নিউইয়র্কে এখন সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাড়িভাড়া। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না এই খাত। করোনার ছোবল কাটিয়ে ওঠা মানুষগুলোর ওপর এখন যেনো বাড়ি ভাড়ার ছোবল। মালিকেরা ভাড়া বাড়িয়ে দিচ্ছেন কথায় কথায়। এতে নগরবাসীর জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে থেকে বাসা ভাড়া বেড়ে রেকর্ড পর্যায় পৌঁছে যায়। এর পর থেকে বেড়েই চলছে। আর নিজের রেকর্ড নিজেই ভাঙছে নিউইয়র্ক।
এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের সামর্থ্যের মধ্যে বাসা পেতে বা মানিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছেন ভাড়াটিয়ারা। নগরের বোরো গুলোতে ভাড়া বাড়ার চিত্র এখন যে কারো জন্য আতঙ্কের। একটি নতুন রিপোর্ট বলছে, ম্যানহাটন এক টানা দ্বিতীয় মাসেও ভাড়া বৃদ্ধির রেকর্ড গড়েছে। এখানে গড়ে ভাড়া মার্চ মাসে ৪,১৭৫ ডলার ছিলো যা এপ্রিলে বেড়ে ৪ হাজার ২০০ ডলার হয়ে যায়। বছর বছর ম্যানহাটনে ভাড়া বাড়ে গড়ে ৮ শতাংশ করে। কিন্তু নতুন লিজ গুলোতে এই বৃদ্ধির হার এখন ১৪ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এখানকার এক বেডরুমের ভাড়া ৪,৩০০ ডলারের নিচে মিলছে না। আর স্টুডিও এপার্টমেন্ট পেতে হলে গুনতে হচ্ছে গড়ে ৩,৩০০ ডলার।
ব্রুকলীনে কিছুটা সস্তা কিন্তু সেখানেও ভাড়ায় পরিবর্তন আসছে বড় হারে। এখানে বছরে ভাড়া বাড়তো ১৫ শতাংশ হারে যা নতুন সময়ে নতুন লিজে বেড়ে যাচ্ছে ২৪ শতাংশ হারে। এমনকি বাড়িভাড়া নবায়নেও এই হার প্রযোজ্য হচ্ছে। এপ্রিলে ব্রুকলীনে বাড়ি ভাড়া দেখা গেছে গড়ে ৩৫০০ ডলার যা আগের বছরে ছিলো ২৯০০ ডলার। এখানে এক বেডরুমের বাসা এখন মিলবে ৩,৫০০ ডলারে। কুইন্সে আগে বছরে ভাড়াবৃদ্ধির হার অনেক কম ছিলো। যা এখন ১৩ শতাংশ হারে বাড়ছে। এই অঞ্চলে বাড়ি ভাড়া গড়ে ৩,৫০০ ডলার। ভাড়াবৃদ্ধির এই চক্করে পড়ে নিউইয়র্কবাসী হিমশিম খাচ্ছেন। নতুন কেউ এই শহরে বাসাভাড়া নিতে সাহস করছেন না। বাড়িভাড়া ও ম্যানহাটনে একটি বিক্ষোভ্।
নিউইয়র্কের চায়না টাউনের অধিবাসীরা বাড়ি ভাড়া কমানোর দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন আরো আগেই। দুই সপ্তাহ আগে এক প্রতিবাদ র্যালিতে যোগ দিয়ে মেয়র এরিক অ্যাডামসের প্রতি বাড়ি ভাড়া কমানো উদ্যোগের আহ্বান জানিয়েছেন তারা। এসময় লিও সুজিন নামে চায়না টাউনের একজন সাবেক গার্মেন্ট শ্রমিক জানান, ২০ বছর ধরে এখানে কাজ করেছেন। তার কাজ খুব কঠিন ছিলো কিন্তু আয় বেশি ছিলো না। এখন অবসর কালে মাত্র ৬৮০ ডলার ভাতা পান সুজিন। অথচ তার বাসা ভাড়াই ১৬৭০ ডলার।
সুজিন বলেন, সে জন্য আমি এখানে ভাড়া কমানোর প্রতিবাদ নিয়ে এসেছি। আমরা বাসা ভাড়া অনেক বেশি আর আয় অনেক কম। আর আমার কাছে ভাড়া দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত অর্থও নেই। সুজিন আরো বলেন, আমি হোমলেস হতে চাই না। আমার যদি জীবন থাকে, তাহলে আমাকে আমার ঘর ভাড়া দেওয়ার সামর্থ্যও থাকতে হবে। এসময় প্রতিবাদে অংশগ্রহণকারীরা ভাড়া কমানোর দাবিতে স্লোগান দিতে রেন্ট রোল ব্যাক রেন্ট রোল ব্যাক বলে স্লোগান দিতে থাকেন। ভাড়ার খাড়া ছোট ছোট ব্যবসার ওপরও নিউইয়র্কে প্যানডেমিকের ধাক্কা সামলে উঠে নগরীর ছোট ছোট ব্যবসায়ী উদ্যোগগুলো যখন আবার একটু দাঁড়াতে শুরু করেছে তখনই আসছে এক নতুন ধাক্কা। এই ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোর দোকান কিংবা ঘর ভাড়া বাড়ছে হু হু করে। বিভিন্ন কমিউনিটির ছোটো ছোট উদ্যোক্তরা এতে জটিল সমস্যার মুখে পড়ছেন।
