২০২৪ সাল হতে চলেছে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বড় নির্বাচনী বছর। আসন্ন এ বছর জুড়ে বাংলাদেশসহ ৭৮টি দেশে হতে যাওয়া জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবেন বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষ। বিশ্বব্যাপী এসব নির্বাচনের ফলাফলই ঠিক করে দেবে সামনের দিনে বিশ্ব রাজনীতি কোন পথে গড়াবে। ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আসতে পারে পরিবর্তন।
ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাংক আটলান্টিক কাউন্সিলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের ৭৮টি দেশে ৮৩টি জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচন হবে এই বছর। ২০৪৮ সালের আগে এক বছরে এত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আর সম্ভাবনা নেই।
জানুয়ারিতে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শুরু হবে ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় নির্বাচনী বছর। নির্বাচনে অংশ নেবে অধিকাংশ মহাদেশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোটার এশিয়া মহাদেশে। এরপর ফেব্রুয়ারিতে দুটি জনবহুল মুসলিম দেশ পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া প্রায় এক সপ্তাহের ব্যবধানে নির্বাচনে অংশ নেবে।
দ্য ইকোনমিস্টের মতে, ব্রাজিল ও তুরস্কের মতো কিছু জায়গায় সাধারণ নির্বাচন হবে না, তবে স্থানীয় বা পৌরসভা নির্বাচন হবে যেখানে পুরো দেশ অংশগ্রহণ করবে। একইভাবে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি সদস্য রাষ্ট্র ব্লকের পরবর্তী সংসদ নির্বাচন করবে। যে দেশগুলো নির্বাচনে যাচ্ছে তাদের মধ্যে অনেকে জি২০ ও জি৭ এর মতো শক্তিশালী জোটের সদস্য। এ কারণে নির্বাচনগুলোতে ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব থাকতে পারে।
তাইওয়ান নির্বাচন: আগামী জানুয়ারি মাসে স্বশাসিত দ্বীপটিতে ভোট হবে। চীনের সঙ্গে টানাপোড়েনের মধ্যেই নির্বাচনের পথে হাঁটছে তাইওয়ান। ফলে বেইজিং-তাইপের এ সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসতে পারে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন।
বর্তমানে ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টির (ডিপিপি) ভাইস প্রেসিডেন্ট ও চীনের কট্টর সমালোচক লাই চিং নির্বাচনী দৌড়ে বেশ এগিয়ে আছেন। তবে চীনঘেঁষা বিরোধীরা জোট গঠন করে নির্বাচনের মাঠে নামলে বিপদে পড়তে পারেন তিনি। নির্বাচনে ডিপিপি পার্টি জয়ী হলে চীনের সঙ্গে তাইওয়ানের উত্তেজনা বাড়বে। দুদেশের ব্যবসায়ও এর প্রভাব পড়বে, বিশেষ করে প্রযুক্তি খাতে। বিভিন্ন কোম্পানির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাও আসতে পারে। এ ছাড়া এই নির্বাচনী ফলাফলের প্রভাব তাইওয়ান প্রণালি পেরিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পড়বে পারে
স্বশাসিত দ্বীপ অঞ্চলটিকে নিজেদের অংশ বলে মনে করে চীন। এমনকি প্রয়োজন হলে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে এর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার কথা জানিয়ে রেখেছে বেইজিং। তাইওয়ানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক না রাখলেও এ বিষয়ে ‘কৌশলগত অস্পষ্টতার’ নীতি মেনে চলে যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে তাইওয়ানকে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র দিয়ে থাকে ওয়াশিংটন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এ নির্বাচনই ওয়াশিংটন-বেইজিং সম্পর্ক ঠিক করে দেবে।
