একজন শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা সদ্য পাওয়া একটা রিপোর্ট নিয়ে মিটিংরুমে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন, রাজনীতিক ও নীতিনির্ধারকদের উদ্বিগ্ন চোখের সামনে জানালেন কী ধরনের বিপদের সঙ্কেত তারা পাচ্ছেন।
এতদিন, অন্তত সাম্প্রতিক অতীতে, গোয়েন্দাদের কাছে এ ধরনের হুঁশিয়ার করার মতো রিপোর্টের বিষয়বস্তু হয়েছে সন্ত্রাসবাদী হামলার ছক- হয়তো বা মধ্যপ্রাচ্যের কোথাও থেকে খবর পাওয়া গেছে যে সন্ত্রাসীরা নতুন কায়দায় একটা বিমান হামলার ছক কাটছে। সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে শুরু করেছে বহু পরীক্ষিত জাতীয় নিরাপত্তা যন্ত্রের চাকা। হামলা ঠেকাতে জাতীয় পর্যায়ে ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপরতা শুরু হয়েছে।
কিন্তু ভবিষ্যতে এই চিত্রে অন্যরকম মাত্রা যোগ হতে যাচ্ছে। এখন গোয়েন্দা কর্মকর্তার আনা রিপোর্টে হয়ত থাকবে বহু দূরের কোন দেশে একটা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে- এমন বিপদ সঙ্কেত। এমন রিপোর্ট যে সে দেশের সরকার এই রোগ সংক্রমণের বিষয়টা লুকাচ্ছে।
প্রায় বিশ বছর আগে আমেরিকায় ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে জাতীয় নিরাপত্তার কেন্দ্রে চলে এসেছে সন্ত্রাসবাদের বিষয়টি। তবে এরপরেও নিরাপত্তা জগতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অনেকেই যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে, ‘নিরাপত্তার’ সংজ্ঞা আরও বিস্তৃত করা উচিত।
এখন করোনাভাইরাস সংকটের পটভূমিতে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে যে, জাতীয় নিরাপত্তার কেন্দ্রে বিবেচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়টি আরও গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্ভূক্ত করা উচিত কিনা।
জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে ব্রিটেনে সবশেষ যখন পর্যালোচনা হয়, তখন আন্তর্জাতিক মহামারিকে জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকিগুলোর তালিকায় শীর্ষে রাখার কথা বলা হয়। কিন্তু নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বা সম্পদ বরাদ্দের ক্ষেত্রে ব্রিটেনে তার কোন প্রতিফলন দেখা যায়নি। সেক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পেয়েছে সন্ত্রাসবাদ, যুদ্ধ এবং সাইবার হামলা।
কিন্তু অনেক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এখন বলছেন তারা স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়টিকে সমানভাবে অগ্রাধিকার দেবার যে পরামর্শ দিয়েছিলেন তা তখন রাজনীতিকরা কানে তোলেননি। বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন এই ক্ষেত্রে ‘লাল বাতির সতর্ক সঙ্কেত কিন্তু জ্বলতে শুরু করেছে’।
তবে বিশ্ব জুড়ে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে এবং গুপ্তচরদের এজন্য তাদের কাজ ও মানসিকতায় বড়ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে। নীতি নির্ধারকদেরও অন্য দেশে স্বাস্থ্যখাতে পরিস্থিতি পরিবর্তনের বাস্তবতা বুঝতে পারতে হবে।
জৈব-ঝুঁকি
যুক্তরাজ্যে এমআইসিক্স এবং আমেরিকায় সিআইএ-র মত গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যারা গুপ্তচর হিসাবে মানুষ নিয়োগ করে থাকে, তাদেরও ভবিষ্যতে ভাবতে হবে ঠিক কোথায় তারা কী ধরনের লোক নিয়োগ করবে যারা কী ঘটছে সে বিষয়ে ঠিকমত তথ্য সরবরাহ করতে পারবে।
গোয়েন্দারা যেভাবে আড়ি পেতে কথাবার্তা শোনে তার ধরণও বদলাবে, কারণ তাদের ঠিক করতে হবে তারা কীধরনের তথ্য শুনতে চাইছে। এছাড়াও উপগ্রহ বা অন্যধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে ধরনের গোয়েন্দা নজরদারি করা হয়, সেগুলোকেও হয়ত তথ্য সংগ্রহ করার জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্র, কবরস্থান, শশ্মান এসব জায়গায় কাজে লাগানো হবে।
