নানামুখী চাপের মধ্যেও বাড়ছে ঈদ অর্থনীতির বাজার। মূলত ২০২০ সালের মহামারী করোনার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সংকুচিত হয়ে পড়ে উৎসবের অর্থনীতি। এ বছর বেড়েছে ঈদ অর্থনীতির বাজার। তবে ভাটা পড়েছে পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষের অর্থনীতিতে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক মন্দা উপেক্ষা করে এবার ঈদুল ফিতর ও পহেলা বৈশাখ ঘিরে মানুষের মধ্যে রয়েছে আনন্দের আমেজ।
অর্থনীতিবিদরা জানান, উৎসব অর্থনীতির আকার, ধরন ও ব্যাপ্তি আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। মানুষ এই উৎসব ঘিরে প্রচুর পরিমাণ অর্থ খরচ করেন। পোশাক, ভোগ্যপণ্য, শৌখিনতা ও ভ্রমণসহ বিনোদনমুখী খাতে বেশি ব্যয় হয়। এতে উৎপাদনকারী, আমদানিকারক, ব্যবসায়ী প্রত্যেকে কিছু না কিছু লাভবান হচ্ছেন। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর হিসাবে প্রতিবছর জাকাত ও ফিতরা বাবদ খরচ হচ্ছে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। এই টাকার সিংহভাগ গ্রামে যাচ্ছে। যে কারণে টাকার প্রবাহ বাড়ছে। এ ছাড়া গ্রামের দরিদ্র মানুষের সহায়তায় শহরের লোকজন সাধ্য অনুযায়ী অর্থের জোগান দিচ্ছে।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, রমজান ও ঈদকে কেন্দ্র করে ১ লাখ ৬৫ হাজার থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। এর মধ্যে জাকাত থেকে ৭০ হাজার ১২৫ কোটি টাকা, অতিথি আপ্যায়ন থেকে ২৮ হাজার ৫০ কোটি টাকা, ইফতার ও সেহরি থেকে ৮ হাজার ১৬০ কোটি টাকা, পরিবহন থেকে ৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, ফিতরা থেকে ৪৬৭ কোটি টাকা, বোনাস থেকে ১ হাজার ৪৫ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়।
সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন আমাদের সময়কে বলেন, এবার ঈদে বেচাকেনা ভালো। তবে এ বছর ঈদ ও বৈশাখ একই সঙ্গে হওয়ার এবার বৈশাখের আমেজ খুব একটা নেই। ঈদের মধ্যে বৈশাখ পড়ে গেছে। ঈদের পর ৭ দিন দোকানপাট বন্ধ থাকে। তবে এ বছর হয়তো বৈশাখের আমেজ থাকবে, তবে ব্যবসা পাব না।
এদিকে ঈদ সামনে রেখে সদ্যবিদায়ী মার্চ মাসে দেশে রেমিট্যান্স (প্রবাসী আয়) এসেছে ১৯৯ কোটি ৬৮ লাখ মার্কিন ডলার। এই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে দেশে এসেছে ৬ কোটি ৪৪ লাখ ডলার রেমিট্যান্স। এদিকে অভ্যন্তরীণ বেচাকেনায় গতি ফিরেছে অর্থনীতিতে।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এবার শবেবরাতের পর থেকে কেনাকাটা করছেন নগরবাসী। আর এখন ঈদ সামনে রেখে ব্যবসায়ীদের দম ফেলার সময় নেই। গভীর রাত পর্যন্ত ক্রেতারা কেনাকাটা করতে মার্কেটে আসছেন। ক্রেতাদের ভিড়ে ঠাসা দেশের মার্কেট, বিপণিবিতান, ফ্যাশন হাউস ও শোরুমগুলো। তবে এবার পোশাকসহ অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম ১৫-৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ফলে গত বছরের মতো বেচাবিক্রি ও কেনাকাটা সমান হলেও ক্রেতাদের বাড়তি টাকা খরচ করতে হয়েছে। ফলে এ বছর ঈদের ব্যয় বেড়েছে। ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মানুষের সঞ্চয় কিছুটা কমতে পারে। এ ছাড়া ঈদ ও পহেলা বৈশাখের লম্বা ছুটির কারণে অর্থনীতিতে কিছুটা বাড়তি চাপ তৈরি হতে পারে।
জানা গেছে, ঈদে সব ধরনের নিত্যপণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ভোজ্যতেল, মাংস, চিনি, ডাল, সেমাই ও পেঁয়াজ। ফলে এসব পণ্যের আমদানিও বাড়ে। রোজা ও ঈদে ভোজ্যতেলের চাহিদা প্রায় তিন লাখ টন, চিনি দুই লাখ থেকে পৌনে তিন লাখ টন, ডাল ৬০ থেকে ৭০ হাজার টন, ছোলা ৫০-৬০ হাজার টন, খেজুর ১৫ হাজার টন, পেঁয়াজ ৩ লাখ ৫০ হাজার থেকে ৪ লাখ টন এবং রসুনের চাহিদা প্রায় ৮০ হাজার টন। এসব পণ্য আমদানিতে ব্যবসায়ীদের নিজস্ব টাকার পাশাপাশি ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের জোগান দেওয়া হয়। ১৪ লাখ সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী অষ্টম বেতন কাঠামোর আলোকে ঈদ বোনাস পাচ্ছেন। এ ছাড়া বেসরকারি অফিস-প্রতিষ্ঠানগুলোও নিজস্ব কাঠামোতে বোনাস দিচ্ছে। পোশাক ও বস্ত্র খাতের প্রায় ৭০ লাখ কর্মীর বোনাসও রয়েছে, যা পুরোটাই যোগ হচ্ছে ঈদ অর্থনীতিতে।
ঈদ উৎসব অর্থনীতিতে সারাদেশের দোকান কর্মচারীদের বোনাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির হিসাবে দেশে ২৫ লাখ দোকান, শপিংমল, বাণিজ্য বিতান রয়েছে। গড়ে একটি দোকানে তিনজন করে ৬০ লাখ জনবল কাজ করছে। একজন কর্মীকে ৬ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা করে বোনাস দেওয়া হয়। যা পুরোটাই ঈদ উৎসব অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ আমাদের সময়কে বলেন, দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়। গত দুই বছর ধরে প্রকৃত মজুরি কমেছে। ফলে নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। তবে অনেকে মূল্যস্ফীতি থেকে লাভবান হচ্ছে। দেশের মানুষ উৎসব করতে পছন্দ করে। ফলে ঈদকে কেন্দ্র করে মানুষের কেনাকাটা বাড়ে।