রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ বিষয়ে বিএনপির এক আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন, উদার গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা ও অবাধ নির্বাচনের সংস্কৃতি থেকে সরে গিয়ে সরকার এখন স্বৈরচারীদের ক্লাবের সদস্য হয়েছে। পারমাণবিক শক্তির উৎস হিসেবে রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল হয়ে সরকার কী বার্তা দিতে চায় জনগণ তা জানতে চায়।
বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বিএনপির মিডিয়া সেলের উদ্যোগে ‘পরিবেশ ও মানব-বিপর্যয়ের আশঙ্কা উপেক্ষা করে দুর্নীতিগ্রস্ত রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ- একটি রাষ্ট্রীয় অপরিনামদর্শিতা’ শীর্ষক এই আলোচনা সভা হয়।
মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক ও সাবেক সংসদ সদস্য জহির উদ্দিন স্বপনের সভাপতিত্বে সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান।
মঈন খান বলেন, পরিবর্তিত বিশ্বে পাবনার রূপপুরে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট বিদ্যুৎ প্রকল্প অপ্রয়োজনীয়। এটা তৈরী করে ক্ষমতাসীন সরকার বাহাদুরি নিতে চাচ্ছে ।
তিনি বলেন, পরিবর্তনশীল বিশ্বে নিউক্লিয়ার পাওয়ারের প্রয়োজনীয়তা হারিয়েছে। আজকে নিউক্লিয়ার পাওয়ার নিয়ে বাহাদুর করার কিছু নেই। বরং যারা এই নিয়ে যারা বাহাদুরি করত, তারাও বর্তমানে নিউক্লিয়ার প্রত্যাখ্যান করেছে। ইতালি আইন করে নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট বন্ধ করেছে। সুইডেন, ইংল্যান্ড, আমেরিকা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরী বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার সেই অপ্রয়োজনীয় জিনিস আকড়ে ধরে বাহাদুরী নিতে চাচ্ছে, এটা একটা বাচ্চা ছেলের কাজ।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাংলাদেশের মতো জনঘনত্বপূর্ণ একটি দেশের জন্য অপরিণামদর্শীতার একটি জলন্ত উদাহরণ বলে মন্তব্য করেন ড. আবদুল মঈন খান। তিনি বলেন, ভারতের তামিলনাড়ুর কুদামকুলীনে একই মডেলের ২০০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্যয় ৬.৭ বিলিয়ন ডলারে সম্পন্ন হলেও একই কোম্পানির রূপপুর প্রকল্পের ব্যায় দ্বিগুণেরও বেশি কেন? এটি মূলত সরকারের অব্যাহত দুর্নীতির একটি জ্বলন্ত প্রমাণ।
বিএনপির এই নেতা বলেন, ১২.৮০ বিলিয়ন ডলারের প্রাক্কলিত এই প্রকল্প নিশ্চিতভাবে ২০ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে। যার ১২ বিলিয়নের উপর রাশিয়ার সাপ্লাই ক্রেডিট। আওয়ামী অর্থনৈতিক দুঃশাসনের অন্যতম মাধ্যম হলো- এই সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট। কিভাবে এই প্রকল্পে বিপুল ব্যয় নিরূপণ হলো, কোন অর্থনৈতিক সমীক্ষার মাধ্যমে এই ব্যয়ের বাণিজ্যিক কার্যকরিতা নিরুপণ করা হয়েছে সেটা কখনোই জনসম্মুখে আসেনি।
তিনি আরো বলেন, কোনো যথার্থ বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা ছাড়াই এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে এখানে দুই ধরনের বিপর্যয় স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এক, অর্থনৈতিক বিপর্যয়- যার অন্তরালে রয়েছে সীমাহীন দুর্নীতি এবং দুই, হলো ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা। এনার্জি সিকিউরিটির নামে মেগা দুর্নীতির ক্ষেত্র প্রস্তুত করার মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতি এবং জীববৈচিত্র্যকে চূড়ান্ত হুমকির সম্মুখীন করার জন্য, অপরিনামদর্শী শেখ হাসিনার সরকারকে একদিন ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই হবে, বাংলাদেশ কখনো তাকে ক্ষমা করবে না।
বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন বলেন, পাকিস্তানের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রেই বাংলাদেশ রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প পেয়েছে। ১৯৬১ সালেই রূপপুরের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। আজ মূলত পারমাণবিক শক্তি হস্তান্তর হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে ২০২৫ সনে। রাজনৈতিক ফয়দা লোটার জন্য আজ উদ্বোধনের নাটক করা হচ্ছে। জনগণকে এ বিষয়ে স্বচ্ছ কোনো তথ্য কখনই দেয়া হয়নি। বিদ্যুৎ উৎপাদনে একসময়ের পারমাণবিক শক্তি ব্যাবহারকারী দেশ অনেকেই এখন আইন করে এই শক্তির ব্যাবহার বন্ধ করে দিয়েছে।
তিনি বলেন, উদার গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা ও অবাধ নির্বাচনের সংস্কৃতি থেকে সরে গিয়ে সরকার এখন স্বৈরচারীদের ক্লাবের সদস্য হয়েছে। পারমাণবিক শক্তির উৎস হিসেবে রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল হয়ে সরকার কি বার্তা দিতে চায় জনগন তা জানতে চায়।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে এই প্রকল্পটির গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। তার অন্যতম হচ্ছে আমাদের জনসংখ্যার ঘনত্ব, কৃষিখাত ও নদ-নদীর উপর এর প্রভাব। বিশ্বের প্রধান পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারকরী দেশগুলোর কোোনটিরই জনসংখ্যার ঘনত্ব যেখানে ৬৫০ জনের বেশি নয়, সেখানে বাংলাদেশে এ সংখ্যা ১১১৫.৬২ জন প্রতি বর্গকিলোমিটারে। এরূপ জনঘনত্বের একটি দেশে ব্যয়বহুল প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে শতবার বিশ্লেষণ অপরিহার্য ছিলো। সম্প্রতি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাবিত এরূপ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সরাসরি বাতিল করেছে।
তিনি বলেন, এই প্রকল্পে জ্বালানি হিসাবে যে ইউরোনিয়াম ব্যবহার করা হবে তার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মানবস্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য মারাত্মক চ্যালেঞ্জ। এর পাশাপাশি এক-একটি চুল্লির অভ্যন্তর শীতল করতে প্রতি মিনিটে চার লাখ ৫৫ হাজার গ্যালন পানি প্রয়োজন হবে। যা সংগ্রহ করা হবে মূলত পদ্মা নদী অথবা ভূগর্ভস্থ জলাধার থেকে। চুল্লি থেকে নির্গত ৯৯ শতাংশ পানি উত্তপ্ত অবস্থায় আবার ধীর স্রোতের পদ্মা নদীতেই ফেলা হবে। স্মরণযোগ্য যে পদ্মা নদী আমাদের দেশের বৃহত্তম জলাধার ও মৎস্য ভাণ্ডার।
সভায় বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শাম্মী আকতার ও কেন্দ্রীয় নেতা শেখ ফরিদুল ইসলাম বক্তব্য রাখেন।