পারমাণবিক বস্তুর নিশানা পাওয়ার জন্য দূর নিয়ন্ত্রিত প্রযুক্তি ব্যবহার করে এসব জিনিসের ‘গন্ধ শোঁকার’ যেসব কৌশল বর্তমানে আছে, এখন তার সঙ্গে যুক্ত করা হবে স্বাস্থ্য ও জৈব-ঝুঁকি খোঁজার কৌশল।
তবে এসবই করা হবে মূলত গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের চিরাচরিত প্রথা মেনে।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স
ভবিষ্যতে আসল পরিবর্তন আমরা দেখব আরো জটিল তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে। যেমন একটা জনগোষ্ঠির মধ্যে কোনধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে কিনা, তা বুঝতে বা খুঁজতে ব্যবহার করা হবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স (এআই) বা প্রযুক্তির বুদ্ধি।
ফোনের মেটাডেটা (ফোনে সংরক্ষিত তথ্যভাণ্ডার), অনলাইনে ফোন ব্যবহারকারী কী খুঁজছে বা কী করছে সেসব তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা হতে পারে।
চার বছর আগে, সেসময় সিআইএ-র ডিজিটাল প্রযুক্তি উদ্ভাবন বিভাগের পরিচালক আমাকে বলেছিলেন যে তারা এআই এবং ‘আবেগ-অনুভূতি বিশ্লেষণ’-এর মত পদ্ধতি ব্যবহার করে একটা গোটা দেশের জনগোষ্ঠি পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহে কীধরনের কাজ করছেন।
তাদের কাজের লক্ষ্যটা ছিল মূলত কোন একটা ঘটনা ঘটার আগে সম্ভাব্য পরিস্থিতি সম্পর্কে আঁচ পাওয়া- যেমন কোথাও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ার মত অবস্থা তৈরি হচ্ছে কিনা অথবা কোথাও একটা বিপ্লব হতে যাচ্ছে কিনা।
বর্তমান দুনিয়ায় আমেরিকা আর চীনের মধ্যে ইতোমধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের একটা প্রতিযোগিতা চলছে। ওয়াশিংটনে অনেকেরই আশংকা যে আমেরিকা এই প্রতিযোগিতায় চীনের কাছে হয়ত হেরে যাবে, কারণ চীন তথ্য সংগ্রহ এবং তাদের প্রযুক্তি উন্নয়নে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছে।
ভবিষ্যতের তথ্য আদানপ্রদান
তবে যে বিষয়টা এখনও অজানা সেটা হল করোনাভাইরাস মহামারির মত ভবিষ্যত মহামারি সম্পর্কে তথ্য আদানপ্রদানে দেশগুলো পরস্পরের সঙ্গে কীধরনের সহযোগিতা করবে। কোভিড-১৯ সংক্রমণের বিস্তার ঠেকানোর ব্যাপারে দেখা গেছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশগুলোর সমন্বিতভাবে কাজ করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
তাই ভবিষ্যতে এধরনের ঝুঁকি মোকাবেলায় দেশগুলো তাদের গোয়েন্দা তথ্য শেয়ার করার ব্যাপারে কতটা খোলামেলা আচরণ করবে, নাকি সেক্ষেত্রে তাদের জাতীয়তাবাদী মনোভাব প্রাধান্য পাবে সেগুলো এখনও অনিশ্চিত।
এমন আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায় না যে এরকম ঘটনা ঘটলে ভবিষ্যতে দেশগুলো তাদের সীমানা বন্ধ করে দেবে এবং সমস্যা মোকাবেলা করবে অভ্যন্তরীন পর্যায়ে। তারা হয়ত তখন তাদের গোয়েন্দা নজরদারি কেন্দ্রীভূত করবে অন্য দেশ কীভাবে এই সঙ্কট মোকাবেলা করছে, তারা তথ্য লুকাচ্ছে কিনা, কিংবা তারা নতুন গবেষণায় সমাধান পেয়েছে কিনা সেসব জানতে।
জীবাণু সংক্রান্ত গোয়েন্দাগিরি
‘জীবাণু গোয়েন্দাগিরি’র ইতিহাস অনেকদিনের। স্নায়ু যুদ্ধের সময় পাশ্চাত্ত্যের দেশগুলো এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন আপ্রাণ চেষ্টা করত জানার জন্য যে প্রতিপক্ষ কোন গোপন জীবাণু বা স্নায়ু বিকল করার উপাদান (নার্ভ এজেন্ট) তৈরি করছে কিনা। ভবিষ্যতে হয়ত এই গোয়েন্দাগিরিতে জোর দেয়া হবে মারণাস্ত্র তৈরির দিকে নয়, বরং জানার চেষ্টা হবে কে কোন্ ধরনের টিকা তৈরি করছে।
অনেক দিন থেকেই মানুষের একটা আশঙ্কা ছিল যে, সন্ত্রাসীরা বা কোন গোষ্ঠি হয়ত যে কোন সময় জীবাণু অস্ত্র ছেড়ে দিতে পারে। বর্তমান করোনা সঙ্কটের পর এই ধারণা আরও বদ্ধমূল হবে কারণ ইতোমধ্যেই কিছু ইঙ্গিত পাওয়া গেছে যে কোন কোন চরম দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠি ইচ্ছাকৃতভাবে ভাইরাস ছড়ানোর কথা ভেবেছে। তবে আমেরিকার বিচার বিভাগ বলেছেন কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে এমন কাজ করলে তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী তৎপরতার অভিযোগ আনা যাবে।
