পারস্য দেশের একজন সাড়াজাগানো মেডিসিন সার্জন ছিলেন ড. মরিস বুকাইলি। মেডিসিনের ওপর অনন্য ভূমিকা রাখায় তাকে তৎকালীন ফ্রান্স সরকার কর্তৃক দেয়া হয় সার্জন ‘ফ্রান্স অ্যাকাডেমি অ্যায়ার্ড’।
তিনি ১৯ জুলাই ১৯২০ সালের বর্তমান ফ্রান্সের একটি খ্রিষ্টান পরিবারে জন্ম নেন। তাকে চেনে না এমন মানুষ পৃথিবীতে খুব কমই পাওয়া যাবে। বাপ-দাদার খ্রিষ্টান ধর্ম ছেড়ে দ্বীনের পথে ফিরিয়ে আনতে তাকে পবিত্র কুরআনের একটি আয়াতই যথেষ্ট হয়েছিল। নিজ ধর্ম ছেড়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পেছনে ছিল রোমাঞ্চকর কাহিনী। তার বিবেকের চোখ খুলতে বাধ্য হয়েছে কুরআনের ভুল ধরার অপ্রতিরোধ্য অভিযানে। কুরআনের ভুল তো ধরা পড়লই না; বরং তার ইসলাম কবুলের পথ প্রশস্ত করেছিল কুরআন।
আশির দশকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিত্রা চেয়েছিলেন মিসরে থাকা ফেরাউনের মমিকে ফ্রান্সে নিয়ে এসে প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন কেন্দ্রে গবেষণা করার জন্য। জানতে চেয়েছেন বছরের পর বছর মমি করা অন্যান্য লাশের তুলনায় ফেরাউনের লাশটা অক্ষত রয়েছে কিভাবে?
মিসর সরকার তাদের অনুরোধে ফেরাউনের মমিকে পাঠিয়ে দিলো সুদূর ফ্রান্সে। লাশটিকে বিমানবন্দরে রাষ্ট্রীয় রাজকীয় অভ্যর্থনায় গ্রহণ করা হলো। নিয়ে যাওয়া হলো রিসার্চ কেন্দ্রে। যেখানে তৎকালীন দেশটির সবচেয়ে বড় সার্জনরা রয়েছেন। আর তারা ফেরাউনের মমির ময়নাতদন্ত করে সেটি স্টাডি করবে ও এর গোপনীয়তা উদ্ঘাটন করবে।
সার্জনদের এই দলের প্রধান ছিলেন ড. মরিস বুকাইলি। সবাই তার শরীরের ক্ষত অংশগুলো ঠিক করতে চাচ্ছিল। এ দিকে ড. মরিস জানতে চাইছিলেন সে কিভাবে মারা গেল? দীর্ঘ সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরক্ষণেই দেখতে পেল তার শরীরে লবণাক্ততার অংশ আছে। আর সাগরে ডুবে মারা যাওয়ার এটিই ছিল বড় নিদর্শন। নবী মূসা আ: ও তার উম্মতদের পিছু ধাওয়া করতে গিয়ে আল্লাহর অশেষ কুদরতে সমুদ্রে ১২টি পথ হয়ে গেলে বনি ইসরাঈলদের পার হওয়ার জন্য। এ দিকে সদলবলে ফেরাউন সমুদ্রের মাঝখানে পৌঁছালে দুই পাশে সরে যাওয়া পানিগুলো একত্রিত হয়ে যায়। এতে সে ও তার সেনাদল পানিতে ডুবে প্রাণ হারায়।
তারপর মিসরে তার লাশটি দ্রুত মমি করে সংরক্ষণ করা হয়। প্রফেসর ড. মরিস বুকাইলি ওই মমির স্থায়িত্ব অন্য মমিদের তুলনায় বেশি অক্ষত থাকায় বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। কেননা, কোনো বস্তু যদি আর্দ্র অবস্থায় থাকে, ব্যাকটেরিয়া ওই বস্তুকে দ্রুত ধ্বংস করে দিতে পারে। কারণ আর্দ্র পরিবেশে ব্যাকটেরিয়া খুব দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করে।
ড. মরিস বুকাইলির মাথায় যখন চিন্তার ভাঁজ পড়ল। ঠিক তখনই তার সাথে অবস্থান করা একজন সার্জন কলিগ বলে উঠল- স্যার! মুসলমানদের কুরআনে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এ কথা শোনার পর ড. মরিস বুকাইলি বিস্মিত হয়ে পড়ল। কিভাবে সম্ভব হবে? যেখানে তাওরাত সেই যুগের কিতাব হওয়া সত্ত্বেও তাতে কোনো আলোচনা নেই। বাইবেলেও এ বিষয়ে পূর্ণ আলোচনা নেই। সেখানে কুরআনে কিভাবে থাকবে?
