-নির্বাচন নিয়ে সমঝোতার পথ খুলছে?
-ইইউর পাশাপাশি ঢাকায় মার্কিন প্রতিনিধিদল
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কূটনৈতিক তৎপরতা বেড়েছে। সফররত ইইউ প্রতিনিধিদলের পাশাপাশি আজ মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ঢাকায় আসার কথা রয়েছে। আগে থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন বিষয়ে সমালোচনা অব্যাহত রেখে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রত্যাশা করছে। যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসানীতিও ঘোষণা করেছে। বিদেশী কূটনীতিকদের এসব তৎপরতা নিয়ে এখন নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে। বিদেশী মধ্যস্থতায় নির্দলীয় সরকার কিংবা নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে কোনো সমঝোতার পথ খুলছে কি না তা নিয়েই বেশ আলোচনা চলছে।
তবে কূটনীতিকদের এই তৎপরতা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ অংশগ্রহনমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে খুব একটা প্রভাব ফেলবে- এমন আশাবাদী হওয়ার মতো এখনো কিছু নেই বলে মনে করছেন অনেক রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক। তাদের মতে, বাইরে থেকে এসে প্রভাব বিস্তার করে নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছে এমন নজির দেখা যায় না। রাজনৈতিক অধিকার পেতে চাইলে নাগরিকদের আন্দোলনের বিকল্প নেই। নিজেদের সমস্যা নিজেরা সমাধানে ব্যর্থ হলে কেউ এসে সমাধান করতে পারবে না।
নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দলগুলোর রাজপথের তৎপরতা বৃদ্ধির পেছনে বিদেশী চাপের প্রভাব কাজ করছে বলে সাধারণ মানুষের মধ্যে বেশ আলোচনা রয়েছে। এর ফলে সরকারের পক্ষ থেকে কিছুটা নমনীয়তাও প্রকাশ পাচ্ছে। সরকারের একাধিক মন্ত্রীর বক্তব্যে নমনীয়তার প্রমাণও মিলছে। এই সুযোগে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য পদক্ষেপ নিতে শক্তিশালী এই দেশগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে বিরোধী দলগুলো। ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সফরের সময়েই আগামী বুধবার প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনরা সরকার পতন ও কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে এক দফার আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করতে যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক মাঠ অনেকটা উত্তপ্ত হয়ে উঠবে বলে মনে করা করা হচ্ছে।
আগামী ডিসেম্বরের শেষে অথবা জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলকে ক্রমেই জোরালো করছে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। সভা-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালন করছে দলগুলো। নির্বাচন সামনে রেখে তৎপরতা বাড়িয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। এর প্রভাবেই সরকারি দল রাজপথে বিরোধীদের কর্মসূচি পালনে লক্ষণীয়ভাবে সহনীয় আচরণ করছে বলে অনেকে মনে করছেন। পাশাপাশি আগামী নির্বাচন অংশগ্রহনমূলক করতে বিদেশী বেশি তৎপরতা ফলপ্রসূ হবে এমন আশাবাদী হতেও দেখা যাচ্ছে অনেককে।
বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ ও নির্বাচনপূর্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় ইইউর নির্বাচনসংক্রান্ত তথ্যানুসন্ধানী একটি দল গত শনিবার ১৬ দিনের সফরে ঢাকায় এসেছে। প্রতিনিধিদলটির মূল কাজ হবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মিশনের কর্মপরিধি, পরিকল্পনা, বাজেট, নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয় মূল্যায়ন করা।
পর্যবেক্ষক দলটি গত রোববার তাদের কার্যক্রম শুরু করে। এ দিন ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদলটি ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি দেশের কূটনীতিক ও জাতিসঙ্ঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর সাথে আলাদা একাধিক বৈঠক করে। সর্বশেষ গতকাল সোমবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাথে বৈঠক করেছে প্রতিনিধিদলটি। গতকাল দুপুরের দিকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করে পর্যবেক্ষক দলটি। বৈঠক শেষে কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার আশঙ্কা আছে কি না, তা কমিশনের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। কমিশনের পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষক দলকে বলা হয়েছে, পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো।
ইইউর প্রতিনিধিদলটি বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করবে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় রয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, রাজনৈতিক নেতা, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সাথেও ইইউ প্রতিনিধিদলের কয়েক দফা বৈঠকের কথা রয়েছে। ঢাকা সফরের পর প্রতিনিধিদলটি যে প্রতিবেদন দেবে, তার ওপর ভিত্তি করে আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইইউ পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর বিষয়ে ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট জোসেফ বোরেল আগামী সেপ্টেম্বরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবেন।