বর্তমান সঙ্কটের পর একটা প্রশ্ন সামনে আসতে পারে যে যেসব দেশের অভ্যন্তরীণ নজরদারি ব্যবস্থা উন্নত তারা এধরনের ভাইরাসের বিস্তার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহে কতটা আগ্রহী বা উদ্যোগী হবে, যে তথ্য মানুষের চলাচল সীমিত করে এর আরো ব্যাপক বিস্তার ঠেকাতে কাজে লাগবে।
সোজা কথায়, স্বাস্থ্য নিরাপত্তার স্বার্থে গোয়েন্দা নজরদারির জন্য দেশগুলোর ওপর ভবিষ্যতে দেশের ভেতরে যেমন, তেমনি বাইরেও আন্তর্জাতিক পরিসরে চাপ বাড়বে।
মস্কোর পুলিশ কিছু দিনের মধ্যেই নাগরিকদের কাছে মোবাইলে তাদের কিউআর বারকোড চাইবে দেখার জন্য তাদের ঘর থেকে বেরনোর অনুমতি আছে কিনা।
চীন স্মার্টেফানের ওপর নজরদারির জন্য ব্যবহৃত সফটওয়্যার দিয়ে ইতোমধ্যেই একাজ করেছে। রাশিয়া সিসিটিভি এবং মুখ চেনার পদ্ধতি ব্যবহার করে নিষেধাজ্ঞা লংঘনকারীদের ধরেছে। অন্যান্য অনেক দেশ ‘ইলেকট্রনিক বেড়া’ তৈরি করেছে যার মাধ্যমে তারা কোয়ারেন্টিন ভেঙে যারা চলে গেছে তাদের সম্পর্কে অন্য দেশের সাথে তথ্য আদানপ্রদান করেছে।
যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন প্রযুক্তি সংস্থার সঙ্গে কী করা সম্ভব তা নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছে। কিন্তু নাগরিকের স্বাধীনতা নিয়ে যারা কাজ করে তারা এধরনের পর্যবেক্ষণ প্রযুক্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারা মনে করে ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য এধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার যৌক্তিক হলেও, এ প্রযুক্তি হাতের কাছে থাকলে অন্য সময়ে কোন দেশ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারবে।
এছাড়াও ভবিষ্যতে স্বাস্থ্য নিরাপত্তার জন্য সংগৃহীত গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণ করার জন্য যথাযথ দক্ষতাসম্পন্ন লোকের প্রয়োজন থাকবে। সামরিক বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি কাজ করতে হবে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদেরও। অন্যদিকে সংগ্রহ করা তথ্যের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ রাজনীতিকদের কাছে কোনধরনের ‘নিরাপত্তার’ আলোকে উপস্থাপন করা হবে সেটা নিয়েও বিতর্ক আছে।
বর্তমানে করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ে বিশ্বজুড়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের জ্ন্য এই মুহূর্তে বড় প্রশ্ন এই সংক্রমণের ধাক্কা সরকারের প্রশাসন ও তার সামরিক শক্তিকে কতটা দুর্বল করে দিতে পারে এবং তার থেকে কে কোন্ দিক দিয়ে কী ধরনের সুযোগ নিতে পারে।
কিছু গোয়েন্দা সংস্থা এই ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে ইতোমধ্যেই কিছু কাজ করেছে। যেমন জানা গেছে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এক অভিযান চালিয়ে এক লাখ টেস্টিং কিট বিদেশ থেকে আনিয়েছে, কিন্তু পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ সেখানে নেই।
আমেরিকার গোয়েন্দারা জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসেই এই ভাইরাস সম্পর্কে গোপন কিছু তথ্য নীতি নির্ধারকদের হাতে তুলে দিয়েছিল। চীন থেকে সংগ্রহ করা সেসব তথ্যে এই ভাইরাসের ভয়াবহতা সম্পর্কে ইঙ্গিত করা হয়েছিল। কিন্তু খবরে জানা যায় হোয়াইট হাউস কর্তৃপক্ষ সেসব হুঁশিয়ারি আমলে নেয়নি।
ফলে একটা বিষয় থেকেই যায় যে, গোয়েন্দারা যত ভালই গোপন তথ্য সরবরাহ করুক না কেন, ক্ষমতার শীর্ষে যারা আছে তারা এসব তথ্য কতটা গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে এবং তা কাজে লাগাচ্ছে তার ওপরই নির্ভর করে এসব তথ্য শেষ পর্যন্ত মানুষের কতটা উপকারে আসবে।
সূত্র : বিবিসি