রাশিয়ার নির্বাচন: ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। এমন বৈরী সম্পর্কের মধ্যেই আগামী মার্চে রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। একই সময় প্রতিবেশী ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। তবে রাশিয়া অবাধ বা সুষ্ঠু ভোটের সম্ভাবনা তেমন নেই বলেই মনে করে পশ্চিমারা। ফলে এবারও ভ্লাদিমির পুতিনই জয়ী হবেন।
তবে নির্বাচন ঘিরে রাশিয়ায় বিক্ষোভ দেখা দিতে পারে। রুশ সমাজে বিভাজন বাড়বে। ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে রাশিয়ান নিরাপত্তা বাহিনীর দৃষ্টি কিয়েভের দিকে। ফলে এ সময় দেশে নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়বে পারে। তবে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ক্রেমলিনের মনোভাবের কোনো পরিবর্তন হবে না। ফলে পশ্চিমাদের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক উন্নত হওয়ার কোনো সম্ভবনা নেই। মূলত পুতিনও চাইছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘ করতে। কেননা তিনি মনে করছেন, যুদ্ধ দীর্ঘ হলে ইউক্রেনকে সহায়তা করতে করতে পশ্চিমারা ক্লান্ত হয়ে পড়বে। একপর্যায়ে পশ্চিমা সহায়তায় ভাটা পড়বে।
ভারতে নির্বাচন: ২০১৪ সাল থেকে ভারতীয় রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে আসছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিজেপি। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে ভারতীয়দের মধ্যে একক জনপ্রিয় দল এই বিজেপি। ফলে আগামী মার্চ বা এপ্রিলের সাধারণ নির্বাচনে বিরোধী দলীয় নেতা রাহুল গান্ধীকে পেছনে ফেলে মোদি নির্বাচনী বৈতরণি উতরে যেতে পারেন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই ভারতের পাঁচটি প্রধান প্রদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এসব নির্বাচনের ফল আগামী সাধারণ নির্বাচনের ভিন্ন মাত্রা যোগ করতে পারে।
তৃতীয় মেয়াদে মোদি সরকার ক্ষমতায় এলে ব্যবসাবান্ধব সংস্কারকেই অগ্রাধিকার দেবে। একই সঙ্গে বিশ্বমঞ্চে বৃহত্তর ভারতীয় প্রভাব বাড়ানোর জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে নয়াদিল্লি। ইউক্রেন যুদ্ধের মতো কিছু বিতর্কিত ইস্যুতে নিরপেক্ষ থাকার পাশাপাশি উন্নয়নশীল বিশ্বের নেতা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন অব্যাহত রাখবে ভারত। ভারত ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরও উষ্ণ হবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচন: আগামী বছরের জুন ও জুলাই মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নে ক্ষমতার রদবদল হবে। জুন ও জুলাই মাসে দুই ধাপে ইইউ নির্বাচন হবে। ভোটের মাধ্যমে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নতুন সদস্য নির্বাচন করবেন ইউরোপীয়রা। এর পর জোটের সদস্য দেশগুলো ইউরোপীয় কমিশনের নতুন প্রেসিডেন্ট, কমিশনারসহ প্রধান প্রধান পদে নিয়োগ দেবে।
নির্বাচনকেন্দ্রিক জনমত জরিপ বলছে, এবারের ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বিভক্ত ও অপ্রত্যাশিত হবে। মধ্য-ডান ঘেঁষা ইপিপিই সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে থাকবে। অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী ভাবধারার রক্ষণশীল দলগুলো বড় ধরনের কিছু লাভ করতে পারে।