জ্যাকসন হাইটস, কুইন্স, ব্রুকলীন, ব্রঙ্কস, জ্যামাইকা, এস্টোরিয়ার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে একই চিত্র দেখা গেছে। কোভিড পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে দোকান পাটের ভাড়া ১০ থেকে ১১ শতাংশ বেড়েছে। এখন বছর বছর এই ভাড়া বাড়াচ্ছেন দোকানগুলোর মালিকপক্ষ। ডিপার্টমেন্ট অব ফিন্যান্সের একটি নতুন বিশ্লেষণে দেখানো হয়েছে কৃষ্ণাঙ্গ, ল্যাটিনো ও এশীয় ঘনবসতির এলাকাগুলোতেই ভাড়া বাড়ানোর ঘটনা বেশি ঘটছে। প্যানডেমিকের সময়ে যেসব ছোট ব্যবসায়ী কোনো ঋণ কিংবা আর্থিক সহযোগিতা পান নি তারা এই ভাড়া বাড়ার ঘটনায় উদ্বিগ্ন। আর এধরনের বাণিজ্যিক ভাড়াটিয়াদের জন্য কোনো সুরক্ষা না থাকার কারণে এখন তাদের ব্যবসা বন্ধ হবার উপক্রম। অথচ প্যানডেমিকের সময়ে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে ফের চাঙ্গা করে তুলতে এই ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে।
নিউইয়র্কে মাইনরিটি কমিউনিটিগুলোর ইমিগ্র্যান্টরাই এসব ছোট ব্যবসার মালিক। আর তাদের উদ্যোগগুলোর কারণেই এখানে মধ্যবিত্তরা হাতের নাগালের মধ্যে তাদের প্রযোজনীয় সামগ্রী পেয়ে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট গ্রুপ ছায়া’র পরিচালক অনিতা সিচারনকে উদ্ধৃত করে দ্যা নিউইয়র্ক টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সংখ্যালঘুরা ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ পাচ্ছেন না। আর তাদের এক নম্বর সমস্যাই হচ্ছে দোকান ভাড়া বৃদ্ধি।
২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়ের সবশেষ প্রাপ্ত ড্যাটা বলছে, ওই দুই বরছে ব্রুকলীনে দোকানপাটে প্রতি বর্গফুটের ভাড়া ২৩ শতাংশ বেড়ে যায়, ব্রঙ্কসে এই হার ছিলো ১৪ শতাংশ আর কুইন্সে ৯ শতাংশ। স্ট্যাটান আয়ল্যান্ড এই সময় ভাড়া বাড়ে নি। তবে ম্যানহাটনে ভাড়া ১১ শতাংশ কমানো হয়। ডিপার্টমেন্ট অব ফাইন্যান্সের ড্যাটা বিশ্লেষণ করে জানায় অ্যাসোসিয়েশন ফর নেইবারহুড অ্যান্ড হাউজিং ডেভেলপমেন্ট।
কুইন্সের বেশ কিছু অংশে এই ভাড়া ৩৮ শতাংশ বেড়েছে। আর ব্রঙ্কসের কনকোর্স ও হাই ব্রিজসহ বিভিন্ন অংশে এই বৃদ্ধির হার ৩৩ শতাংশ। অথচ কোভিড-১৯ প্যানডেমিকের আগে এসব এলাকায় বছরে দোকান ভাড়া ৩ শতাংশের বেশি হারে বাড়ার নজির নেই। অ্যাসোসিয়েশন ফর নেইবারহুড অ্যান্ড হাউজিং ডিপার্টমেন্টের একটি জরিপে দেখানো হয়েছে কুইন্সের দুই-তৃতীয়াংশ ব্যবসায়ীই জানাচ্ছেন গত বছরে তাদের ভাড়া অন্তত ১০ শতাংশ বেড়েছে।
সিটি মেয়র অফিসের মুখপাত্রের বরাতে ওই খবরে বলা হয়েছে, ছোট ব্যবসায়ীরা যাতে টিকে থাকতে পারে তার জন্য সম্ভাব্য সকল প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। মেয়র কার্যালয় থেকে কমার্শিয়াল লিজ অ্যাসিট্যান্স প্রোগ্রামের আওতায় এই সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। ছোট ব্যবসা-উদ্যোগকে আইনি সহায়তা দিতেই এই কর্মসূচি। যার মাধ্যমে এরই মধ্যে ২০০০ ব্যবসায়ী উদ্যোগে সহায়তা দেওয়া হয়েছে বলে জানান ওই নারী মুখপাত্র। তবে দোকান ভাড়া বাড়লেও নিউইয়র্কে নতুন ব্যবসা খোলারও হিড়িক পড়ে গেছে। ইউএস চেম্বার অব কমার্সের একটি উপাত্ত জানাচ্ছে ২০১৯ থেকে ২০২১ পর্যন্ত এখানে নতুন ব্যবসা খোলার আবেদনের সংখ্যা ৩০ শতাংশ বেড়েছে। আর কেবল ব্রঙ্কসে এই বৃদ্ধির হার ৬৬ শতাংশ। সূত্র : সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা