সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৫৯ অপরাহ্ন

আড়াই হাজার ‘সিগারেট খেয়ে’ আজ দিল্লির মাঠে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা!

এনবিডি নিউজ ডেস্ক :
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ৬ নভেম্বর, ২০২৩
  • ৪৫ বার

দিনসাতেক হলো দিল্লির খবরের কাগজগুলোতে ‘স্মগ’ আর ‘একিউআই’ ছাড়া আর যেন কোনো খবরই নেই। এই দুটি বিদঘুটে ইংরেজি শব্দই এখন শহরের আমজনতার মুখে মুখে!

দিল্লির আকাশ-বাতাস গত কয়েক দিন ধরেই ছেয়ে আছে ঘন বিষাক্ত ধোঁয়াটে আস্তরণে, ভরদুপুরে বেলা সাড়ে ১২টাতেও যেন সাঁঝবেলার আঁধার!

বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ করে দিতে হয়েছে, বয়স্কদের বাড়ি থেকে বেরোতে পইপই করে নিষেধ করা হচ্ছে, খুশখুশে কাশি শুরু হয়ে গেছে, লোকজন রাস্তাঘাটে বেরোচ্ছেন মাস্ক পরে – আর এরই মধ্যে দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলা স্টেডিয়ামে সোমবার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ক্রিকেট বিশ্বকাপের ম্যাচ!

বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে গ্রুপ পর্যায়ের এই ম্যাচটাই এই ভেন্যুতে টুর্নামেন্টের শেষ ম্যাচ – কিন্তু নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দিল্লিতে বিশ্বকাপের ম্যাচ আইসিসি কিভাবে রাখতে পারল, সে প্রশ্নটাই এখন ঘুরেফিরে আসছে।

রোববার দুপুরের দিকে তবু একটু রোদ উঠেছিল– কিন্তু সোমবার স্থানীয় সময় বেলা ২টায় ম্যাচ শুরুর আগে পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি না-হলে ম্যাচ রেফারি শেষ মুহূর্তেও ম্যাচ বাতিল ঘোষণা করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে দু’দলই একটি করে পয়েন্ট পেয়ে যাবে।

তবে দিল্লিতে আইসিসি-র ছোট-বড়-মেজ কোনো কর্মকর্তাই ‘ম্যাচ বাতিল’ শব্দটা ঘুণাক্ষরেও উচ্চারণ করছেন না– অনেক চাপাচাপিতে তারা শুধু এটুকুই বলছেন, ‘সোমবার বেলার দিকে পরিস্থিতি দেখে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে!’

একিউআই বা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স শব্দটা আজকাল অনেকেরই পরিচিত– গত বুধবার (২ নভেম্বর) থেকেই দিল্লির সেই একিউআই একটানা ৫০০-৬০০-এর আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্কেলে ‘অতি বিপজ্জনক’।

আর ‘স্মগ’ শব্দটা এসেছে স্মোক আর ফগ-কে যুক্ত করে। কেউ কেউ এটাকে ধোঁয়া + কুয়াশা = ধোঁয়াশা বলে বর্ণনা করলেও আসলে এর সঠিক বাংলা অনুবাদ করা মুশকিল, কারণ দুনিয়ার বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল এ জিনিস কখনো দেখেনি হলফ করে বলা যায়!

দিল্লির এই বিচিত্র ও বিপজ্জনক ‘স্মগ’ একান্তভাবে দিল্লিরই নিজস্ব– ‘পরালি’, গাড়ির ধোঁয়া ও আরো নানা বিষাক্ত উপাদানের মিশেলে যে মারাত্মক ককটেল পৃথিবীর আর কোথাও খুঁজে পাওয়া মুশকিল!

