রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৪৩ পূর্বাহ্ন

বিডি ডেইলি অনলাইন ডেস্ক :
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ১২ আগস্ট, ২০২৪
  • ৩৫ বার

ঠিক ১০ বছর তিন মাস আগে নরেন্দ্র মোদি যখন প্রথমবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিচ্ছেন, তখন প্রতিবেশী সবগুলো দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানদের দিল্লিতে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে বিরাট একটা চমক দিয়েছিলেন তিনি। এমন কী ‘দাওয়াত’ পেয়েছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফও। মোদি সরকার সেই প্রথম দিন থেকেই বরাবর বলে এসেছে তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে প্রতিবেশীরা।

এই নীতিটারই পোশাকি নামকরণ করা হয়েছে ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ বা ‘প্রতিবেশীরা সবার আগে’ – এবং দিল্লিতে সরকারের মন্ত্রী বা নীতি-নির্ধারকরা গত এক দশকে বার বার বলে এসেছেন, নরেন্দ্র মোদির পররাষ্ট্রনীতির মূল স্তম্ভ এটাই!

অন্যভাবে বললে, ভৌগোলিকভাবে যারা ভারতের চেয়ে দূরে (সে আমেরিকাই হোক বা নাইজেরিয়া) তাদের চেয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় ঘরের কাছের প্রতিবেশীদের (শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, নেপাল প্রভৃতি) সাথে সম্পর্ককে ভারত বেশি গুরুত্ব দেবে এবং তাদের স্বার্থকে প্রাধান্য দেবে- এটাই হলো ‘নেইবারহুড ফার্স্টে’র সার কথা।

তবে মুখের কথা একটা জিনিস, বাস্তবেও যে সব সময় মোদি সরকারের কাজে তার প্রতিফলন দেখা গেছে তা কিন্তু নয়। পশ্চিমের বন্ধুরা যেমন অনেক সময়ই দিল্লির কাছে দৃশ্যত বেশি গুরুত্ব পেয়েছে, দিল্লিকে অনেক বেশি মাথা ঘামাতে হয়েছে চীনকে নিয়েও।

এখন ‘নেইবারহুড ফার্স্টে’র এক দশক পরে এসে দেখা যাচ্ছে যে শ্রীলঙ্কাকে চরম আর্থিক সঙ্কটের সময় ভারত অনেক সাহায্য করেছে। সে দেশের সরকারও দিল্লির ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে চীনা গোয়েন্দা জাহাজকে তাদের বন্দরে ভিড়তে দিচ্ছে।

নেপালে নতুন সংবিধান প্রণয়নের সময় ভারতের প্রচ্ছন্ন সমর্থনে যে ‘অর্থনৈতিক অবরোধ’ কর্মসূচি পালিত হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে সে দেশের সাধারণ মানুষ ভারত-বিরোধী প্রতিবাদে ফেটে পড়েছেন। নেপালের ক্ষমতাতেও আছেন কে পি শর্মা ওলি, যিনি কট্টর ভারত-বিরোধী বলেই পরিচিত।

মালদ্বীপেও গত বছর ভারতপন্থী একটি সরকারকে হঠিয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছেন মোহামেদ মুইজ, যিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরই তার দেশ থেকে সব ভারতীয় সেনা সদস্যকে সরিয়ে নেয়ার দাবি জানিয়েছেন। তার দলের ‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন মালদ্বীপে ভালো সাড়া ফেলেছে, প্রেসিডেন্ট মুইজ চীনের দিকে ঝুঁকছেন কোনো রাখঢাক না-করেই।

এমন কী, যে ভুটান সামরিক, বৈদেশিক বা অর্থনৈতিক- প্রায় সব ক্ষেত্রে ভারতের ওপর নির্ভরশীল, তারাও চীনের সাথে আলাদাভাবে সীমান্ত আলোচনা শুরু করেছে, কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে চীনের প্রস্তাবকেও সরাসরি নাকচ করে দেয়নি।

আফগানিস্তান ও মিয়ানমারে যে দু’টি সরকার এখন ক্ষমতায়, তাদের সাথেও ভারতের সম্পর্ক ভালো- এ কথা বলা চলে না কোনোমতেই।

তালেবানের সাথে যেমন ভারতের এখনো পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্কই স্থাপিত হয়নি আর এই দু’টি দেশেই বিভিন্ন খাতে ভারতের শত শত কোটি টাকার বিনিয়োগ এখন প্রবল অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।

