নেত্রকোনা থেকে রাজধানীমুখী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের যে বগিতে আগুন লেগেছিল, সেই বগিতে যাত্রীদের দেখভাল ও নিরাপত্তার দায়িত্বে কোনো অ্যাটেনডেন্ট ছিলেন না। ফলে ট্রেনটির চালক সঙ্গে সঙ্গে সেটি জানতে পারেননি। আগুন লাগার কমপক্ষে ১০ মিনিট পর যখন চালকের কাছে এ খবর পৌঁছায়, ততক্ষণে তিনটি বগির সবকিছু পুড়ে যায়। মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে অগ্নিকাণ্ড এবং চার যাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যু নিয়ে তদন্ত করছেন যারা, তাদের সঙ্গে কথা বলে গতকাল এ তথ্য পাওয়া গেছে। এদিকে রেলওয়ে স্টেশনের সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত ফুটেজ দেখে নাশকতাকারীদের খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সন্দেহের তীর তিন যাত্রীর দিকে, যারা সেদিন ভোরে বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনটিতে ওঠেছিলেন। এ অগ্নিকাণ্ডের জেরে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হলেও গতকাল পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। এদিকে অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রাণ হারানো ট্রেনটির দুই যাত্রীর লাশ গতকাল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গ থেকে তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
রেলওয়ে পুলিশের ঢাকা জেলার এসপি আনোয়ার হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, বগিতে আগুন লাগার ১০ মিনিট পর চালক জানতে পারেন। ততক্ষণে আগুন তিন বগিতে ছড়িয়ে পড়ে। প্রত্যেকটি বগির যাত্রীদের নিরাপত্তা ও দেখভালের দায়িত্বে থাকা অ্যাটেনডেন্টরা তখন কামরায় ছিলেন না বলে যাত্রীরা অভিযোগ করেছেন। তবে অ্যাটেনডেন্টরা জানান, তারা কামরাতেই ছিলেন। চালকের মোবাইল নম্বর না থাকায় তারা তাকে বিষয়টি জানাতে পারেননি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মোহনগঞ্জ থেকে শুরু করে ট্রেনের বিরতি দেওয়া প্রত্যেকটি রেলওয়ে স্টেশনের সিসিক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। উত্তরা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত রেলওয়ে স্টেশনের আশপাশের প্রত্যেকটি সিসি ক্যামেরা ফুটেজ সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। মঙ্গলবার ভোর ৪টা ৩৭ মিনিট থেকে ৪০ মিনিট পর্যন্ত বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে তিনজন যাত্রী ওঠে। প্রাথমিকভাবে সন্দেহের তীর ওই তিন যাত্রীর দিকে। তাদের পরিচয় শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণের পর দেখা গেছে, ঢাকা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনের আগে ট্রেনটির যাত্রাবিরতির স্টেশন ছিল গফরগাঁও ও ময়মনসিংহ জংশনে। বিমানবন্দর স্টেশন যখন ট্রেনটি পার হয়, সেখানেও আগুন দেখা যায়নি। বিমানবন্দর স্টেশন থেকে উঠে ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন পার হওয়ার পর আগুন দেওয়া হয় ট্রেনটিতে।
এদিকে ট্রেনে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের পরিচালক (গার্ড) খালেদ মোশারেফ বাদী হয়ে মঙ্গলবার রাতে ঢাকা রেলওয়ে থানায় মামলা করেছেন। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি সোমবার রাত ১১টায় মোহনগঞ্জ থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসে। মঙ্গলবার ভোর ৪টা ৩৭ মিনিটে ঢাকার বিমানবন্দর রেলস্টেশনে পৌঁছায়। সেখানে তিন মিনিট যাত্রা বিরতি শেষে ৪টা ৪০ মিনিটে ফের যাত্রা শুরু করে। এর তিন মিনিট পর দুষ্কৃতকারীরা আন্তঃনগর ট্রেনটির ‘জ’ এবং ‘ঝ’ বগির মাঝামাঝি স্থানে দাহ্য পদার্থ দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। ট্রেনের ভেতর ধোঁয়ায় অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়লে যাত্রীরা চিৎকার করতে থাকে। ‘জ’ এবং ‘ঝ’ বগিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ‘জ’ বগিতে কর্তব্যরত স্টুয়ার্ড মাঈন উদ্দিন মানিক তাৎক্ষণিকভাবে স্টুয়ার্ড ম্যানেজার রাহাত মিয়াকে জানান। রাহাত মিয়া বিষয়টি জানান বাদী খালেদকে। কিন্তু এর আগেই ট্রেনটি তেজগাঁও রেলস্টেশনে প্রবেশের সময় ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে সিগন্যাল দেখার উদ্দেশ্যে সামনের দিকে তাকিয়ে সামনে অন্ধকার ও বগির ভেতর থেকে প্রচুর ধোঁয়া বের হতে দেখেন তিনি। এরপরই তিনি এয়ার প্রেসার ড্রপ করে মোবাইল ফোনে ট্রেনটির এলএম দীলিপ কুমার মণ্ডলের সঙ্গে যোগাযোগ করে ৪টা ৫৮ মিনিটে তেজগাঁও স্টেশনে ট্রেনটি থামানোর ব্যবস্থা করেন। ততক্ষণে আগুন ‘ছ’ বগিতেও ছড়িয়ে পড়ে। থামানোর পর আগুন লাগা তিনটি বগি অন্যান্য বগি থেকে বিছিন্ন করে ফেলা হয়। ফায়ার সার্ভিস এসে আগুন নেভানোর পর ‘জ’ নম্বর বগিতে চারজনের লাশ পাওয়া যায়, তারা আগুনে পুড়ে মারা যান।
এজাহারে আরও বলা হয়, অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারীরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে ট্রেনে আগুন লাগিয়ে চার যাত্রীকে হত্যা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
মামলার এজাহার অনুযায়ী, আগুন লাগা বগিতে উপস্থিত ছিলেন স্টুয়ার্ড মাঈন উদ্দিন। তারপরও লোকোমাস্টারের (চালক) কাছে খবর পৌঁছাতে কেন ১৫ মিনিট সময় লেগে গেল এমন প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
একাধিক যাত্রী জানিয়েছে, আগুন লাগা ট্রেনের বগিতে কোনো অ্যাটেনডেন্ট ছিলেন না। যাত্রীদের বেশিরভাগই ছিলেন ঘুমিয়ে। আগুন লাগার পর তারা চিৎকার করলেও ট্রেনের কেউ এগিয়ে আসেননি। চেইন টানলেও ট্রেন থামেনি। ফলে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, যাত্রীদের টিকিট চেক করার পর সাধারণ অ্যাটেনডেন্টরা যাত্রীদের সব বগিতে থাকেন না। আগুন লাগার সময় ওই বগিতে অ্যাটেনডেন্ট ছিলেন না। থাকলে দ্রুতই চালককে খবর দিতে পারতেন। চালক আরও আগে ট্রেনটি থামাতে পারলে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি কম হতো। কারণ ট্রেন চলন্ত থাকায় বাতাসের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। একই কারণে যাত্রীরা ট্রেন থেকে নামতে পারেননি।
পিবিআই ঢাকা দক্ষিণের পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেন, আমরা ছায়া তদন্ত করছি। বিমানবন্দর রেলস্টেশনের ৩২টি সিসি ক্যামেরার মধ্যে ১২টি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। এ ছাড়া তেজগাঁও রেলস্টেশনের দুটি এবং গফরগাঁও রেলস্টেশন থেকে ৪-৫টি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়। আমরা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে অপরাধীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি।
দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, গফরগাঁও ও বিমানবন্দর রেলস্টেশনে যেসব যাত্রী ওঠানামা করেছেন এবং আগুন লাগার পর তেজগাঁও স্টেশনে যেসব যাত্রী নেমেছেন তাদের মধ্যে থেকে অগ্নিসংযোগে জড়িতদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে। এর মধ্যে বিমানবন্দর স্টেশন থেকে ওঠা তিনজনকে প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা হয়েছে। তবে তাদের মুখ ঝাপসা হওয়ায় এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি তাদের পরিচয়।
বাকি দুই লাশও হস্তান্তর : ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারানো চারজনের মধ্যে নাদিরা আক্তার পপি (৩৫) এবং তার তিন বছরের ছেলে ইয়াসিনের লাশ আগেই পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। গতকাল অবশিষ্ট দুজনের লাশও ময়নাতদন্ত শেষে তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তারা দুজন হলেন মো. খোকন মিয়া (৩৫) ও রশিদ ঢালী (৬০)।
ঢাকা রেলওয়ে থানার এসআই সেতাফুর রহমান বলেন, মরদেহ হস্তান্তর করার আগে দুজনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে। খোকন সুনামগঞ্জ জেলার মধ্যনগর উপজেলার জুলসা গ্রামের মৃত নুর ইসলামের ছেলে। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। নারায়ণগঞ্জ বিসিক এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় পরিবার নিয়ে থাকতেন। স্ত্রী সাজনা আক্তার এবং তিনি ক্রোনি গ্রুপের অবন্তী কালার টেক্সটাইল কারখানায় কাজ করতেন। মৃত রশিদ ঢালী নেত্রকোনা সদর উপজেলার নাগরা গ্রামের মৃত বশির ঢালীর ছেলে। দুই ছেলে এক মেয়ের বাবা তিনি। তার স্ত্রীর নাম পেয়ারা বেগম।