ঘূর্ণিঝড় মোখা বাংলাদেশ থেকে চলে গেছে। মহাবিপদ সংকেতও আর নেই। কোনো প্রাণহানির হয়নি। তবে সেন্টমার্টিনে একজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছে সেন্টমার্টিন, টেকনাফ ও শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দারা। বিশেষ করে গরীব ও নিম্নবিত্তদের কাঁচা ঘরবাড়ি একেবারে বিধ্বস্ত হয়েছে এ ঘূর্ণিঝড়ে। সবমিলিয়ে ঝড়ের প্রভাবের শিকার হয়েছে তিন লাখ ৩৪ হাজার মানুষ।
ঘূর্ণিঝড় মোখা সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে। সেখানের অনেক এলাকা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। সিত্তওয়ে শহরে বিদ্যুৎ ও টেলিফোন সংযোগও বিচ্ছিন্ন।
মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বিরোধী এনইউজে সরকারের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঝড়ে ইরাবতী ও মান্দালায়ে পাঁচজন নিহত হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান জানান, বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে বিভিন্ন প্রস্তুতি নেয়া হয়। প্রায় আড়াই লাখ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নেয়।
সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হয় সেন্টমার্টিন ও টেকনাফ ঘিরে। সেন্টমার্টিনে ঝড়ের সময় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ১৫০ কিলোমিটার। তবে সন্ধ্যার পর বৃষ্টি ও বাতাস কমে এলে মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ঘরে ফিরতে শুরু করে।
এরপর আবহাওয়া অফিস বিশেষ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে মহাবিপদ সংকেত নামিয়ে দেয়।
‘মানুষ এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে’
আবহাওয়া অফিস জানায়, তাদের অনুমান অনুযায়ী সন্ধ্যার পর ঘূর্ণিঝড় মোখা দুর্বল হতে থাকে এবং রাত ৮টার পর বাংলাদেশ সীমানায় এটির আর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। যে ভারী বর্ষনের শঙ্কা ছিল তাও আর নেই।
আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক আজিজুর রহমান বলেন, ‘এটা আরেকটু টেকনাফের দিকে এলে বর্ষণ বেশি হতো। সেক্ষেত্রে ভূমিধসের শঙ্কাও ছিল। কিন্তু আপাতত আর সেই শঙ্কা নেই। মানুষ তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে।’
তবে আগামী ২৪ ঘণ্টা সাগরে বিচরণ না করার নির্দেশ আবহাওয়া অধিদফতরের। এছাড়া স্বাভাবিক বৃষ্টির একটা পূর্বাভাস দিচ্ছে আবহাওয়া অফিস।
কক্সবাজার থেকে বিবিসি বাংলার সংবাদদাতা শাহনেওয়াজ রকি জানান, মানুষ এরই মধ্যে সাইক্লোন শেল্টার ছেড়ে যার যার বাড়িতে চলে গেছে।
জীবননাশ হয়নি কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে বড় ক্ষতি
সেন্টমার্টিনে এখন একটি কাঁচা ঘরেরও অস্তিত্ব নেই। একই অবস্থা শাহপরীর দ্বীপেও।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক জানান, প্রাথমিকভাবে তারা ধারণা করছেন যে প্রায় দুই হাজার ঘরবাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে আর ১০ হাজার ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এছাড়া কক্সবাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে পাঁচ শতাধিক ঘর পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
সেন্টমার্টিনে গাছ থেকে নারকেল পড়ে এক নারী মাথায় আঘাত পান। মাথায় সেলাই ও প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তিনি সুস্থ আছেন বলে জানান সেখানকার হাসপাতালের কর্মচারী আব্দুল কাদের।
আব্দুল কাদের বলেন, ‘মানুষজন ভালো আছে। কিন্তু ঘরবাড়ির অস্তিত্ব নেই, সব তছনছ। আমরা সবাই গরীব মানুষ, আমাদের কিচ্ছু নেই।’
সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা আবদুল আজিজ জানান, কাঁচা ঘর ছাড়াও কাঠের যে সমস্ত রিসোর্ট ছিল, সেগুলো লণ্ডভণ্ড হয়েছে। অনেক বাড়ি গাছ পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ফলে এখন যেসব বাড়ি ভালো আছে, সেখানে আত্মীয়-স্বজন সবাই মিলে থাকছে বলে জানান তিনি। এছাড়া আশ্রয়েকেন্দ্রেও আছে অনেকে। আবার কেউ কেউ মসজিদে গিয়েও আশ্রয় নিয়েছে।
সরকারি সাহায্যের অপেক্ষা
সেন্টমার্টিনে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করা আব্দুল কাদের বলেন, অনেক মানুষ ঘরে ফিরলেও চুলা জ্বালিয়ে রান্না করে কিছু খাওয়ার মতো অবস্থা নেই তাদের। কারো কারো শুকনা খাবারও শেষ পর্যায়ে। সবাই এখন সরকারি ত্রাণের আশায় আছে।
ঘূর্ণিঝড় মোখা কাভার করতে কক্সবাজারে আছেন বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিক মোহসীন উল হাকিম। তিনি বলেন, মানুষ সচেতন হয়েছে। তাই জীবননাশ হয়নি, কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষতিটা বেশ বড়।
মোহসীন উল হাকিম বলেন, ‘সরকারি হিসেবে যদি দুই হাজার ঘর হয়, মানে দুই হাজার পরিবার। আর ঘর যেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেগুলো ৫০ হাজার বা দুই লাখেও মেরামত করা যাবে না, এটা তাদের অনেক বড় ক্ষতি।’
আব্দুল কাদের বলেন, মানুষ ভীষণ ভয় পেয়েছে। তাই এ মানসিক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ হবে তাদের জন্য।
অনেক শিশুর পাতলা পায়খানা দেখা যাচ্ছে। আবার ঝড়ো বাতাসে ঠান্ডাও লেগেছে অনেকের। তিনি মনে করেন, জরুরি সহায়তা এখন প্রয়োজন সেন্টমার্টিনে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আমাদের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি সেন্টমার্টিনে। সেখানে এখনো যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হয়নি। যাওয়ার উপযোগী আবহাওয়া হলে আমরা সেখানে ত্রাণ নিয়ে যাব, যা বরাদ্দ আছে সেগুলো দেব।’
ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি মিয়ানমারেও
বাংলাদেশ থেকে ঝড় সরে যেতে থাকে মিয়ানমারের উপকূলীয় এলাকা দিয়ে। এ সময় ভারী বৃষ্টি ও ব্যাপক ঝড়ো বাতাস হতে থাকে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, সেখানে বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২১০ কিলোমিটার।
দেশটির সেনাবহিনীর প্রকাশ করা ছবিতে দেখা গেছে, রাখাইন রাজ্যের থানদউয়ে বিমানবন্দরে একটি ভবন ধসে পড়েছে। সেখানকার বিদ্যুতের ট্রান্সফর্মার ভেঙ্গে পড়েছে।
সিত্তওয়ে শহরের বাসিন্দারা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বহু বাড়িঘরে পানি ঢুকে যায়।
ভিডিওতে দেখা যায়, বেশ উচ্চতায় স্রোত আসতে থাকে এবং রাস্তায় পানি ঢুকে যায়। একটা মোবাইল ফোনের টাওয়ার উপড়ে পড়তে দেখা যায়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা যায়, বাড়ি-ঘরের ছাদ উড়ে যাচ্ছে ও বিলবোর্ডগুলোও সব খসে পড়ছে।
এছাড়া মিয়ানমারের বিভিন্ন এলাকায় বাড়িঘর ও ভবনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
মোখায় ক্ষতিগ্রস্তদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকার কথা জানিয়েছে মিয়ানমারে কর্তব্যরত জাতিসঙ্ঘ। তারা বলছে, ওই এলাকার অন্তত ৬০ লাখ মানুষ আগে থেকেই দারিদ্র্য ও সঙ্ঘাত-সহিংসতার কারণে মানবিক সহায়তার ওপর টিকে আছে।
ফলে ওই মানুষগুলোর ওপর ঘূর্ণিঝড় মোখা মরার ওপর খাড়ার ঘায়ের মতো দেখা দিতে পারে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সংস্থাটির আশঙ্কা, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ভারী বৃষ্টিপাত, ভূমিধস ও বন্যা দেখা দিতে পারে।
তবে জরুরি ত্রাণের জন্য জরুরি তহবিলের প্রয়োজন বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো।
সূত্র : বিবিসি