আজ মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার নেতৃত্বে মার্কিন প্রতিনিধিদল ঢাকায় আসার কথা রয়েছে। টানা চার দিনের সফরে সফরকারীরা সরকারের গুরত্বপূর্ণ চার ব্যক্তির সাথে পৃথক বৈঠক করবেন বলে জানা গেছে। যার মধ্যে রয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন উজরা জেয়া। অন্য দিকে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, শ্রমিকনেতাসহ আরো কয়েকজনের সাথে দেখা করতে পারে মার্কিন প্রতিনিধিদলটি।
সূত্র জানায়, নির্বাচন সামনে রেখে কিছুটা চাপে রয়েছে সরকার। বিশেষ করে বহির্বিশ্বের চাওয়া সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে হবে। একই সাথে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তাদের রাজনীতির মাঠে সুযোগ দিয়ে মামলা প্রত্যাহার করা ও সংলাপে বসে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা।
কিছুদিন আগেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে ফেরার বিষয়ে কঠোর ছিল সরকার। কিন্তু চলতি বছরের শুরুতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে কোনো আইনি বাধা নেই। সেই সাথে সুর মিলিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন যদি রাজনীতিতে জড়াতে চান তাহলে তাকে তার মুক্তির শর্ত মানতে হবে। গত সোমবার ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান বলেছেন, অতীতের নির্বাচন আর আগামী নির্বাচন এক নয়। আগামী নির্বাচন হবে অত্যন্ত কঠিন। তাই নিজেদের জীবন বাঁচাতেই নৌকায় ভোট নিতে হবে।
অপর দিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি অনেকটা অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ করে রেখেছিল সরকার। সে ক্ষেত্রেও সরকার এখন নমনীয়। এখন তাদের রাজপথে বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের সুযোগ দেয়া হচ্ছে।
এ দিকে সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দীর্ঘ দিন ধরেই বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক পর্যায়ে তৎপরতা বাড়িয়ে দিয়েছে বিএনপি। তারা সরকারের গত কয়েক বছরের আমলনামা তুলে ধরছেন তাদের কাছে। বিশেষ করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলা বিষয়ে ডকুমেন্ট আকারে তুলে ধরেছেন তারা। এ ছাড়াও বহির্বিশ্বকে বোঝাতে চাচ্ছেন বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই, মানবাধিকার নেই, সুষ্ঠু ভোটের ব্যবস্থা নেই। ফলে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিকল্প নেই। মূলত এসব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সরকারের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছে বিএনপি। এরই মধ্যে আগামী বুধবার নয়াপল্টন বিএনপি কার্যালয়ের সামনে থেকে সরকার পতন ও কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা কর্মসূচি ঘোষণা করতে যাচ্ছে দলটি।
আগামী নির্বাচনকে ঘিরে বিদেশী কূটনৈতিক তৎপরতা নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনার ব্যাপারে জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ নয়া দিগন্তকে বলেন, বাইরে থেকে এসে প্রভাব বিস্তার করে নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছে এমন নজির দেখা যায় না। রাজনৈতিক অধিকার পেতে চাইলে নাগরিকদের আন্দোলনের বিকল্প নেই। এটাও খুব শিগগিরই দেখা যাবে যে, তারা আন্দোলন করবে নাকি নির্বাচনে যাবে, কেননা নির্বাচনের খুব বেশি সময় আমাদের হাতে নেই। যেহেতু আমাদের সাথে বিদেশীদের একটা সর্ম্পক আছে তাই তারা আমাদের বিষয়ে কথা বলেন। যেটাই বলুক সেটি তাদের স্বার্থেই বলে। এ জন্য আমি মনে করি না তাদের তৎপরতায় খুব একটা প্রভাব পড়বে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমরা আমাদের সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হলে কেউ এসে সমাধান করতে পারবে না। আমরা নাগরিক অধিকার হরণ করছি তাতে কোনো অপরাধ বোধ নেই। জাতির ভবিষ্যৎ, নাগরিকদের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবছি না। এ জন্য কূটনৈতিক তৎপরতায় জাতীয় নির্বাচনে কোনো প্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি না। অতীতেও বিদেশীরা চেষ্টা করে গেছেন, কিন্তু তা কোনো কাজে আসেনি।
পুলিশের সাথে ইইউর প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের বৈঠক
নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, বাংলাদেশ পুলিশের সাথে বৈঠক করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল। গতকাল সোমবার দুপুরে পুলিশ সদর দফতরে দলটির সদস্যরা পৌঁছেন। পরে তারা বৈঠক শেষে বেলা ৩টা ৫০ মিনিটে পুলিশ সদর দফতর থেকে বের হয়ে যান।
পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) মো: কামরুল আহসানের সাথে ইইউ প্রতিনিধিদলের সাক্ষাৎ হয়। বৈঠকে আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি মিডিয়া) মনজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ সফররত ইইউ প্রতিনিধিদলের সদস্যরা তাদের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করেছেন।
নির্বাচন বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না, সে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বৈঠকে নির্বাচন বিষয়ে আলোচনা হয়নি। তারা যে আসাযাওয়া করবেন এই সংক্রান্ত তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে পুলিশের সাথে কথা হয়েছে।
বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ ও নির্বাচনপূর্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় ইইউর নির্বাচনসংক্রান্ত তথ্যানুসন্ধানী এই দল গত শনিবার ১৬ দিনের সফরে ঢাকায় আসে।