ইউরোপীয় কমিশনে নতুন জোট ক্ষমতায় এলে বেশকিছু পরিবর্তন আসতে পারে। পরিবেশ ও ডিজিটাল নিয়ন্ত্রণ অগ্রাধিকার পেলেও বিভিন্ন সংস্কার পরিকল্পনার গতি ধীর করার চাপ বাড়বে। ইইউ বাজেটে প্রভাব পড়বে। ফলে কৃষি, অবকাঠামোগত তহবিল ও প্রতিরক্ষা ব্যয় প্রভাবিত হবে। ইইউতে ইউক্রেনের যোগদান বড় ইস্যু হিসেবে দেখা দেবে। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখার চেষ্টা অব্যাহত রাখবে ইইউ। মার্কিন নির্বাচন ঘিরে অনিশ্চয়তার ফলে এ বিষয়টি আরও প্রকট হবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন: বছরের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নভেম্বর এই ভোটের মাধ্যমে ২০২৫ থেকে ২০২৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবেন আমেরিকানরা। এটি প্রায় নিশ্চিত যে এবারের নির্বাচনেও জো বাইডেন-ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বৈরথ দেখবে বিশ্ব। নির্বাচন করলেও ট্রাম্পের আইনি লড়াই শেষ হবে না। তাকে অধিকাংশ সময় আদালতেই খরচ করতে হবে। অন্যদিকে বাইডেনের বয়স ও সক্ষমতা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ রয়েছে। যদিও স্বতন্ত্র ভোটারদের টানতে বাইডেনে আস্থা রাখতে উৎসাহী ডেমোক্র্যাটরা।
আগামী নির্বাচনে বাইডেন নির্বাচিত হয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এলে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। তবে বিপত্তি বাধবে ট্রাম্প সরকার গঠন করলে। এর আগে তিনি ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ট্রাম্প নির্বাচিত হয়ে ফিরলে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি কেমন হবে তা এখনো অস্পষ্ট। একমাত্র সময়ই বলতে পারবে তিনি কোন পথে হাঁটবেন। তবে এটি নিশ্চিত তিনি বাইডেনের সব নীতি থেকে সরে আসবেন।
ইউক্রেনকে দেওয়া মার্কিন সহায়তা কমিয়ে দিতে পারেন ট্রাম্প। ইইউ ও ন্যাটোর সঙ্গে উত্তেজনা ফের দেখা দিতে পারে। চীনের প্রতি কঠোর অবস্থানের দ্বিদলীয় সমর্থন রয়েছে। এর পরও ট্রাম্প এলে চীনবিরোধী নীতি আরও জোরদার হতে পারে।
মে মাসে আফ্রিকার সবচেয়ে শিল্পোন্নত দেশ দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় নির্বাচন। ১৯৯৪ সালে বর্ণবৈষম্যের অবসানের পর থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হিসেবে দেখা হচ্ছে এটিকে। আফ্রিকার অন্যান্য দেশের মধ্যে আলজেরিয়া, বতসোয়ানা, চাদ, কোমোরোস, ঘানা, মৌরিতানিয়া, মরিশাস, মোজাম্বিক, নামিবিয়া, রুয়ান্ডা, সেনেগাল, সোমালিল্যান্ড, দক্ষিণ সুদান, তিউনিসিয়া ও টোগোতে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় নির্বাচন। এই মহাদেশে ২০২৪ সালে সর্বোচ্চ সংখ্যক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আসন্ন ভোটে ক্ষমতাসীন আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসকে (এএনসি) চড়াই-উতরাই পাড়ি দিতে হবে। কারণ আশঙ্কা করা হচ্ছে ক্ষমতায় থাকার জন্য দলটি হয়তো ৫০ শতাংশ ভোটও পাবে না।
আগামী বছরজুড়ে ইউরোপে ১০টির বেশি দেশে সংসদীয় ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। ফিনল্যান্ড, বেলারুশ, পর্তুগাল, ইউক্রেন, স্লোভাকিয়া, লিথুয়ানিয়া, আইসল্যান্ড, বেলজিয়াম, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, ক্রোয়েশিয়া, অস্ট্রিয়া, জর্জিয়া, মলদোভা ও রোমানিয়ার মতো দেশে ক্রমান্বয়ে অনুষ্ঠিত হবে নির্বাচন। বিশ্বের জন্য এই বছরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেছে দ্য ইকোনমিস্ট। তবে ব্যালট বক্সে এই মহান অগ্রযাত্রা মানে গণতন্ত্রের বিস্ফোরণ নয় বলে মনে করছে পত্রিকাটি।