আজ ২৩ জুন। নানা ঘাত-প্রতিঘাত আর চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে চুয়াত্তর পেরিয়ে পঁচাত্তর বছরে পা রাখছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। ১৯৪৯ সালের এই দিনে পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেন প্যালেসে প্রতিষ্ঠা লাভ করে দেশের প্রাচীনতম এই রাজনৈতিক দল। দীর্ঘ পথচলায় নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে এসেছে দলটি। তবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এবার কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে টানা তিনবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা এ দল। ক্ষমতায় টিকে থাকা নিয়েও প্রকাশ্যে সভা সমাবেশে সংশয় প্রকাশ করছেন সরকারি দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। এজন্য বিএনপি-জামায়াত এবং আন্তর্জাতিক মহলের ষড়যন্ত্র দেখছে দলটি।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রবীণ রাজনীতিবিদ অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন গতকাল এক প্রতিক্রিয়ায় নয়া দিগন্তকে বলেন, বর্তমানে আওয়ামী লীগ কঠিন সময় পার করছে। কয়েক মাস পরে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক মহলের অনেক চাপ আছে। সরকারের বিরুদ্ধেও নানা ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তিনি মনে করেন, অতীতের মতো বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সকল ষড়যন্ত্র ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আওয়ামী লীগ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। এদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করার পর থেকে আজ অবধি নিরবচ্ছিন্নভাবে শাসনভার আওয়ামী লীগের হাতেই রয়েছে। তবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দেশ-বিদেশে প্রশ্নের মুখে রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। দেশীয়-আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চাপে থাকাবস্থায় সরকার গঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনা করলেও সেই বিতর্ক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি শাসক দলটি। অবশ্য দীর্ঘ শাসনকালে মিয়ানমার ও ভারতের সাথে সমুদ্র সীমানা নির্ধারণ, ভারতের সাথে ঐতিহাসিক ছিটমহল বিনিময় চুক্তি, মেগা প্রজেক্ট মেট্রোরেলের দৃশ্যমান অগ্রগতিসহ দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে নানা সফলতার দিক রয়েছে। বিশেষ করে পদ্মা সেতু নির্মাণ আওয়ামী লীগ এবং তার সরকারের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল। সেই চ্যালেঞ্জ উতরিয়ে গত বছরের ২৫ জুন জমকালো আয়োজনে পদ্মা সেতু উদ্বোধন করা হয়।
এছাড়াও দীর্ঘ পথচলায় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ৬৬ সালের ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম, ৯৭ সালের পার্বত্য শান্তি চুক্তি সম্পাদনসহ দলটির বড় বড় সফলতা থাকলেও কিছু বিতর্কিত কর্মকাণ্ড এমনভাবে কাঁধে চেপে বসেছে যার ফলে সফলতাগুলো অনেকটা ম্লান হয়ে যাচ্ছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন, গত সাড়ে ১৪ বছরে দেশের কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও বিভিন্ন খাতে কিছু সফলতা রয়েছে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু নিত্যপণ্যের বাজারে দামের ঊর্ধ্বগতিতে মধ্যবিত্তের সংসার চালাতে নাকানিচুবানি খেতে হচ্ছে। এছাড়াও বিভিন্ন খাতে দুর্নীতি ও অর্থপাচার সেই সফলতায় ভাটা পড়েছে। বিশেষ করে নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বড় ধরনের চাপের মুখে রয়েছে সরকারি দল। বিশেষ করে বিএনপির অংশগ্রহণে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আওয়ামী লীগ সরকারকে বিশ্বের মোড়ল রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনের কয়েকটি দেশ ও সংস্থা জোরালো তাগিদ দিয়েছে। উন্নয়ন সহযোগী ওই রাষ্ট্র ও সংস্থাগুলোকে এড়িয়ে নিজেদের ইচ্ছেমতো ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মডেলে নির্বাচন করা এবারে একেবারে কঠিন।
তবে সরকারি দলের শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্রনীতি হলো সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়। এই নীতিকে সামনে রেখে এরকম চ্যালেঞ্জ অতীতেও আওয়ামী লীগ মোকাবেলা করেছে। কিছু সময় লেগেছে কিন্তু আওয়ামী লীগ শেষমেষ সফলতা পেয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আন্তর্জাতিক মহলের এই কঠিন চ্যালেঞ্জও এবার আওয়ামী লীগ ধৈর্য সহকারে মোকাবেলা করেই সফলতা পাবে।
দিনব্যাপী কর্মসূচি : এদিকে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দিনব্যাপী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আজ শুক্রবার সূর্যোদয়ক্ষণে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও দেশব্যাপী দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন এবং সকাল ৭টায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন, বেলুন ও পায়রা উড়ানোর মধ্যদিয়ে কর্মসূচির উদ্বোধন। সকাল সাড়ে ১০টায় গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় চিরনিদ্রায় শায়িত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করা হবে।
এছাড়াও প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এদিন বিকেল সাড়ে ৩টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দলের পক্ষ থেকে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সভাপতিত্ব করবেন। গতকাল এক বিবৃতিতে দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ৭৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মসূচি গ্রহণের পাশাপাশি বিভিন্ন সময়োপযোগী কর্মসূচির মাধ্যমে যথাযথ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করার জন্য আওয়ামী লীগ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনের সকল জেলা, উপজেলাসহ সকল স্তরের নেতাকর্মী, সমর্থকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।