মোহালির অভিশাপ?
আসলে প্রতি বছর অক্টোবরের শেষ বা নভেম্বরের শুরু থেকেই দিল্লিতে এই পরিস্থিতি প্রায় রুটিন – দিল্লির নিজস্ব যানবাহনের আর শিল্পের দূষণ তো আছেই, কিন্তু বছরের এই সময়টায় তার সাথে যোগ হয় পাঞ্জাবের ‘পরালি’!

‘পরালি’ হলো ফসলের গোড়া, ক্ষেত থেকে যা উপড়ে না-ফেললে নতুন বীজ লাগানো যায় না। কিন্তু সেই পরালি ওপড়ানোর সব আধুনিক পদ্ধতিই বেশ খরচসাপেক্ষ, তাই পাঞ্জাবের কৃষকরা শরতের শেষ দিক থেকেই ঢালাওভাবে পরালি জ্বালাতে শুরু করে দেন।

ঠিক মাসখানেক আগে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম দুটি ম্যাচ কভার করতে যখন পাঞ্জাবের ওপর দিয়ে সড়কপথে ধরমশালা যাচ্ছিলাম, তখনই সেখানে এই পরালি জ্বালানো শুরু হয়ে গেছে পুরোদমে– হাইওয়ের দু’পাশে গমের ক্ষেতের ওপর পুরু হয়ে তৈরি হচ্ছে বিষাক্ত সাদা ধোঁয়ার চাদর।

পশ্চিমা বাতাসের কল্যাণে সেই ধোঁয়ার চাদরই এত দিনে যথানিয়মে রাজধানী দিল্লিতে এসে পৌঁছেছে– আর অনিশ্চিত করে ফেলেছে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ৩৮তম ম্যাচটিকে!

অনেকে যাকে ভারতের সেরা ক্রিকেট স্টেডিয়াম বলে মনে করেন, সেই পাঞ্জাবের মোহালি এবারের বিশ্বকাপে কোনো ম্যাচ পায়নি।

ভারতের বিরোধী দলগুলো এমনও অভিযোগ করেছে, পাঞ্জাবে আম আদমি পার্টি ক্ষমতায় আছে বলেই বিজেপি-প্রভাবিত ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড মোহালিকে অযথা ‘শাস্তি’ দিয়েছে।

‘এখন সেই পাঞ্জাবের পরালিই যখন দিল্লির ম্যাচকে অনিশ্চিত করে দিয়েছে, তখন সেটাকে মোহালির অভিশাপ ছাড়া আর কীই বা বলা যায়?’, খানিকটা বিদ্রূপ মিশিয়েই বললেন ক্রিকেট ভাষ্যকার আদেশ গুপ্তা।

দুই দলের বক্তব্য
বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা দুটি দলই যথারীতি ম্যাচের আগে একাধিক প্র্যাকটিস সেসন বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে– দু’টি দলেরই প্রায় অর্ধেক ক্রিকেটার রোববারও অনুশীলন ‘স্কিপ’ করেছেন।

তাহলে দিল্লির পরিবেশ কি বছরের এই সময় আদৌ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের উপযুক্ত? বিবিসি বাংলার এই প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশের কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে জানালেন তিনি এই প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি নন!

কিন্তু পরিস্থিতিটা যে মোটেই ‘আদর্শ নয়’ এবং এই মারাত্মক দূষণ ক্রিকেটারদের ভোগাচ্ছে, সেটা তিনি স্বীকার করে নিলেন কোনো রাখঢাক না করেই!

সন্ধ্যায় শ্রীলঙ্কা অধিনায়ক কুশল মেন্ডিসও সংবাদ সম্মেলনে এসে জানিয়ে দিলেন, তারা আইসিসি-র কাছে দিল্লি থেকে ম্যাচ সরানোর দাবি জানিয়েছেন এই খবর পুরোপুরি ঠিক নয়।

তবে বাংলাদেশ যেভাবে প্র্যাকটিস সেসন বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে এবং তারা নিজেরা দিল্লিতে নামার পর বাইরের অবস্থা যা চোখে দেখছেন– তাতে শ্রীলঙ্কা দল আইসিসির কাছে অবশ্যই তাদের ‘উদ্বেগ’ জানিয়েছে।

