সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০১:১৯ অপরাহ্ন

মোদিতেই গদি চীনা চিকন খেল

মোস্তফা কামাল
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ৪ জুন, ২০২৪
  • ৭৮ বার

এবার সময় কিছুটা টলটলে হলেও বেশ টনটনে ছিলেন নরেন্দ্র মোদি। টলমলে হননি। হাল ছাড়েননি একটুও। নানা জটিল-কঠিন পরিস্থিতি উতরানোর হিম্মত অনেকবার দেখিয়েছেন উত্তর-পূর্ব গুজরাটের ভাদনগরে জন্ম ও বেড়ে ওঠা নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি। এবারের ম্যাজিকে আরেক রকমফের। নানান যদি, তবে, কিন্তু, অথচ ইত্যাদির ফের কাটিয়ে রাজনীতি-কূটনীতির আরেক অধ্যায় এই পাক্কা ম্যাজিশিয়ানের। উচ্চমার্গের কনফিডেন্স ও মাইন্ডসেটে রবিবার লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার আগেই ফুরফুরে মুডে ‘দাপ্তরিক কাজ’ শুরু করে দেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দিনটিতে বেশ আয়েশে অন্তত সাতটি বৈঠক করেন। জানিয়ে দেন তিনি তো আছেনই, থাকবেনও। বৈঠকগুলোর বিষয় নিশ্চিত করেছেন নিজেই। এক্সে (সাবেক টুইটার) লিখেছেন, ‘ঘূর্ণিঝড় ও পরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, সেই বিষয়ে পর্যালোচনার জন্য বৈঠক হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করতে কী ধরনের কর্মকা- হচ্ছে, তা নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়।’ এ ছাড়া তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর প্রথম ১০০ দিনে বিজেপি কী ধরনের কাজ করতে পারে বা প্রতিশ্রুতি দিতে পারে, তা-ও পর্যালোচনা করা হয়। নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই তৃতীয় মেয়াদে কী ধরনের কাজ নতুন সরকার করতে পারে, তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেছিলেন মোদি। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রী এবং আমলাদের কিছু দায়িত্বও দেওয়া হয়েছিল বিষয়টি দেখভাল করার জন্য। ফলাফল ঘোষণার দুদিন আগে এ বৈঠকে সেই পরিকল্পনা কিছুটা খতিয়ে দেখেন প্রধানমন্ত্রী। ফলাফলের পরদিন, আগামীকাল ৫ জুন এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসটা একটু অন্যরকম আয়োজনে করার বিষয়েও আলোচনা হয় আয়েশি বৈঠকটিতে। অপজিশনের অবস্থা অনেকটা বাংলাদেশের মতো ‘মানি না, মানি না’ করা।

আকাশি কুর্তা, সাদা ধুতি পরে বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়ালে মোদির ৪৫ ঘণ্টা ধ্যানও ভালো লাগেনি তাদের। একদম খাঁটি সেবায়েতের মতো তার পূজা করার ভিডিওতে দেখা যায়, বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়ালে খালি পায়ে জপমালা হাতে পায়চারি করছেন মোদি। তারপর সূর্যোদয়ের সময় সূর্যকে অর্ঘ্য দান। কখনো বেদির সামনে বসে প্রাণায়াম, কখনো জপমালা। বিবেকানন্দের বিগ্রহের পায়ে ফুল সাজিয়ে বিগ্রহের চারপাশে ঘুরে আবার ধ্যান। সব মিলিয়ে এক অন্যরকম আয়োজন। বিরোধীরা হিংসায় জ্বলছে। সমালোচনাও করছে। তাদের দাবি, মোদির এমন পূজা-অর্চনায় আদর্শ নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন তোলেন, ‘মানুষ কি ক্যামেরা সামনে রেখে পূজা করে?’ এসব প্রশ্ন ও সমালোচনা উপভোগ করেছেন মোদি। একদিকে নির্ভার মোদি ও তার বিজেপি। বুথফেরত জরিপের ফলাফলে আয়েশ-উল্লাস। বিপরীতে দীর্ঘ বৈঠক কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের। ভিডিও কলে সারা দেশের প্রার্থীদেরও যুক্ত করা হয়। ভোট গণনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত তাদের সজাগ থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। আর বুথফেরত জরিপকে উল্লেখ করা হয় ‘ভাঁওতা’ নামে। ভিডিও বার্তায় আলাপ করা ছাড়াও ফলাফল ঘোষণার পরে তাদের নীতি কী হবে, তা