এতোকাল বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া বা বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর মানুষজনই কেবল বিনা চিকিৎসায় মারা যেত! কিন্তু আমেরিকা বা ইউরোপের মতো উন্নত দেশগুলোতেও যে মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে পারে- তা ছিলো অবিশ্বাস্য। বিনা চিকিৎসায় আমেরিকায়ও মানুষ মারা গিয়েছে, এটা কাউকে বললে হয়তো ভাববে নিশ্চয় পাগল। কিন্তু এটাই আজ বাস্তবতা। পুরো আমেরিকায় করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৭৮৫ জন মানব সন্তান বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছে। গত ১৪ এপ্রিল এ ভয়াবহ তথ্য প্রকাশ করেছে নিউইয়র্ক সিটির হেলথ ডিপার্টমেন্ট।
আমেরিকার ৫০টি স্টেটের মানুষই আজ জীবনঘাতী কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত। গত কয়েক মাস ধরে করোনাভাইরাস বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাণ্ডব চালালেও প্রায় এক মাস ধরে ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে আমেরিকায়। প্রাণঘাতী এ ভাইরাসে মহাশক্তিধর রাষ্ট্র আমেরিকার জনজীবন আজ বিপর্যস্ত। এই মহামারির আঘাতে পুরো আমেরিকার মানুষ গৃহবন্দী হয়ে পড়েছে।
এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আমেরিকায় করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৩৪৮। মারা গেছে প্রায় ২৮ হাজার ৫৫৪। অন্যদিকে ৫০টি স্টেটের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অবস্থা নিউইয়র্কে। এখানে আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ ২ হাজার ৩০০ জনের বেশি মানুষ। প্রাণহানির সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১১ হাজার।
মূলত আমেরিকায় করোনার তাণ্ডব শুরু হয় মধ্য মার্চ থেকে। যা এখনো চলছে। তবে এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। যদিও এখনো লকডাউন অব্যাহত রয়েছে। নিউইয়র্কে লকডাউন চলবে আগামী ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত।
নিউইয়র্কে করোনা এতটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিলো যে, কোন হাসপাতালেই বেড খালি ছিলো না। আক্রান্ত মানুষের স্রোত নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন হোটেল বিখ্যাত সব অডিটোরিয়াম স্টেডিয়াম, এমন কি জাহাজকেও হাসপাতালে পরিণত করা হয়েছে। পরিস্থতি মোকাবিলায় বিভিন্ন স্টেট থেকে ডাক্তার, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মী আনতে হয়েছে। সর্বোপরি সেনাবাহিনীকেও মাঠে নামাতে হয়েছে। এতো মানুষ আক্রান্ত হয়েছে যে, অনেকেরই হাসপাতালে জায়গা হয়নি। সেই সাথে অভাব ছিলো বিভিন্ন মেডিকেল সরাঞ্জামের। এ সময় সবচেয়ে বেশি এবং অবর্ণনীয় কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে ডাক্তার, নার্স, পুলিশ, এ্যাম্বুলেন্স কর্মী, ফায়ার সার্ভিসের লোকজনের। তারা এখনো মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সংসার থেকেও সংসার নেই, স্বামী- সন্তান থেকেও যেন নেই। অনেকটা হোমলেসের মত জীবন কাটাচ্ছেন। ঘুমানোর সময় নেই, খাবার সময় নেই, অবসরের সময় নেই। তারা যেন নিজেদের জীবন মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করে দিয়েছেন।
আক্রান্ত অনেকেই প্রথমে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। যাদের অবস্থা সিরিয়াস ছিলো না, তাদের সাধারণ ফ্লুর ওধুষ দিয়ে বাসায় হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। অন্যদিকে যারা হাসাপাতালে গিয়েছে, তারাও ঠিক মতো চিকিৎসা পায়নি। কারণ- ছিলো না পর্যাপ্ত ভেন্টেলেইটরসহ অনেক কিছু। মাঝখানে নিউইয়র্ক সিটিতে নাই নাই রব উঠেছিলো। এক রোগীর জিনিস আরেক রোগীকে দেয়া হয়েছিলো। অনেক রোগী দিনের পর দিন হাসপাতালের ফ্লোরে পড়েছিলেন।
অনেক ডাক্তার এবং নার্স বর্ণনা করেছেন অমানবিক চিত্র। তারা বলেন, আমরা হাসপাতালগুলোতে দেখেছি অসহায় মানুষের কান্না, আহাজারি। কিন্তু আমাদের কিছুই করার ছিলো না।
তারা বলেন, প্রথমত, করোনাভাইরাসের কোন ওষুধ নেই; দ্বিতীয়ত, হাসপাতালগুলোতে কোন বেড খালি ছিলো না। যা আমরা এ জীবনে আর কখনোই দেখিনি।
তারা আরো বলেন, আমরা মানবতাকে হাসপাতালের বেডে পদদলিত হতে দেখেছি। কখনো এভাবে অসহায়ভাবে মানুষের মৃত্যুর মিছিল দেখিনি। ইতিহাসে যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুর মিছিলের কথা শুনেছি, কিন্তু এবার নিজ চোখেই নিউইয়র্কে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের মৃত্যুর মিছিল দেখেছি। লাশের মিছিল দেখেছি, বেওয়ারিশ লাশ দেখেছি। মানুষের আর্তনাদ শুনেছি, জীবন রক্ষার করুণ আকুতি দেখেছি! কিন্তু মিথ্যা শান্তনা দেয়া ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার ছিলো না।
নিউইয়র্ক হেথ ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে- পুরো আমেরিকায় করোনাভাইরাসের আক্রান্ত প্রায় ৪ হাজার মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকেই নিজের বাসায়, কেউবা নার্সিং হোমে, আবার কেউবা হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে।
বিজ্ঞানের এই চরম উৎকর্ষের যুগেও অসহায়ের মত মৃত্যুবরণ করতে দেখেছি। হাসপাতালে সিট না থাকার কারণে অনেককেই বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। তাদের মধ্যে অনেকেই অসহায়ভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশীও রয়েছেন। আবার অনেকে ভয়ে হাসপাতালে যাননি, নিজেরাই প্রাইভেট ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ এমন ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিলো যে, হাসপাতালে গেলেও কপালে মৃত্যুই যেনো লেখা ছিলো অবধারিত।