ঢাকার আকাশে সকাল থেকেই থেমে থেমে বৃষ্টি। বৃষ্টি কাদা উপেক্ষা করে পূজাম-পে ছিল নানা বয়সী মানুষের ভিড়। গতকাল সোমবার রাজধানীর রামকৃষ্ণ মিশনে মহাষ্টমীর দিনে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। দুই বছর পর হওয়াতেই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এক অন্য রকমের উচ্ছ্বাস লক্ষ করা যায়। ষষ্ঠীপূজার মধ্য দিয়ে সূচনা ঘটে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার। ষষ্ঠী তিথিতে অশ্বমেথ বৃক্ষের পূজার মাধ্যমে আহ্বান জানানো হয় দেবী দুর্গাকে। ঢাকঢোল আর কাঁসার বাদ্যে দেবীর বোধনপূজা শেষে মহাসপ্তমীর ভোরে কলাবউ স্নান, নবপত্রিকা প্রবেশ। দর্পণে দেবীকে মহাস্নান, চক্ষুদানে দেবীর মৃণয়ীতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা এবং সপ্তমী বিহিতপূজার মধ্য দিয়ে শেষ হয় সপ্তমী তিথি। গতকাল সোমবার ছিল মহাষ্টমী। সকাল ৯টা ৫৭ মিনিটে মণ্ডপে মণ্ডপে দেবীর মহাষ্টমী কল্পারম্ভ ও বিহিতপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এ দিন নতুন কাপড় পরে বাহারি সাজে মন্দিরে মন্দিরে দেবীকে পুষ্পাঞ্জলি দেন ভক্তরা। রীতি অনুযায়ী, অষ্টমী বিহিতপূজা শেষেই হয় ‘কুমারী পূজা’। মূলত দুর্গাপূজার অষ্টমী তিথিতে মহামায়ার ষষ্টক অর্থাৎ ৬ বছরের কুমারী রূপ ‘উমা’র পূজা করা হয়।
করোনা ভাইরাস মহামারীর কারণে গত দুই বছর ঢাকায় কুমারীপূজা হয়নি। এবার দুই বছর পর আবার করা হয় কুমারীপূজা। পুষ্পাঞ্জলি ও প্রসাদ বিতরণ শেষে বেলা সাড়ে ১০টায় কুমারীপূজা এবং বিকাল ৪টা ৫ মিনিট থেকে ৪টা ৫৩ মিনিটের মধ্যে সন্ধিপূজার মধ্য দিয়ে শেষ হয় মহাষ্টমীর আনুষ্ঠানিকতা।
শাস্ত্রমতে, এক বছর বয়সী কন্যাকে সন্ধ্যা, দুইয়ে সরস্বতী, তিনে ত্রিধামূর্তি, চারে কলিকা, পাঁচে সুভাগা, ছয়ে উমা, সাতে মালনী, আটে কুজ্বিকা, নয়ে কালসন্দর্ভা, দশে অপরাজিতা, এগারোয় রুদ্রাণী, বারোয় ভৈরবী, তেরোয় মহালক্ষ্মী, চৌদ্দতে পীঠ নায়িকা, পনেরোতে ক্ষেত্রজ্ঞা এবং ষোলো বছরে তাকে অন্নদা নামে অভিহিত করা হয়।
এবারের কুমারী হয় উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী দেবদ্রিতা চক্রবর্তী শ্রেষ্ঠা। তার বয়স ছয়। এ জন্য এবার ‘উমা’ নামে কুমারীপূজা হয়। ভক্তরা উলুধ্বনি ও ঢাকের তালে কুমারীপূজায় শামিল হন। প্রায় ৪০ মিনিটি ধরে চলে এ পূজা। এরপর পুষ্পাঞ্জলি হয় এবং প্রসাদ বিতরণ হয়।
পুরাণমতে, দুর্গা দেবী কুমারীরূপেই আবির্ভূত হয়েছিলেন দেবতাদের সামনে। সেই রীতি বহন করেই মহাষ্টমীর সকালে কুমারীপূজার আয়োজন করা হয়। মহাষ্টমীর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ এই কুমারীপূজা। যেখানে একজন কুমারীকে মহাষ্টমীর দিন ভোরে গোসল করিয়ে নতুন কাপড় পরানো হয়। তাকে সাজিয়ে কপালে সিঁদুর, পায়ে আলতা ও হাতে ফুল দেওয়া হয়। এরপর কুমারীকে সুসজ্জিত আসনে বসিয়ে ষোলো উপাদান দেবীজ্ঞানে পূজা করা হয়। এ সময় চারদিক শঙ্খধ্বনি, ঢাকের বোল, উলুধ্বনিতে মুখর হয়ে ওঠে।
রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ মহারাজ বলেন, আধুনিক পৃথিবীতে সামাজিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সংকট নিরসন করে অগ্রগামী হতে হলে মাতৃজাতির প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা উচিত। জগতের অনেক স্থানে নারীকে সম্মান দেওয়া হয় পত্নীরূপে বা সহকারিণীরূপে। কিন্তু নারীর সবচেয়ে মহিমময় রূপ তার মাতৃরূপ। তাই আজকের এই মহাষ্টমী তিথিতে আমরা জগতের সব মাতৃজাতিকে উদ্দেশ্য করে কুমারী মাতাকে প্রণাম জানাই। তার মাধ্যমে আদ্যাশক্তিকে আমাদের প্রণাম নিবেদন করি।
কুমারীপূজা করার কারণ হিসেবে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের মহারাজ স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের বক্তব্য তুলে ধরে বলেন, সব নারী ভগবতীর একেকটি রূপ। শুদ্ধাত্মা কুমারীতে ভগবতীর বেশি প্রকাশ। কুমারীতে দেবীভাব আরোপ করে ঈশ্বরের আরাধনা করা হয়। এর মাধ্যমে সব নারী জাতিকে সম্মান জানানো হয়।
আজ মঙ্গলবার বিহিতপূজার মাধ্য দিয়ে শুরু হবে মহানবমীর আরাধনা। আগামীকাল বুধবার বিজয়া দশমীতে দর্পণ বিসর্জনের পর প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে শেষ হবে এবারের দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা।
হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, দশভুজা দেবী দুর্গা অসুর বধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতি শরতে কৈলাস ছেড়ে কন্যারূপে মর্ত্যলোকে আসেন। সন্তানদের নিয়ে পক্ষকাল পিতার গৃহে কাটিয়ে আবার ফিরে যান দেবালয়ে। আশ্বিন শুক্লপক্ষের এই ১৫টি দিন দেবীপক্ষ, মর্ত্যলোকে উৎসব।