হিজরি সন বা চান্দ্র বছর মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে গণনার অভূতপূর্ব বিধান। হিজরি সনের পয়লা মাস মহররম। যেসব উপাদান মুসলিম উম্মাহকে উজ্জীবিত করে তন্মধ্যে হিজরি সন অন্যতম। বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর কৃষ্টি-কালচারে হিজরি সনের গুরুত্ব অপরিসীম। হিজরি সন এমন একটি সন, যার সাথে মুসলিম উম্মাহর তাহজিব-তামাদ্দুন ও ঐতিহ্যের ভিত্তি সম্পৃক্ত। মুসলমানদের সিয়াম, হজ, ঈদ, শবেকদর, শবেমিরাজসহ ইসলামের বিভিন্ন বিধিবিধান হিজরি সনের ওপর নির্ভরশীল।
হিজরি সন গণনার সূচনা হয়েছিল ঐতিহাসিক এক অবিস্মরণীয় ঘটনাকে উপলক্ষ করে। রাসূল সা: এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীদের মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই আরবি মহররম মাসকে হিজরি সনের প্রথম মাস ধরে সন গণনা শুরু হয়েছিল। আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে তথা দ্বীনের স্বার্থে পবিত্র মক্কা থেকে মদিনায় রাসূল সা: এবং সাহাবায়ে কেরামের হিজরতের বছর থেকেই হিজরি সনের সূচনা।
রাসূলুল্লাহ সা:-এর সময়ে ও তার আগে রোমান, পারসিয়ান ও অন্যান্য জাতির মধ্যে তাদের নিজস্ব ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকা প্রচলিত ছিল। আরবদের মধ্যে কোনো নির্ধারিত বর্ষ গণনা পদ্ধতি ছিল না। বিভিন্ন ঘটনার ওপর নির্ভর করে তারিখ বলা হতো।
খলিফা হজরত উমর ফারুক রা:-এর শাসনামলে ১৬ হিজরি সনে, প্রখ্যাত সাহাবি হজরত আবু মূসা আশআরি রা: ইরাক এবং কুফার গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একদা হজরত আবু মূসা আশআরি রা: খলিফা উমর রা:-এর খেদমতে এ মর্মে পত্র লিখেন যে, আপনার পক্ষ থেকে পরামর্শ কিংবা নির্দেশসংবলিত যেসব চিঠি আমাদের কাছে পৌঁছে তাতে দিন, মাস, কাল, তারিখ ইত্যাদি না থাকায় কোন চিঠি কোন দিনের তা নিরূপণ করা আমাদের জন্য সম্ভব হয় না। এতে করে আমাদের নির্দেশ কার্যকর করতে সমস্যা হয়। অনেকসময় আমরা বিব্রতবোধ করি চিঠির ধারাবাহিকতা না পেয়ে।
হজরত আবু মূসা আশআরির চিঠি পেয়ে হজরত উমর রা: এ মর্মে পরামর্শ সভার আহ্বান করেন যে, এখন থেকে একটি ইসলামী তারিখ প্রবর্তন করতে হবে। ওই পরামর্শ সভায় হজরত উসমান রা:, হজরত আলী রা:-সহ বিশিষ্ট অনেক সাহাবি উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত সবার পরামর্শ ও মতামতের ভিত্তিতে ওই সভায় উমর রা: সিদ্ধান্ত দেন ইসলামী সন প্রবর্তনের।
হিজরতের বছর থেকেই ইসলামী দিনপঞ্জি গণনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় হিজরতের ১৬ বছর পর ১০ জমাদিউল আউয়াল ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দ।
