গাজীপুর সিটি নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার ঘোষিত সবকটি কেন্দ্রের ফলাফলে ১৬ হাজারের বেশি ভোটে বিজয়ী হয়েছেন টেবিল ঘড়ি প্রতীকের স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী জায়েদা খাতুন৷
বৃহস্পতিবার দিবাগত স্থানীয় সময় রাত দেড়টা নাগাদ ৪৮০টির সবকটি কেন্দ্রের ফল ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা৷ এরমধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন পেয়েছেন দুই লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট৷ তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান পেয়েছেন দুই লাখ ২২ হাজার ৭৩৭টি৷
অন্য মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে হাতপাখা প্রতীকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী গাজী আতাউর রহমান ৪৫ হাজার ৩৫২ ভোট, হাতি প্রতীকে সরকার শাহনূর ইসলাম ২৩ হাজার ২৬৫ ভোট, মাছ প্রতীকে আতিকুল ইসলাম ১৬ হাজার ৯৭৪ ভোট, লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে জাতীয় পার্টির প্রার্থী এম. এম নিয়াজ উদ্দিন ১৬ হাজার ৩৬২ ভোট পেয়েছেন৷
মোট ভোটারের সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৬৩ জন৷ তার মধ্যে ভোট দিয়েছেন পাঁচ লাখ ৭৫ হাজার ৫০ জন৷ অর্থাৎ, ভোটের হার ছিল ৪৮.৭৫ শতাংশ৷
বৃহস্পতিবার সকাল আটটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত চলে ভোটগ্রহণ৷ নগরীর ৫৭টি ওয়ার্ডে ৪৮০টি কেন্দ্রের সবগুলোতে ইভিএম মেশিনে ভোট দিয়েছেন ভোটাররা৷
খাতাপত্রে জায়েদা বিজয়ী হলেও এই ভোট ছিল মূলত জাহাঙ্গীর ও আজমতের দ্বৈরথ, যার শুরুটা হয়েছিল ২০১৩ সালে গাজীপুর সিটির প্রথম নির্বাচন থেকে।
টঙ্গী পৌরসভার ১৮ বছরের চেয়ারম্যান আজমত সিটি করপোরেশন হওয়ার পর প্রথম নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থনে প্রার্থী হয়েছিলেন। নির্দলীয় প্রতীকের ওই নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে মেয়র প্রার্থী হয়েছিলেন জাহাঙ্গীরও।
ভোটের আগে নাটকীয়ভাবে অন্তর্ধান হওয়ার পর ফিরে এসে জাহাঙ্গীর বিরস বদনে আজমতকে সমর্থনের ঘোষণা দিলেও তাতে দলীয় প্রার্থীর জয় আসেনি। লাখো ভোটের ব্যবধানে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী আবদুল মান্নানের কাছে হেরেছিলেন আজমত।
সিটি করপোরেশন আইন সংশোধনের পর ২০১৮ সালে দ্বিতীয় নির্বাচনে আজমতকে হটিয়ে দলের মনোনয়ন ছিনিয়ে নেন সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর। নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে বিএনপির ধানের শীষের প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারকে হারিয়ে মেয়র হন তিনি।
তবে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে একটি ঘরোয়া আলোচনায় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নিয়ে ‘আপত্তিকর’ মন্তব্য করার অভিযোগ উঠে মেয়র জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে।
আওয়ামী লীগের একটি অংশের ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে জাহাঙ্গীরের দলীয় সদস্যপদ কেড়ে নেয় আওয়ামী লীগ। বরখাস্ত হন মেয়র পদ থেকেও।
এক বছরের বেশি সময় পর ভবিষ্যতে সংগঠনের স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ না করার শর্তে গত ১ জানুয়ারি তাকে ক্ষমা করার কথা জানিয়ে চিঠি দেয় আওয়ামী লীগ।
তবে ভোটের সময় এলে আবার ১০ বছর আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। আওয়ামী লীগ আজমতকে মনোনয়ন দিলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন জাহাঙ্গীর। তবে খেলাপি ঋণের কারণে তার প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যায়। এরপর আবার দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
তার বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করে আসা জাহাঙ্গীর পরিস্থিতি আঁচ করে মা জায়েদা খাতুনের নামেও মনোনয়নপত্র কিনে রেখেছিলেন। আর নিজে প্রার্থী হতে না পারার পর গৃহিনী মাকে নিয়ে ভোটের লড়াইয়ে নেমে যান।
অনেকটা ‘ডামি প্রার্থী’ মায়ের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট হিসেবে প্রচার-প্রচারণা মূলত জাহাঙ্গীরই চালান। আর বয়সে প্রবীণ হলেও রাজনীতিতে নবিশ জায়েদা খাতুনও বলেন, তার এই লড়াই ছেলের জন্য।
আগের নির্বাচনে বিএনপি নেতার কাছে হারলেও এবার বিএনপিবিহীন নির্বাচন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা আজমতের জন্য বড় সুযোগ হিসেবেই দেখছিলেন অনেকে।
ষাটের দশকের শেষভাগ থেকে ছাত্রলীগে যুক্ত আজমত মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের পর শ্রমিক আন্দোলনেও যুক্ত ছিলেন। গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আজমত দলের কেন্দ্রীয় কমিটিরও সদস্য। ফলে তার জয়ের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে প্রচারে নামেন দলীয় নেতারা। একদল অভিনয়শিল্পীকেও দেখা যায় নৌকার পক্ষে প্রচারে নামতে।