এই মমি পাওয়া গেছে মোটে ১৮৮১ সালে, আর কুরআন নাজিল হয়েছে আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে! আর প্রাচীন আরবরা তো মমি করার পদ্ধতিই জানত না, মাত্র কয়েক দশক আগে তা আমাদের হাতে আবিষ্কৃত হয়! ড. বুকাইলি ফেরাউনের লাশের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে গভীরভাবে ভাবছিলেন, মুসলিমদের কুরআনে কিভাবে ফেরাউনের লাশ সংরক্ষণের কথা এসেছে? অতঃপর ড. বুকাইলি ওই রাতে আর ঘুমাতে পারেননি। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, আমাকে এই মমির আসল রহস্য উদঘাটন করতে হবে। তাই তিনি দৃঢ় সংকল্প করলেন, মুসলিম ডাক্তারদের সাথে এ বিষয়ে গোলটেবিল আলোচনায় বসবেন। যেই ভাবনা সেই কাজ। তিনি চলে গেলেন মুসলিম ডাক্তারদের কাছে যারা এ বিষয়ে পারদর্শী। তিনি সেখানে পৌঁছে ফেরাউনের লাশ ডুবে যাওয়া পরবর্তী সংরক্ষণের যে রেজাল্ট পেয়েছেন তা নিয়ে আলোচনা করেন, তখন একজন মুসলিম বিশেষজ্ঞ পবিত্র কুরআন খুললেন এবং আয়াতটি ড. বুকাইলিকে শোনালেন যেখানে সর্বশক্তিমান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন- সূরা ইউনুসের ১০ নং আয়াত, ‘অতএব আজকের দিনে বাঁচিয়ে দিচ্ছি আমি তোমার দেহকে যাতে তোমার পশ্চাদবর্তীদের জন্য নিদর্শন হতে পারে। আর নিঃসন্দেহে বহু লোক আমার মহাশক্তির প্রতি লক্ষ করে না।’
পবিত্র কুরআনের এমন বিস্ময়কর মুজিজা দেখে তিনি মুগ্ধ হন। আর সাথে সাথে পড়ে নেন মধুর কালিমা- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লøাহ সা:’। তার ইসলাম কবুল সারা পৃথিবীজুড়ে মুসলমানদের জন্য আনন্দের জোয়ার সৃষ্টি করল। বিশ্বের বুকে আবারো সমুন্নত হলো মুসলমানদের পবিত্র হেদায়েত গ্রন্থ আল-কুরআনের সম্মান। এরপর তিনি ৫০ বছর বয়সে পবিত্র কুরআনকে আরো বিশদভাবে জানার জন্য আরবি ভাষার শিখার প্রতি মনোনিবেশ করেন। দীর্ঘ ১০ বছর তিনি আর তার ডাক্তারি পেশায় সময় দেননি; বরং পবিত্র কুরআন নিয়ে গবেষণা করে আরো বৈজ্ঞানিক থিউরির সাথে কুরআনের মিল খোঁজে পান। তারপর তিনি সবশেষে একটি আয়াতের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেন। আয়াতটি পবিত্র কুরআনের সূরা হা-মিম-আস-সেজদার ৪২ নং আয়াত। যেখানে আল্লাহ পাক ইরশাদ ফরমান- ‘এতে মিথ্যার প্রভাব নেই, সামনের দিক থেকেও নেই এবং পেছন দিক থেকেও নেই। এটি প্রজ্ঞাময়, প্রশংসিত আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ।’
১৯৭৬ সালে তিনি ‘বাইবেল বিজ্ঞান ও কুরআন’ নামে একটি বই রচনা করেন। যে বইতে তিনি বিজ্ঞানের সাথে কুরআন ও বাইবেলের চমৎকার মিল ও সত্যতা তুলে ধরেন। এতে পশ্চিমা বিশ্বাসের বিজ্ঞানীদের টনক নড়ে ওঠে। বইটি এত বেশি প্রসিদ্ধি লাভ করে যে, বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
এ ছাড়াও তিনি কুরআনের ওপর আরো একটি বই লেখেন, এর নাম হলো- ‘আল-কুরআন এক মহাবিস্ময়’।
আল্লাহ যাকে ইচ্ছা এভাবেই হেদায়াত দান করেন। কুরআনের আলো মেখে আলোকিত হলেন ড. মরিস বুকাইলি। দ্বীনের পথে ফিরতে যার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। যিনি কুরআনের ভুল ধরতে এসে ভুল খুঁজে না পেয়ে দ্বীন ইসলাম কবুল করে নিয়েছেন।
তথ্যসূত্র :
ইন্টারনেট ব্লগ
লেখক : আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া