জন্মসূত্রে মানুষ রাজনৈতিক জীব। একটি শিশু জন্মগ্রহণের পরই তার খাদ্য-বস্ত্র-আবাসনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। আল্লাহ প্রদত্ত খাদ্যের মাধ্যমে শিশুর খাদ্যের চাহিদা পূরণ হলেও তার পরিধেয় বস্ত্র ও আবাসনের জন্য কাপড় ও গৃহের প্রয়োজন পড়ে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বস্ত্র, গৃহ তৈরির উপকরণ ও গৃহসজ্জার আসবাবপত্রের জন্য অর্থের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। আধুনিক অর্থব্যবস্থা রাজনৈতিক কার্যক্রমের বিশেষ উপকরণ। যেখানে অর্থ আছে সেখানে রাজনীতি আছে। সে কারণে অর্থনীতি সচেতন ব্যক্তিরাই বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক সুবিধা পেয়ে থাকে। অপর দিকে, রাজনৈতিকভাবে অসচেতন ব্যক্তিরা বিভিন্নভাবে পদে পদে অর্থনৈতিকভাবে শোষিত ও নিগৃহীত হয়ে থাকে।
বর্তমান পৃথিবীতে বেশির ভাগ উন্নত রাষ্ট্রের জনসাধারণ রাজনৈতিকভাবে অধিক সচেতন যে কারণে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের চলমানতায় সমাজ ও রাষ্ট্রের যেকোনো পদক্ষেপে তারা ব্যক্তি, দেশ ও জাতীয় স্বার্থে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। ফলে যেকোনো সংস্থা বা সরকারের পক্ষে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হলে তাদের হাজারবার ভাবতে হয়। সে কারণে এ সব দেশে জনবান্ধব বা জনকল্যাণমুখী পদক্ষেপ গৃহীত হয়ে থাকে। আমাদের দেশ তুলনামূলকভাবে শিক্ষায় পশ্চাৎপদ। তদুপরি রাজনৈতিকভাবে আমাদের দেশের জনসাধারণ অনেক ক্ষেত্রে অসচেতন।
রাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দায়িত্ব হলো দেশের সাধারণ মানুষকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। অথচ আমাদের দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তি ও বুদ্ধিজীবীরা দেশের সাধারণ মানুষকে সুকৌশলে ও সুচতুরভাবে রাজনৈতিক সচেতনতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে বিভিন্ন প্রকার কলাকৌশল অবলম্বন করে থাকেন। তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুল তথ্য ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্যের মাধ্যমে জনসাধারণকে প্রকৃত তথ্য ও সত্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে সদা তৎপর থাকেন। ফলে জনসাধারণ জীবন ও জীবিকার অধিকার আদায়ে সর্বদা বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির শিকার হয়ে থাকেন। আমাদের দেশের বেশির ভাগ খাতে কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণী রাজনৈতিক অসচেতনতার কারণে বিভিন্নভাবে অধিকারবঞ্চিত। আমরা জানি, আমাদের দেশের কৃষি খাত দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার। অথচ দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ কৃষক। সে কারণে বলা যায়, কৃষির উন্নতি মানেই দেশের উন্নতি। অথচ আমাদের দেশের কৃষকরা রাজনীতিসচেতন না হওয়ার কারণে প্রতি পদে অধিকার থেকে বঞ্চিত, শোষিত ও নিগৃহীত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আধুনিক কৃষিব্যবস্থায় রাসায়নিক সার অপরিহার্য।
পণ্যের অধিক উৎপাদনের জন্য বেশির ভাগ কৃষক জমিতে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে থাকেন। অথচ আশ্চর্যের বিষয় এই, কৃষকের অসচেতনতার কারণে অতীব প্রয়োজনীয় এই কৃষি উপকরণ ব্যবহারে কৃষক নানাভাবেই হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কৃষকদের অধিক মূল্যে সার ক্রয় করে কৃষিজ ফসলাদি উৎপাদন করতে হয়। তদুপরি অসচেতনতার সুযোগ গ্রহণ করে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফা অর্জনের লোভে ভেজাল সার সরবরাহ করে কৃষকদের প্রতারিত করে থাকেন যে কারণে কৃষিপণ্যের উৎপাদন কমে যায়।
অপর দিকে, উৎপাদিত কৃষিপণ্য বাজারে বিক্রি করার সময় মধ্যস্বত্বভোগী বা দালালরা স্বল্পমূল্যে কৃষকের কাছ থেকে কৃষিপণ্য ক্রয় করে উচ্চমূল্যে বাজারে বিক্রি করে থাকেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এক কেজি সবজি বিক্রি করে কৃষক যেখানে ২০ টাকা মূল্য পেয়ে থাকেন, সেই সবজিই শহরে স্থানভেদে ৪০-৫০ অথবা ৬০ টাকা দরে বিক্রি হয়ে থাকে।