মুসলিম জাতি তো বটে পৃথিবীর সব জাতির জন্যই গণনা করার এক সহজ উপায় হলো চান্দ্র বছর। চান্দ্র মাস গণনার রয়েছে এক অভূতপূর্ব সুবিধা যা অন্য কোনো মাসের ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। পৃথিবীর বুকে তাপবিহীন আলো নিয়ে চন্দ্র উদিত হয় সন্ধ্যার সময় পশ্চিম আকাশের নিচের দিকে সরু কাস্তের ন্যায় যেটি আরবি ভাষায় হিলালুন নামে পরিচিত। দ্বিতীয় দিন চন্দ্রটি সরু থেকে একটু পুরু হয় এবং নিচ থেকে উপরের দিকে ওঠে আর পৃথিবীকে বেশি সময় আলোকিত করে।
এভাবে প্রতিদিন চন্দ্র তার নিজের রূপ পরিবর্তনের সাথে সাথে পৃথিবীর আকাশে তার স্থান পরিবর্তন করে পৃথিবীকে বেশি সময় আলোকিত করে রাখে এবং সপ্তম বা অষ্টম দিনে অর্ধ থালার আকৃতি ধারণ করে যেটি পবিত্র কুরআনে কামরুন হিসেবে আলোচিত হয়েছে।
এভাবে ১৪ বা ১৫তম দিনে আমরা দেখতে পাই আমাদের মাথার উপর থালার মতো একটি পূর্ণ চন্দ্র যেটিকে আরবিতে বাদরুন বলা হয়, এটি সারা রাত পৃথিবীকে আলোকিত করে রাখে আর আমরা চন্দ্রের এই অবস্থাকে পূর্ণিমা বলি। আর চন্দ্র উদিত হওয়ার প্রথম দিন থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত রাতগুলোকে জ্যোৎস্না রাত বা শুক্লপক্ষ বলি।
আবার চন্দ্র ধীরে ধীরে ছোট হতে থাকে ও মাথার উপর থেকে পূর্ব আকাশে উদিত হতে থাকে এবং পৃথিবীর আকাশ অন্ধকার হতে থাকে, এই সময়কে আমরা অন্ধকার রাত বা কৃষ্ণপক্ষ বলি। অর্ধচন্দ্রে পরিণত হয়ে ধীরে ধীরে পৃথিবীর পূর্ব আকাশে গিয়ে আমাদের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়, এই রাতকে আমরা অমাবস্যার রাত বলে জানি।
আবার পশ্চিম আকাশে উদিত হয় নতুন চন্দ্র এবং শুরু হয় নতুন চান্দ্র মাস। এভাবে আবর্তিত হতে থাকে চান্দ্র মাস এবং চান্দ্র বছর যা যে কেউ অতি সহজেই গণনা করতে পারে।
মুসলিম তথা বিশ্ববাসীর জন্য এ মাস অথবা বছর গণনা করা অতি সহজ। যদি দেখা যায় মুসলিম জাতি দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনা পালন করছে তাহলে বিশ্ব জেনে যাবে সেটি রমজান মাস।
দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর চন্দ্র উদিত হলে মুসলিমদের ঈদুল ফিতর এবং সেটি শাওয়াল মাস। আবার নতুন চন্দ্র উদিত হলে সেটি জিলকদ মাস। পরবর্তী নতুন চন্দ্র উদিত হয়ে অষ্টম দিনে মুসলিমদের তথা বিশ্বের সর্ববৃহত্তম সম্মেলন হজ এবং দশম দিনে ঈদুল আজহা উদযাপিত হলে সেটি জিলহজ মাস।
মুসলিম ব্যতীত অন্য ধর্মাবম্বলীরা যদি তাদের মুসলিম প্রতিবেশী বা মুসলিম বন্ধুদের দৈনন্দিন জীবন অনুসরণ বা লক্ষ করে তাহলে তাদের জন্যও চান্দ্র মাস ও চান্দ্র বছরের হিসাব রাখা সহজ।
মুসলিমদের প্রাণকেন্দ্র মসজিদ থেকে ছড়িয়ে পড়তে পারে মুসলিমদের এমন কৃষ্টি-কালচার সারা বিশ্বে। মুসলিমদের তথা বিশ্বের সবার জন্যই যেকোনো সহজ বিষয় বা চান্দ্র বছরকে গণনার বিধান হিসেবে গ্রহণ করা মঙ্গলজনক।
লেখক :
এমফিল গবেষক (এবিডি) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়