শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত ‘শবে বরাত’ নামে প্রসিদ্ধ। শব্দ দুটি ফারসি ভাষা থেকে এসেছে। ‘শব’ মানে রাত, ‘বরাত’ মানে মুক্তি। আরবি শব্দ ‘বারাআতে’র অর্থও মুক্তি। তাই শবে বরাত অর্থ হবে মুক্তির রাত। তবে হাদিসে এ রাতকে ‘শবে বরাত’ নামে আখ্যায়িত করা হয়নি। বরং একে ‘নিসফ শাবান’ বা ‘শাবান মাসের মধ্য দিবসের রজনী’ বলা হয়েছে। সাথে এও বলা হয়েছে- এটি এমন একটি রাত, যে রাতে বান্দাকে তার প্রতিপালক গোনাহ থেকে মুক্তি দিয়ে ক্ষমা করে দেন।
হাদিস গ্রন্থে এসেছে, মুআজ ইবনে জাবাল রা: থেকে বর্ণিত, নবী করিম সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা অর্ধশাবানের রাতে (শবে বরাত) মাখলুকাতের দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ (ইবনে হিব্বান : ৫৬৬৫, ইবনে মাজাহ: ১৩৯০ ও মুসনাদে আহমদ : ৪/১৭৬)
অনেকে এই হাদিসটিসহ শাবানের রাতের সব হাদিসকে অস্বীকার করেন এবং ‘শবে বরাত’কে বিদআত বলেন। কিন্তু ইমাম মুনযিরী, ইবনে রজব, নূরুদ্দীন হাইসামী, কাসতাল্লানী, যুরকানী এবং অন্যান্য হাদিস বিশারদও এ হাদিসকে সহিহ বলেছেন। শুধু তাই নয়; বর্তমান সময়ের প্রসিদ্ধ শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী রহ:-ও সিলসিলাতুল আহাদিসিস সাহিহাহ গ্রন্থে এই হাদিসের সমর্থনে আরো আটটি হাদিস উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন, এসব রেওয়ায়াতের মাধ্যমে সমষ্টিগতভাবে এই হাদিসটি নিঃসন্দেহে সহিহ প্রমাণিত হয়। তারপর আলবানী রহ: ওইসব লোকের বক্তব্য খণ্ডন করেন, যারা কোনো ধরনের খোঁজখবর ছাড়াই বলে দেন যে, মধ্য শাবানের রজনী তথা শবে বরাতের ব্যাপারে কোনো সহিহ হাদিস নেই। (সিলসিলাতুল আহাদিসিস সাহিহাহ: ৩/১৩৫-১৩৯)
সুতরাং যারা বলেন, ‘শবে বরাত’ বলে কিছু নেই তাদের দাবি অসঠিক। কারণ ‘শবে বরাত’ শব্দটি নেই বটে কিন্তু এর দ্বারা যে ‘নিসফ-শাবান’ রাতকে বুঝানো হয় তার কথা তো হাদিসে রয়েছে।
পক্ষান্তরে অনেকে এটিকে ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রজনী মনে করেন। একইসাথে বলেন, এ রাতেই বান্দার ভাগ্য নির্ধারিত হয়। তারা এর প্রমাণ স্বরূপ কুরআনের এই আয়াতটি দেখান। আল্লাহ বলেন, ‘হা-মিম! শপথ! উজ্জ্বল কিতাবের, নিশ্চয়ই আমি তা নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে; নিশ্চয়ই আমি ছিলাম সতর্ককারী। যাতে সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়। এ নির্দেশ আমার তরফ থেকে, নিশ্চয়ই আমিই দূত পাঠিয়ে থাকি।’ (সূরা-৪৪ দুখান, আয়াত: ১-৫)। ইকরিমা রহ:-সহ কয়েকজন তাফসিরবিদ এই আয়াতকে ‘শবে বরাতে’র সম্পর্কিত দাবি করলেও কুরআনের অন্য আয়াতগুলো বলে ভিন্ন কথা।
কেননা, আমরা জানি- পবিত্র কুরআন রমজান মাসে নাজিল হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘রমজান মাস! যে মাসে কুরআন নাজিল হয়েছে মানবের দিশারিরূপে ও হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শন হিসেবে।’ (সূরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৫) অন্যত্র বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি এটি (কুরআন) নাযিল করেছি ‘লাইলাতুল কদরে। আপনি কি জানেন কদরের রাত কী? লাইলাতুল কদর হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম।’ (সূরা আল কদর, আয়াত : ১-৩)
উল্লিখিত দুটি সূরার প্রথমটিতে স্পষ্ট করা হয়েছে যে, কুরআন রমজান মাসে অবতীর্ণ হয়েছে আর দ্বিতীয় সূরায় বলা হয়েছে, কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে লাইলাতুল কদর বা কদরের রাতে। এখানে দুই আয়াতের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। কেননা, প্রথম আয়াত যে মাসটির (রমজান) কথা উল্লেখ করেছে ওই মাসেরই একটি রাত হলো- লাইলাতুল কদর তথা শবে কদর।
আর সূরা দুখানে ‘আমি তা নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে’। এখানে ‘বরকতময় রাত’কে শবে বরাতে নেয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। কারণ, সর্বসম্মিতক্রমে কুরআন রমজান মাসে ও রমজানের কদরের রাতে অবতীর্ণ হয়েছে। তাই দুখানের আয়াতে যে ‘বরকতময় রাত’ উল্লেখ করা হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে লাইলাতুল কদর। আর ওই রাতেই সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়। কুরআনের বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা এটাই দেখতে পাই।
সুতরাং যারা বলে, ‘শবে বরাত’ নেই তারা যেমন ভুল করেন, ঠিক তেমনি যারা শবে বরাতকে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও ভাগ্যনির্ধারণী রাত মনে করেন তারাও ভুলের মধ্যেই আছেন। মধ্যমপন্থা হলো- ‘শবে বরাত’ তথা শাবানের মধ্যরজনী একটি বরকতপূর্ণ রজনী যে রাতে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের গোনাহ মাফ করেন। কাজেই গোনাহর বোঝা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আজকের এই রাতে মহান আল্লাহর দরবারে তাঁর ক্ষমা লাভের প্রত্যাশী হওয়াই আমাদের কর্তব্য।
লেখক : তরুণ আলেম ও সাংবাদিক