‘আমরা জানতে চেয়েছি পরিকল্পনাটা ঠিক কী? তারপর দেখলাম আইসিসি এখানে কিছু যন্ত্রপাতি বসিয়েছে, পরিস্থিতিটা অ্যাড্রেস করার জন্য বিশেষজ্ঞদেরও ডেকে এনেছে’, বলছিলেন কুশল মেন্ডিস।

‘ওরা আমাদেরে এর মধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে যে ম্যাচ হবে বলেই ঠিক আছে। তো এখন আইসিসি এখন আমাদের যা বলবে আমরা সেই অনুযায়ীই চলব’, কোনো ‘বিদ্রোহে’র জল্পনায় পানি ঢেলে দিয়েই জানালেন শ্রীলঙ্কার ক্যাপ্টেন।

সিগারেটের হিসেব
দিল্লির কাছে গুরগাঁওয়ের সুপরিচিত মেদান্তা হসপিটালের নামী বক্ষ বিশেষজ্ঞ অরবিন্দ কুমার সম্প্রতি দিল্লির দূষণের সাথে এমন একটি তুলনা টেনেছেন, যা রাজধানীতে বেশ আলোড়ন ফেলে দিয়েছে।

দিল্লির একিউআই আর স্মগের পরিসংখ্যান দেখে ড. কুমার বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে দিল্লির বাতাসে নিঃশ্বাস নেয়ার অর্থ হলো রোজ অন্তত পঁচিশ থেকে তিরিশটা সিগারেট টানা!’

দুটিরই প্রভাব আসলে শরীরের জন্য সমান ক্ষতিকর– এটাই আসলে বলতে চেয়েছেন তিনি।

দিল্লির ছেলে ও পরিবেশ গবেষক পলাশ মুখার্জি এখন কানাডাতে থাকলেও বিশ্বকাপ নিয়েও খুঁটিনাটি খবর রাখছেন– তিনি এই তুলনার রেশ টেনেই একটা ইন্টারেস্টিং স্ট্যাটিসটিক্স বিবিসির সঙ্গে শেয়ার করলেন।

‘ইডেনের ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ টিম দিল্লিতে নেমেছে বুধবার বিকেলে। তার মানে সোমবার ম্যাচ খেলতে নামার সময় তাদের প্রায় পুরো পাঁচ দিন দিল্লিতে কাটানো হয়ে যাবে।’

‘এখন এক দিন নিশ্বাস নেয়া মানে যদি ধরি ২৮টা সিগারেটের সমান, তাহলে প্রথম এগারোর ক্রিকেটাররা সবাই মিলে ১১ গুণিতক ২৮ গুণিতক ৫ = দেড় হাজারেরও বেশি সিগারেট খেয়ে খেলতে নামছেন ধরে নিতে হবে’, হাসতে হাসতে বলছিলেন পলাশ মুখার্জি।

একইভাবে শ্রীলঙ্কা টিম যেহেতু মুম্বাইয়ে ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচ খেলে শুক্রবার শহরে এসেছে, তারা দিল্লিতে খেলতে নামছে তিন দিন কাটানোর পর।

সেই হিসেবে শ্রীলঙ্কা দলেরও এগারোজন ক্রিকেটার ততক্ষণে হাজারখানেক সিগারেটের সমান ‘ধূমপান’ করে ফেলবেন!

‘ফলে দুটি দলের বাইশজন ক্রিকেটার প্রায় আড়াই হাজার সিগারেটের সমান দূষণ গিলে বিশ্বকাপের একটা ম্যাচ খেলতে নামবেন– ভাবা যায়?’, বলছিলেন দিল্লির সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের এই সাবেক বিজ্ঞানী।

ঠিক এই কারণেই সোমবারের ম্যাচটির ভবিষ্যৎ সুতার ওপর ঝুলছে বলা যেতে পারে– আইসিসি, বিসিসিআই আর হোস্ট বডি দিল্লি ক্রিকেট সংস্থা প্রবল উৎকন্ঠার সাথে নজর রাখছে সোমবারের একিউআই আর স্মগ ফ্যাক্টরের ওপর!

ক্রিকেট যখন আড়ালে
দূষণ নিয়ে এই সর্বগ্রাসী দুশ্চিন্তায় এই ম্যাচকে ঘিরে যাবতীয় ক্রিকেটীয় আলাপ-আলোচনা আড়ালে চলে গেছে, তা বলাই বাহুল্য।

শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ দুটি দলই বিশ্বকাপে সেমিফাইনালের লক্ষ্য থেকে অনেক আগেই ছিটকে গেছে, কিন্তু ২০২৫-এর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে যোগ্যতা অর্জনের লড়াই তাদের এখনো জারি রয়েছে।

আর ঠিক সে কারণেই এই ম্যাচটায় জেতা দুই দলের জন্যই খুব জরুরি– যাতে পয়েন্ট তালিকায় তারা অন্তত আট নম্বরে শেষ করতে পারে।

এই প্রসঙ্গেই বিবিসির এক প্রশ্নের জবাবে হাথুরুসিংহে বললেন, ‘আমি এখনও মনে করি বাংলাদেশের পক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির একটা স্পট অর্জন করা খুবই সম্ভব।’

‘তার কারণটাও খুব সহজ – বাংলাদেশ এখনো তাদের সেরা ক্রিকেটের ধারেকাছেও পৌঁছতে পারেনি।’

‘আমরা যতটা ভালো খেলার ক্ষমতা রাখি, বাকি দুটি ম্যাচে সেটা দেখাতে পারলে অবশ্যই আমাদের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলার সম্ভাবনা থাকবে’, জানালেন তিনি।

অন্য দিকে শ্রীলঙ্কার ক্যাপ্টেন কুশল মেন্ডিস জানালেন বাংলাদেশ তাদের খুব চেনা প্রতিপক্ষ – এই বছরেই অনেকগুলো ম্যাচ খেলেছি বাংলাদেশের সঙ্গে, ওদের নিয়ে অবশ্যই আমাদের নির্দিষ্ট পরিকল্পনা আছে– কিন্তু আলাদা করে বিরাট প্রস্তুতির দরকার নেই!

গত ম্যাচেই ভারতের কাছে তিন শ’রও বেশি রানে বিধ্বস্ত হয়ে হেরেছে শ্রীলঙ্কা, কিন্তু সেই ৫৫ রানে অল আউট হওয়ার দুঃস্বপ্ন যে ক্রিকেটাররা দ্রুত ভুলে যেতে চাইছেন, জানালেন সে কথাও।

এবং এটাও মনে করিয়ে দিতে ভুললেন না, বাংলাদেশের জন্য যেমন, শ্রীলঙ্কার জন্যও বাকি দুটো ম্যাচে জেতার অনুপ্রেরণা হল চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির হাতছানি।

কুশল মেন্ডিসের কথায়, ‘বাকি দুটি ম্যাচে জিততে পারলে আমাদের পক্ষেও চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির যোগ্যতা অর্জন অবশ্যই সম্ভব।’

শ্রীলঙ্কা টিম দেশে যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে থাকে, তিনি এই মুহূর্তে অন্য কাজে দিল্লিতে এসেছেন বলে দলকে সাহায্য করছেন– তা ছাড়া আইসিসি-র মেডিক্যাল টিমও সব সময় হাতের কাছেই আছেন।

অধিনায়ক জানালেন, তাদের উপদেশ ছাড়া ক্রিকেটাররা একটা পা-ও ফেলছেন না বা মাস্ক পর্যন্ত খুলছেন না– কারণ ঘুরেফিরে দুশ্চিন্তা সেই দিল্লির দূষণই!
সূত্র : বিবিসি

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com