।
২০১৪ সালের সর্বশেষ শকুন শুমারিতে যে ২৬০টি শকুন পাওয়া গেছে তারা সবাই বাংলা শকুন প্রজাতির। এছাড়া অল্প কিছু সরুঠোঁটি শকুনও আছে। কিন্তু সেটাও বিরল, কারণ পাঁচ বছরে একটি শকুনের দেখা মেলে।
আইইউসিএন বাংলাদেশের কর্মকর্তা সারোয়ার আলম দীপু বলেন, এ বছরের শুরুতে করা নতুন শুমারিতে শকুনের প্রজননের অবস্থায় উন্নতির আভাস পাওয়া গেছে। রেমা কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে যে ৬০ থেকে ৭০টি শকুন আছে, এ বছর আমরা তাদের ১৪টা বাসা পেয়েছি। তার মধ্যে ১০টা ছানা পেয়েছি আমরা। যেটার প্রজনন হার ৭১%। এটা আমাদের একটা বড় সাফল্য এ বছরের জন্য।
তিনি আরো বলেন, শেষ সাত বছরে আমরা পাঁচটি শকুন মারা যাওয়ার খবর পেয়েছি। এর বাইরে কোনো তথ্য নেই। ফলে শকুন কমেনি, স্টেবল আছে। তবে পজিটিভ চেঞ্জ হচ্ছে। অক্টোবর মাসে আরেকটি শকুন শুমারি হবে। এরপর ডিসেম্বর মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে শকুনের সংখ্যা কত তা প্রকাশ করা হবে।
আইইউসিএন বলছে, শকুন এখন সংস্থাটির লাল-তালিকাভুক্ত প্রাণী। প্রকৃতি থেকে যদি কোনো প্রাণীর মোট সংখ্যার ৯০ শতাংশ হারিয়ে যায় তাহলে সেটি রেডলিষ্ট বা লাল-তালিকাভুক্ত প্রাণী হয়। এখন পুরো বিশ্বে শকুনের মোট সংখ্যা ১১ হাজার। অথচ কেবল ভারতীয় উপমহাদেশেই এক সময় চার কোটি শকুন ছিল।
কিন্তু সেখান থেকে ২০০৮-০৯ সালে চালানো শুমারিতে দেখা যায়, বাংলাদেশে শকুনের সংখ্যা নেমে এসেছে ১৯৭২টিতে। ২০১৪ সালের শুমারিতে তা আরো কমে দাঁড়ায় ২৬০টিতে।
শকুন রক্ষায় সরকারি পদক্ষেপ কি যথেষ্ট?
পাখি বিশারদ ও গবেষকেরা বলেন, পশু চিকিৎসায় বিশেষ করে গরুর চিকিৎসায় ব্যবহৃত দু’টি ওষুধ ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেন জাতীয় ওষুধের বহুল ব্যবহারের ফলেই মূলত শকুন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে দক্ষিণ এশিয়া থেকে। এ দু’টি ওষুধ খাওয়া প্রাণীর গোশত খেলে তিন মিনিটের মধ্যে কিডনি বিকল হয়ে মারা যায় শকুন। কারণ শকুন এ ওষুধের বিক্রিয়া হজম করতে পারে না।
এদিকে, বাংলাদেশের সরকার ২০১০ সালে পশু চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক ও ২০১৭ সালে দেশের দু’টি এলাকায় কেটোপ্রোফেনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে।
কিন্তু সারোয়ার আলম বলেন, সাম্প্রতিক গবেষণায় তারা দেখতে পেয়েছেন, এখনো প্রকৃতিতে ৫১ শতাংশ কেটোপ্রোফেনের উপস্থিতি রয়েছে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মোহাম্মদ শাহাব উদ্দিন বলেন, আগামী এক বছরের মধ্যে সরকার দেশের সর্বত্র কেটোপ্রোফেনের ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধের ব্যবস্থা করবে। বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির সাথে আমরা সরাসরি যোগাযোগ করবো, বন অধিদফতর থেকে না হয় আমাদের মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। তাদের ডেকে আবার আমরা বসবো, কেন তারা এখনো বন্ধ করছে না। এ বছরের মধ্যেই আমরা বন্ধ করতে পারবো ইনশা আল্লাহ।
শকুন রক্ষায় দু’টি ওষুধ নিষিদ্ধ করা ছাড়াও সরকার ২০১৩ সালে জাতীয় শকুন সংরক্ষণ কমিটি গঠন করে। ২০১৪ সালে দেশের দু’টি অঞ্চলকে শকুনের জন্য নিরাপদ এলাকা ঘোষণা করা হয়। প্রথমটি সিলেট, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু অংশ এবং দ্বিতীয়টি খুলনা, বরিশাল ও ঢাকা বিভাগের কিছু অংশ।
এছাড়া আইইউসিএনের সাথে সরকারের যৌথ ব্যবস্থাপনায় ২০১৫ সালে শকুনের প্রজননকালীন সময়ের জন্য দু’টি ফিডিং সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। একটি রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে ও অপরটি সুন্দরবনে। কিন্তু তা সত্ত্বেও শকুনের সংখ্যা বাড়ছে না।
ক্যাপটিভ ব্রিডিং বা কৃত্রিম প্রজনন
পাখি বিশারদ ইনাম আল হক মনে করেন, দেশে এখন শকুনের কৃত্রিম প্রজননের কথা ভাবা দরকার সরকারের। সেজন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগও করতে হবে।
তিনি বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘ক্যাপটিভ ব্রিডিং মানে শকুনের বাসা থেকে ডিম চুরি করে আনতে হবে। সে ডিম পাড়লো, আপনি সরিয়ে আনলেন, তখন ও আরেকটা ডিম পাড়বে। না হলে একটাই ডিম দিবে এক বছরে। কারণ একটা ছানার বেশি সে বাঁচাতে পারে না। ওই ডিমটা সরিয়ে এনে ইনকিউবেটরে রেখে ছানা বড় করে লালন পালন করতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, এ প্রক্রিয়া ব্যয় সাপেক্ষ। কারণ ওই ছানাকে অনেক বড় করতে হবে প্রকৃতিতে ছাড়ার আগে। শকুন বাঁচাতে হলে আমাদের ক্যাপটিভ ব্রিডিংয়ে যেতে হবে। সেজন্য টাকা দিতে হবে সরকারকে। পাঁচ কোটি টাকা দিলেই কিন্তু বাংলাদেশে ক্যাপটিভ ব্রিডিং প্রোগ্রাম শুরু করা যায়। বিনিয়োগ করলে তবেই আমরা শকুনের সংখ্যা বাড়াতে পারব। কারণ শকুনের সংখ্যা ধীরে বাড়ে ও ধীরে কমে।
শকুনকে প্রকৃতির ঝাড়ুদার বলা হয়, কারণ এরা মৃত প্রাণীর গোশত খেয়ে বেঁচে থাকে। ফলে প্রাকৃতিকভাবেই বহু জীবাণু ধ্বংস করে।
গবেষকেরা বলেন, শকুনের পাকস্থলী অ্যানথ্রাক্স, জলাতঙ্কসহ বহু রোগের জীবাণু হজম করে প্রকৃতিকে রক্ষা করতে পারে।
সূত্র : বিবিসি