এই তালিকায় সবশেষ সংযোজন বাংলাদেশ- বিগত দেড় দশক ধরে ভারতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সরকার ক্ষমতায় থাকার পর রাতারাতি সেই সরকার বিদায় নিয়েছে।

তাছাড়া সাড়ে তিন বছর আগে নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময়ই তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও সহিংসতা তুঙ্গে উঠেছিল। সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনেও যে একটা প্রবল ভারত-বিরোধী চেহারা ছিল তা পর্যবেক্ষকরা প্রায় সবাই মানেন।

তাহলে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতেই কি এমন কিছু গুরুতর ত্রুটিবিচ্যুতি আছে, যাতে একের পর এক প্রতিবেশী দেশে ভারত-বিদ্বেষী মনোভাব মাথা চাড়া দিচ্ছে? না কি বৃহত্তর দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক কাঠামোটাই এমন যে ভারতের জন্য এই পরিণতি এক রকম অবধারিত ছিল?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই বিবিসি বাংলা ভারতে ও ভারতের বাইরে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক, অধ্যাপক, সাবেক রাষ্ট্রদূত বা কূটনৈতিক ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের সাথে বিশদে কথা বলেছে। তাদের প্রত্যেকের বক্তব্যের সারাংশই এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হল।

ইরফান নূরউদ্দিন
আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসিতে জর্জটাউন ইউনিভার্সিটিতে যে ‘স্কুল অব ফরেন সার্ভিস’ আছে, সেখানে ‘ভারতীয় রাজনীতি’র অধ্যাপক ড: ইরফান নূরউদ্দিন। গবেষণা করেন অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বিশ্বায়ন, গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রায়ন এবং সিভিল কনফ্লিক্ট নিয়ে।

প্রথমেই বলব, দক্ষিণ এশিয়া হলো সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে কম সমন্বিত ও সংযুক্ত (‘লিস্ট ইনটিগ্রেটেড’) অঞ্চল। এখানে একটা দেশ থেকে আর একটা দেশের মধ্যে চলাচল বা আন্তঃসীমান্ত যোগাযোগ যতটা কঠিন আর জটিল, তেমনটা সারা পৃথিবীর আর কোনো অঞ্চলে নয়।

বাণিজ্যের কথা যদি বলি, সাব-সাহারান আফ্রিকার গরিব দেশগুলোর মধ্যেও যে পরিমাণ ইন্টার-রিজিওনাল ট্রেড হয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ তার চেয়েও কম। অথচ দুই বিলিয়ন বা দুই শ’ কোটিরও বেশি মানুষ থাকেন শুধু এই কয়েকটি দেশে, অনায়াসে তা বিশ্বের প্রধান একটি ‘ইকোনমিক হাব’ হয়ে উঠতে পারত।

কাজেই এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় আর প্রভাবশালী দেশটির সাথে বাকিদের সম্পর্ক যে সহজ আর স্বাভাবিক নয়, এটা বুঝতে রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না। আর ভারতের পররাষ্ট্রনীতির কাটাছেঁড়া করলে দেখব মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা বা নেপাল- কোনো প্রতিবেশীর ক্ষেত্রেই তারা দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক স্থাপনের লক্ষ্য নিয়ে বহুমাত্রিক (মাল্টি ডাইমেনশনাল) কোনো নীতি নিয়ে কখনো এগোয়নি। বরাবর প্রাধান্য দেয়া হয়েছে স্বল্পকালীন স্বার্থ বা শর্ট-টার্ম ইন্টারেস্টকে, আর তার জন্য সঙ্কীর্ণ, সন্দেহদুষ্ট একটা একমাত্রিক নীতি নিয়েই এগোনো হয়েছে।

ভারতের বর্তমান সরকার যেমন তাদের ‘হিন্দু আইডেন্টিটি’কে পররাষ্ট্রনীতির একটা প্রধান স্তম্ভ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে আর সেটা যথারীতি ব্যাকফায়ার করেছে বাংলাদেশের মতো একাধিক মুসলিম প্রধান দেশে।

নরেন্দ্র মোদি সরকারের আনা নাগরিকত্ব আইনের মূল লক্ষ্যটাই ছিল তাই, ভারতীয় রাষ্ট্রকে হিন্দুদের অন্তিম আশ্রয় হিসেবে তুলে ধরা। ভারতের নেতা-মন্ত্রীরা দেশের ভেতরে ‘বাংলাদেশী’ শব্দটাকে অবৈধ মুসলিম অনুপ্রবেশকারীর প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার করেছেন অনবরত, আর অন্য দিকে বাংলাদেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক দারুণ উন্নত হয়েছে বলে ক্রমাগত দাবি করে গেছেন। কিন্তু এই দু’টির মধ্যে একটা মারাত্মক স্ববিরোধিতা আছে, যেটা বেশি দিন ধামাচাপা দিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি।