ফলে কৃষকের কষ্টার্জিত কৃষিপণ্যের মাধ্যমে নিজ জীবন যাপন দুরূহ হয়ে পড়ে। আবার কৃষক যদি তাদের অধিকার আদায়ের জন্য সংঘবদ্ধ হয় সেখানে অনেক ক্ষেত্রে মাস্তান বাহিনী ও পুলিশ বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। আমরা জানি, বিগত সময়ে কুড়িগ্রামে ও জামালপুরে সারের দাবিতে আন্দোলনরত কৃষকদের ওপর গুলি চালিয়ে ১২ কৃষককে হত্যা করা হয়। এভাবে প্রতিনিয়ত এ দেশের কৃষককুল কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে টাউট বাটপাড় ও পুলিশি শক্তির মাধ্যমে নিগৃহীত হয়ে থাকেন।
রাজনৈতিক অসচেতনতার কারণে এ দেশের কৃষককুল নিজেদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ব্যাপকভাবে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত হতে পারছে না। কৃষির পর বস্ত্র খাত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম মাধ্যম। তৈরী পোশাক শিল্পের মাধ্যমে সরকার বিদেশ থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে। পোশাক শিল্পে আমাদের দেশে লাখ লাখ শ্রমিক-কর্মচারী নিয়োজিত যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে আমাদের দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়ে থাকে। অথচ আমাদের দেশের পোশাক শ্রমিকরা বিভিন্নভাবে প্রতারিত ও নির্যাতিত। ন্যূনতম মজুরির ভিত্তিতে মালিক পক্ষ ও সরকারি লোকেরা তাদের কাছ থেকে অধিক শ্রম গ্রহণ করে থাকে। জীবন ও জীবিকার তাগিদে অধিকারবঞ্চিত এ সব পোশাক শ্রমিক দেশ ও রাষ্ট্রের জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করে চলেছেন। অথচ আমাদের দেশের সুশীলসমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের বিষয়ে কোনো বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না।
উপরন্তু এ সব শ্রমিক যদি কখনো তাদের ন্যায্য পারিশ্রমিকের দাবিতে সংঘবদ্ধ হয়, তখন তাদের ওপর মাস্তান ও পুলিশ বাহিনী বিভিন্ন প্রকার অত্যাচার ও নির্যাতন চালিয়ে থাকে যা নাগরিক ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। বাংলাদেশের অন্যতম অর্র্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যম সাদা সোনা বা চিংড়ি মাছ। আমাদের সাধারণত সমুদ্র উপকূলের এলাকাসমূহে এই চিংড়ি চাষ হয়ে থাকে। অনুক‚ল পরিবেশে সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে চিংড়ি চাষ করলে অনেক ফলন আশা করা যায়।
বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলের মানুষ অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে এই চিংড়ি চাষ করে থাকেন। কারণ সমুদ্র উপকূলে জলদস্যু ও বনদস্যুদের তাণ্ডব অনেক বেশি। অনেক ক্ষেত্রে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র উপকূলের মানুষ সাদা সোনা বা চিংড়ি চাষ করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রেখে থাকেন। অথচ বর্তমানে রাজনৈতিক অসচেতনতার কারণে এক শ্রেণীর দুষ্কৃতকারী রফতানিযোগ্য এই পণ্যে অপদ্রব্য পুশ করে ওজনে ভারী করে অধিক মুনাফার আশায় বিদেশে রফতানি করে থাকে। বিদেশীরা এ সব অপদ্রব্যমিশ্রিত অখাদ্য চিংড়ি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমাদের দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। পরিণতিতে বাংলাদেশ চিংড়ি রফতানিতে বিদেশের বাজার হারিয়ে ফেলছে। দেশের অর্থনীতিতে তার বিরূপ প্রভাব পড়ছে। মাছের বাজারদর পড়ে যাচ্ছে।
পরিণতিতে চিংড়ি চাষে নিয়োজিত ব্যাপক শ্রেণীর মানুষ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতে দৈন্যদশা সৃষ্টি হচ্ছে। এভাবে দেশের সব ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক অসচেতনতার কারণে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ পদে পদে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। বর্তমানে সুশীলসমাজ ও সৃজনশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ওপর দায়িত্ব এ দেশের সাধারণ মানুষকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা।
লেখক : গবেষক, কলামিস্ট