নিয়ে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে, রাহুল গান্ধী, জয়রাম রমেশ, কে সি ভেনুগোপালসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা দলের লোকসভা প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। বলা হয়, ভোট গণনার দিনে কারচুপির যেকোনো অপচেষ্টার বিষয়ে সতর্ক থাকতে। ভাঁওতা ও কারচুপির তথ্যগত প্রমাণ রাখতে। কংগ্রেসসহ অপজিশনের অসহায়ত্ব ও মোদি মহলের এমনতর মাস্তির মধ্যে ছেদ ফেলে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা। ৭ দফা লোকসভা নির্বাচন শেষ হওয়ার পর নদীয়ায় প্রতিপক্ষের হামলায় প্রাণ যায় কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপিকর্মী হাফিজুল শেখের। হাফিজুল শেখের পরিবার বরাবর সিপিএমের সমর্থক। তার এক ভাই সিপিএমের টিকিটে গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য। হাফিজুল কয়েক মাস আগে বিজেপিতে যোগ দেন তৃণমূলের ভয়ে। কিন্তু তাতেও তার শেষরক্ষা হলো না। মাথাসহ তার সারা শরীরে এলোপাতাড়ি গুলি করে সবশেষে মৃত্যু নিশ্চিত করতে হাফিজুলকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়। ঘটনার পরপরই গ্রামবাসী এক হয়ে তৃণমূলকে দায়ী করে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন।
নদীয়ার পর একই চিত্র দেখা গেছে, পশ্চিমবঙ্গের সন্দেশখালিতে। সেখানে পুলিশ নির্বাচন শেষে গ্রামে ঢুকে সাধন নন্দী নামের এক ব্যক্তিকে বিনা দোষে আটক করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তবে গ্রামবাসী সাধন নন্দীকে পুলিশ থেকে ছিনিয়ে নেন। এরপর পুলিশ সাধন নন্দীকে উদ্ধারের জন্য সন্দেশখালির আগারহাটির মন্ডল পাড়ায় তার বাড়িতে অভিযানের নামে অত্যাচার শুরু করে। এই পরিস্থিতিতে পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদে সন্দেশখালির নারীরা বিক্ষোভ শুরু করেন। ওই গ্রামে ১৪৪ ধারা জারি করেছে প্রশাসন। শুধু সন্দেশখালি নয়, আজ পশ্চিমবঙ্গের আরও কয়েক জায়গায় সহিংসতা হয়েছে। বারাকপুরে বোমা ফাটানো হয়েছে। বেলেঘাটা বিধাননগরেও হামলা হয়েছে। ফলে বহু এলাকায় বিজেপির কর্মীরা বাড়িছাড়া। এই সব সহিংসতার ঘটনার পর বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার ক্রসফায়ারের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘বিজেপি ক্ষমতায় এলে উত্তর প্রদেশের স্টাইলে ট্রিটমেন্ট করা হবে। ঠিকমতো ওষুধ দেওয়া হবে। এনকাউন্টার হবে।’ খেলার ওপর এ খেলা আরও কয়েকটি রাজ্যে। যার তাপ-উত্তাপ নির্বাচনের আগ থেকেই। যার মধ্যে রাজনীতি-কূটনীতিরও মিশেল। এরই আংশিক ম্যাজিক মালদ্বীপ থেকে অর্ধেকের বেশি ভারতীয় সেনা সরিয়ে আনা। ডেটলাইনের আগেই কাজটি সেরে ফেলেছেন মোদি। এ নিয়ে বিশ্লেষণ দু’রকমের। তিনি পিছু হটলেন, না-কি নয়া কোনো কৌশল নিলেন? ঘুরছিল প্রশ্নটি। গেল বছর ভারতবিরোধী শক্ত অবস্থানের সাফল্যে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাজিমাত করেন মোহাম্মদ মুইজ্জু। এরপর তিনি দীর্ঘদিনের মিত্র ভারতকে ছেড়ে আরও ঝুঁকে পড়েন চীনের দিকে। মুইজ্জু ও তার দলের অভিযোগ, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে মালদ্বীপকে ছারখার করে দিয়েছে ভারত। অভিযোগ পর্যন্তই নয়, দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ভেঙে দিল্লি সফর বাদ দিয়ে বেইজিং সফর করেন মুইজ্জু। এর সুফলও পান তিনি। তার দল সংসদ নির্বাচনেও ভালো করেছে। এর মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে ভারতের বলয় থেকে বেরিয়ে চীনের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠতার নজির তৈরি হয়েছে। ভারত মহাসাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে উদ্বেগে রয়েছে ভারত। মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশে চীনের প্রভাব সেই উদ্বেগে বাড়তি টোকা ফেলে। লোকসভা নির্বাচনে ভোটের দফাগুলোতে ভোটারদের মনোভাব ও পারিপার্শ্বিকতা মোদির দল ক্ষমতাসীন বিজেপির জন্য হয়ে পড়ে উদ্বেগের। স্বভাবে ধীরস্থির হলেও মোদির আচরণ, ভাষা, ভাবভঙ্গির অস্থিরতার খবর চাপা থাকেনি। তার মুসলিমবিরোধী কিছু বক্তব্যের ঝাঁজ কেবল ভারত নয়, আশপাশের দেশগুলোতেও পড়ে। ‘কংগ্রেস সরকার গঠন করলে ভারতে হিন্দুদের জমিজমা, সহায়-সম্পত্তি মুসলমানদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে দেবে’ তার এমন বক্তব্য ব্যাপক সমালোচিত হয়। মুসলমানদের ভারতীয় না বলে ‘অনুপ্রবেশকারী’ ও ‘গন্ডায় গন্ডায় বাচ্চা পয়দা করা লোক’ বলেও মন্তব্য করেছেন মোদি। কম কথার মানুষ অমিত শাহও কম যাননি। তিনি বলেই ফেলেছেন, বিজেপি হেরে গেলে ভারতে শরিয়াহ আইন চালু হয়ে যাবে। কংগ্রেসের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ, দলটির নেতা রাহুল গান্ধীর হেলিকপ্টারে তল্লাশি, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে কয়েদ করার মতো নিম্নমানের বাঙালিপনা ভারতের রাজনীতিতে নতুন সংযোজন। যা সাধারণ ভোটারদের তুষ্ট করার বদলে আরও রুষ্ট করেছে। কিন্তু, সব পেছনে ফেলে দিন শেষে গদির ম্যাজিকে মোদিই সেরা। এই সেরার সেরার পিছু ছাড়ছে না চীন। চিকন খেলায় ভারতকে ঘিরে ধরছে।
নির্বাচনী ঢোলের বাদ্যের মধ্যেও মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা ও নেপাল সফর করেছে চীনা সামরিক বাহিনীর একটি প্রতিনিধিদল। সফরের উদ্দেশ্য হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা বিষয়ে সহযোগিতা জোরদারের কথা বলছে বেইজিং। প্রতিনিধিদল প্রথমে গেছে মালদ্বীপে। দেশটির প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জুর সঙ্গে বৈঠকও করে। পরে দুদেশের মধ্যে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী, মালেকে বিনামূল্যে অস্ত্র দেবে বেইজিং। ভারত মহাসাগরে চীন আধিপত্য বিস্তারে কঠিন নিরাপত্তা বলয় তৈরি করছে। ভারতই এখানে মূল টার্গেট। টার্গেট বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে এরই মধ্যে মালদ্বীপে চীনপন্থি সরকার ভারতের জন্য উদ্বেগের।  মালদ্বীপের প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কায়ও চীনের প্রভাব বাড়ছে। নেপালের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক চীনের। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও চীনকে ছাড়তে চায় না বাংলাদেশ। ভারতের শত্রু দেশ পাকিস্তান তো আছেই। মায়ানমারের উত্তরাংশ (বাংলাদেশ-মায়ানমার-ভারত সীমান্ত) এখন ভারতবিরোধী চীনাপন্থি আরাকান সেনাবাহিনীর দখলে। এ বাস্তবতার সন্ধিক্ষণে ভারতের নাকের ডগায় চুপিসারে যুদ্ধবিমান মোতায়েন করছে চীন। রাডারে ধরা না পড়ায় চিকন চোখে বিমানগুলোকে ঠাহর করা সম্ভব নয়। উপগ্রহ চিত্রে দেখা যায়, সিকিম সীমান্ত থেকে অন্তত ১৫০ কিলোমিটার দূরে চীন অধিকৃত তিব্বতের শিগাৎসে বিমানবন্দরে ছটি অত্যাধুনিক জে-২০ যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছে চীন। পশ্চিমবঙ্গের হাসিমারা সেনাঘাঁটি থেকে বিমানবন্দরটির দূরত্ব ২৯০ কিলোমিটারেরও কম। এই হাসিমারাতেই রয়েছে ভারতের দ্বিতীয় রাফাল বিমানঘাঁটি। সচরাচর চীনের পূর্বাংশে জে-২০ যুদ্ধবিমানগুলো মোতায়েন থাকে। কিন্তু হঠাৎ ভারত সীমান্তের এত কাছে যুদ্ধবিমান মোতায়েন একটি ঘোর তৈরি হয়েছে। ভারত এ ব্যাপারে গা-ছাড়া নয়। সীমান্ত সুরক্ষায় রাশিয়ার তৈরি এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধী ব্যবস্থা মজুদ রয়েছে পূর্ব ভারতে। গোটা আবহটি মোটেই চিকন নয়। মোটাদাগের ঘটনা ভারতসহ আশপাশের জন্য।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com