অন্যান্য বছরের তুলনায় দেশে এবার মার্চ-এপ্রিলে সর্দি, জ্বর, হাঁচি, কাশি, গলাব্যথাসহ শ্বাসতন্ত্রের রোগীর সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি। অন্য বছরগুলোয় এই সময়ে গড়ে ২৫ হাজার মানুষ এসব রোগে চিকিৎসা নিলেও এবার এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দেড় লাখ থেকে দুই লাখে। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থাকায় এসব রোগব্যাধিকে কোভিড ১৯-এর লক্ষণ-উপসর্গ মনে করে আক্রান্তরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। এদিকে করোনার উপসর্গ নিয়ে প্রতিদিন অনেকের মৃত্যুও হচ্ছে। গত বুধবার সারাদেশে এমন অন্তত ১৩টি মৃত্যুর খবর জানা গেছে। সব মিলিয়ে সর্দি-জ্বর নিয়ে এখন দেশে এক ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
আবহাওয়া পরিবর্তনজনিত এসব রোগকে ‘ছোট’ বিবেচনা করে আগে সাধারণত মানুষ কমই চিকিৎসা নিতেন। কয়েক দিনে এসব অসুখ সেরেও যেত। বড়জোর এলাকার ফার্মেসি থেকে নিজেরাই ওষুধ নিয়ে সেবন করে সুস্থ হয়ে যেতেন। কিন্তু এসব রোগের সঙ্গে কোভিড ১৯-এর লক্ষণ-উপসর্গের মিল থাকায় এখন সামান্য হাঁচি-কাশিতেই মানুষ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হচ্ছেন। ফলে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার একই সময়ে এসব অসুখে চিকিৎসা গ্রহণকারীর সংখ্যাও বেড়ে দাঁড়িয়েছে কয়েকগুণ। সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে চিকিৎসকরা বলছেন, সর্দি-জ্বর হলেই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। স্বাভাবিকভাবে কয়েক দিনের মধ্যে সেরে না গেলে বা শ্বাসকষ্ট শুরু হলেই কেবল করোনা ভাইরাসের শনাক্তের পরীক্ষা করা উচিত। তবে সতর্কতার অংশ হিসেবে পুরো সময়ই সচেতন থাকতে হবে। অন্যের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে।
দেশে গত মাসের শেষদিকে সর্দি, জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্টের রোগীর সংখ্যা হঠাৎ বাড়তে থাকে। গত কয়েক বছরের তুলনায় চলতি বছর মার্চ-এপ্রিলে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। অন্যান্য বছরের এই সময়ে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ এসব রোগের চিকিৎসা নিয়েছেন। এ বছর সেখানে প্রতিদিন দেড় লাখ থেকে দুই লাখ মানুষ চিকিৎসা নিচ্ছেন। এর মধ্যে এক লাখের বেশি মানুষ ঘরে বসে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে টেলিমেডিসিন সেবা নিচ্ছেন। এ ছাড়া এক লাখের বেশি মানুষ বিভিন্ন হাসপাতাল ও দেশের প্রান্তিক অঞ্চলে থাকা প্রায় ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন।
চিকিৎসকরা বলছেন, শীতের সময় মানুষ সর্দি, জ্বর, কাশি, গলাব্যথা, টনসিল ও বাত-ব্যথা, ব্রংকাইটিস, সিওপিডি, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়াসহ শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হয়। আবার ঋতু পরিবর্তনের কারণেও এ ধরনের কিছু রোগব্যাধির প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। কিন্তু গরমে এই ধরনের রোগী বেশি হয় না। অথচ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং মাঠপর্যায়ের তথ্য বলছে, এবার শীতকাল থেকে এই সময়েই বেশি মানুষ সর্দি, জ্বর, হাঁচি, কাশি, গলাব্যথা ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, সিজন পরিবর্তনের কারণে হাঁচি, কাশি, সর্দি, জ্বর ও গলাব্যথা এ ধরনের রোগ হয়ে থাকে। তবে এসব রোগব্যাধি সাধারণত শীতকালে বেশি হয়, গ্রীষ্মকালে কম হয়। আগে সাধারণত সর্দি, জ্বর ও গলাব্যথা হলে এমনি ২-৩ দিন পর ভালো হয়ে যেত। কিন্তু কোভিড ১৯-এর লক্ষণ-উপসর্গের সঙ্গে এসব রোগের মিল থাকায় এখন কেউ হাঁচি, কাশি, সর্দি, জ্বরে আক্রান্ত হলেই ওই রোগের ভয় কাজ করে। আক্রান্তরা শঙ্কিত হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছেন বেশি।
তিনি আরও বলেন, মানুষ যে ঘরে বসে টেলিমেডিসিন সেবা নিচ্ছেন এটি খুবই ভালো। দেশে কোভিড ১৯-এর কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয়ে গেছে। সর্দি, অল্প জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্ট হলেই কোভিড ১৯-এর কথা মাথায় রাখতে হবে। করোনার সংক্রমণ আছে কিনা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে। ৮০ শতাংশ করোনা ভাইরাস সংক্রমণই বাড়িতে থেকে ভালো হয়ে যায়। তাই যারা টেলিমেডিসিন সেবা নিচ্ছেন তাদের শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করবেন।
সর্দি, জ্বর, হাঁচি কাশি ও গলাব্যথার রোগী বেড়ে গেলেও আক্রান্তদের অনেকে করোনা সংক্রমণের ভয়ে হাসপাতালে যাচ্ছেন না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকেও সংক্রমণরোধে অতিজরুরি না হলে হাসপাতালে না যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। সরকার করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে হাসপাতালে সীমিত আকারে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছে। এ অবস্থায় রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এবং হাসপাতালে গিয়ে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর টেলিমেডিসিন সেবা চালু করে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আইইডিসিআরের হটলাইনে ১ লাখ ১২ হাজার ৬৫৩ জন ফোন দিয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর আগের দিন বুধবার সকাল ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ১ লাখ ১৮ হাজার ৫৪৭ জন, মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ১ লাখ ১৫ হাজার ৯০৪ জন টেলিফোনে সেবা নিয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে মানুষ সর্দি, জ্বরে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। ওই সময় সারাদেশে কী সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে সেবা নিচ্ছেন তা মনিটরিং করা হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার বলেন, শীতকাল এলে কিছু রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। বিশেষ করে সর্দি, জ্বর, কাশি, শ্বাসতন্ত্রের রোগ ও ডায়রিয়ার হার বেড়ে যায়।
এ ছাড়া আমাশয়, জন্ডিস ও চোখের প্রদাহ বাড়ে। যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন তাদের তথ্য কন্ট্রোল রুম থেকে সংগ্রহ করা হয়। চলতি বছরের নভেম্বরে সর্দি-জ্বরসহ একিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশন (এআরআই) বা শ্বাসতন্ত্রের জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা গ্রহণকারী ২৫ হাজার ৯৩৭ জন, ডিসেম্বরে ২২ হাজার ৪৫৯ জন, জানুয়ারিতে ২৬ হাজার ৪৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২৪ হাজার ৯৫০ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ১৫ মার্চের পর সর্দি-জ্বরসহ কমন ফ্লুয়ের রোগীদের তথ্য সংগ্রহ বন্ধ করে দেয়। মার্চের ১৫ তারিখ পর্যন্ত ১১ হাজার ৯৩০ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। আর শেষদিন ১৫ মার্চ (২৪ ঘণ্টায়) সর্দি-জ্বরসহ এআরআই রোগে ৬৫০ জন আক্রান্ত হয়েছে চিকিৎসা নেন।