দক্ষিণ এশিয়ার চারটি বড় দেশ কতটা সফলভাবে কোভিড-১৯ মোকাবিলা করছে, তার এক তুলনামূলক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে এক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কার পারফরম্যান্স সবচেয়ে ভাল, আর ভারতের সবচেয়ে খারাপ।
প্রায় ভারতের মতোই শোচনীয় অবস্থা পাকিস্তানেরও, আর বাংলাদেশের অবস্থা ভারত-পাকিস্তানের তুলনায় একটু ভাল। এই গবেষণাটি করেছেন ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস আমহার্স্টের দুজন ভারতীয় অধ্যাপক, দীপঙ্কর বসু ও প্রিয়াঙ্কা শ্রীবাস্তব।
তারা জানাচ্ছেন, দৈনিক রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি কিংবা মৃত্যুর হার – সব দিক থেকেই ভারতের অবস্থা দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ।
করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ভারতের সাফল্যের ছবিটা তুলে ধরতে দেশের সরকার প্রতিনিয়ত তুলনা টানছেন আমেরিকা বা ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে।
যদিও গবেষক প্রিয়াঙ্কা শ্রীবাস্তব ও দীপঙ্কর বসুর মতে নানা কারণে সেই তুলনাটা সঙ্গত নয় – বরং ভারতের সঠিক তুলনা হতে পারে দক্ষিণ এশিয়ারই অন্য দেশগুলোর পরিস্থিতির সঙ্গে। আর সেখানে দেখা যাচ্ছে, মোটামুটি সব সূচকেই শুধু ভারত নয় – অন্য সব দেশের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে আছে শ্রীলঙ্কা।
কীভাবে সাফল্য এল শ্রীলঙ্কাতে?
শ্রীলঙ্কাতে কোভিড মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন সেনা কমান্ডার, লে: জেনারেল সভেন্দ্র সিলভা।
তিনি জানাচ্ছেন, “যদিও আমাদের প্রথম রোগী শনাক্ত হয় মার্চের ১১ তারিখে, আমরা কিন্তু কোভিড টাস্ক ফোর্স গড়ে তুলেছিলাম জানুয়ারির ২৬ তারিখেই। উহান থেকে তখনই আমরা ৩৪ জন ছাত্রকে বিশেষ বিমানে ফিরিয়ে আনি, তাদের জন্য বিশেষ কোয়ারেন্টিন সেন্টার তৈরি করে আর্মি।”
“এখন আমাদের দেশের তিন চতুর্থাংশ এলাকা লকডাউনের বাইরে, সেখানে সব কিছুই স্বাভাবিকভাবে চলছে। আমরা দেশবাসীকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার গুরুত্ব বোঝাতে পেরেছি, বেস্ট প্র্যাকটিস অব মেডিসিন বোঝাতে পেরেছি।”
শ্রীলঙ্কায় শিক্ষার হার খুব বেশি, সেটা যদি মানুষকে বোঝানোর ক্ষেত্রে দারুণ কাজে এসে থাকে তাহলে আবার সেই একই কারণে ভুগতে হয়েছে পাকিস্তানকে।
ইসলামাবাদে পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সের ড: নাসিমা আখতার বলছেন, “গ্রামীণ এলাকায় কিংবা শহরেরও ঘিঞ্জি এলাকায়, যেখানে স্বাক্ষরতার হার কম, সেখানে মানুষকে বোঝাতে আমাদের যথেষ্ঠ বেগ পেতে হয়েছে।”
“অনেক জায়গায় আমরা যে ব্যর্থ হয়েছি তাতেও সন্দেহ নেই। এই যেমন রোজার পবিত্র মাসেও সবাই মসজিদে নামাজ পড়তে যেতে চাইছেন, আমরা আটকাতে পারছি না অনেক ক্ষেত্রেই।”
মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা দেখেছেন, দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশ তাদের ৫০তম রোগী রিপোর্ট করার পর পরবর্তী চল্লিশ দিনে কীভাবে সেই দেশগুলোতে সংক্রমণ ছড়িয়েছে।
এখানেও সেরা পারফর্মার শ্রীলঙ্কা – তাদের মোট রোগীই শুধু ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে অনেকগুণ কম নয়, দৈনিক বৃদ্ধির হারও গত বেশ কিছুদিন ধরে কমছে।
ভারত-পাকিস্তান এখানে চলেছে প্রায় পরস্পরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। তুলনায় সামান্য ভাল অবস্থানে বাংলাদেশ, যদিও সেখানে মহামারির প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে একটু দেরিতে।
লকডাউন জারি আর মৃত্যুর হার
ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ফিল্ড গবেষক অনিন্দিতা অধিকারী বলছিলেন, “ভারতে রাতারাতি লকডাউন জারি করা হয়েছিল রাজ্যগুলোর সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই। বহু রাজ্যের আমলারা আমাকে বলেছেন তাদের মুখ্য সচিবরাও এই লকডাউনের ব্যাপারে ঘুণাক্ষরে কিছু জানতেন না।”
“স্বাস্থ্যগত দিক থেকে লকডাউন হয়তো জরুরি ছিল, ছোট একটা দেশে সেই ফর্মুলা হয়তো খেটেওছে। কিন্তু যেভাবে কোনও সমন্বয় ছাড়া ভারতে কেন্দ্রীয়ভাবে এটা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেটা ছিল নিশ্চিতভাবেই একটা বিপর্যয়ের রেসিপি।”
দক্ষিণ এশিয়ার কোন দেশে কোভিড কতটা প্রাণঘাতী চেহারা নিয়েছে, দীপঙ্কর বসু ও প্রিয়াঙ্কা শ্রীবাস্তব তাদের গবেষণায় সেটাও দেখিয়েছেন।
বাংলাদেশে মৃত্যুর হার শুরুতে সাঙ্ঘাতিক বেশি হলেও মাসখানেকের মধ্যে তারা সেটা দুই শতাংশের নিচে নামিয়ে আনে। শ্রীলঙ্কায় এখন সেটা মাত্র এক শতাংশের মতো।
ভারত ও পাকিস্তানে কিন্তু মৃত্যুর হার এখনও বেড়েই চলেছে – এবং চারটি দেশের মধ্যে ভারতেই এই মুহূর্তে সেই হার সর্বোচ্চ, সাড়ে তিন শতাংশেরও বেশি। বিবিসি।