এই প্রসঙ্গে আরো বলব, গত এক দশকে আমরা ভারতের প্রতিবেশী অনেকগুলো দেশেই দেখেছি সে দেশের সরকার হয়তো ভারতের প্রতি খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ। কিন্তু সে দেশের সাধারণ মানুষ ভারত-বিরোধিতায় ফুঁসছেন। এই একই জিনিস বাংলাদেশে ঘটেছে, নেপালে ঘটেছে, এবং মালদ্বীপেও ঘটেছে।

কিন্তু স্থিতিশীলতা বা গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে ভারত কখনো সে সব দেশের মানুষের ক্ষোভ বা উষ্মাকে ‘অ্যাড্রেস’ করার চেষ্টা করেনি, বরং ধরে নিয়েছে ওই দেশের সরকার পাশে থাকলেই তাদের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকবে।

আর এর কারণটাও সহজ, যেটা আগেই বললাম, ভারত প্রতিবেশী দেশগুলোতে নিজেদের স্বল্পকালীন স্বার্থের হিসেব করেই এগিয়েছে, দীর্ঘমেয়াদে কী হবে তা নিয়ে কখনো মাথা ঘামায়নি। আর একটার পর একটা দেশে তার পরিণামও ভুগতে হচ্ছে তাদের। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার ছোট ছোট দেশগুলো যে ভারতকে একটি ‘রিজিওনাল হেজেমন’ বা আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী শক্তি হিসেবে দেখে, তাই তার একটা নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিত আছে, কারণ আছে।

ভারত নিজেকে একটি আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায় সেটা বোঝা গেল। কিন্তু তা করতে হলে এই দেশগুলোর প্রতি তাদের কিছু দায়িত্বও পালন করতে হবে এবং একটা ‘বহুমাত্রিক’ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে- যেটা এখন প্রায় অনুপস্থিত।

এস ডি মুনি
দিল্লির জেএনইউ ও সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-সহ বিশ্বের বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ছিলেন ড: মুনি। লাওসে ভারতের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত ছিলেন, কাজ করেছেন দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ভারতের বিশেষ দূত হিসেবেও। দিল্লির থিঙ্কট্যাঙ্ক আইডিএসএ-তে ডিস্টিংগুইশড ফেলো হিসেবেও যুক্ত।

নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় এসেই যে ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ ঘোষণা করেছিল, গোড়ায় গলদ ছিল সেখানেই।

আমি বলব এই ঘোষণার পেছনে কোনো গভীর চিন্তাভাবনার চাপ ছিল না, বরং ওটা ছিল একটা ‘নি-জার্ক রিঅ্যাকশন’ বা দুম করে নেয়া সিদ্ধান্ত।

কারণ ঘটা করে সার্ক দেশগুলোর সব নেতাদের মোদির শপথগ্রহণে আমন্ত্রণ জানানোর কিছুদিন পরেই আমরা দেখলাম, পাকিস্তান থেকে একটি বাণিজ্যিক প্রতিনিধিদল যখন দিল্লিতে এলেন তাদের সাথে কাশ্মীরের হুরিয়ত নেতাদের দেখাই করতে দেয়া হলো না। অথচ ওই বৈঠকের জন্য হুরিয়ত নেতারা আগেভাগেই দিল্লি এসে অপেক্ষা করছিলেন।

এখন পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের সাথে হুরিয়ত নেতাদের দেখা করতে না দেয়াই যদি উদ্দেশ্য হয়, তাহলে তাদের শ্রীনগর থেকে দিল্লি আসতে দেয়াটাই তো উচিত হয়নি! আবার পাকিস্তানের সাথে কোনো আলোচনা ভারত যদি না-ই চায়, তাহলে নওয়াজ শরিফকে শপথ গ্রহণে আমন্ত্রণ জানানোরও কোনো প্রয়োজন ছিল না।

এরকম উদাহরণ আমি আরো বেশ কয়েকটা দিতে পারি, যা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় নেইবারহুডের দেশগুলোকে গুরুত্ব দেয়াটা কখনওই এই নীতির উদ্দেশ্য ছিল না। সোজা কথায় নেইবারহুড ফার্স্ট নয়, আসলে ওটা ছিল একটা ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ পলিসি!

নরেন্দ্র মোদির জমানায় পররাষ্ট্রনীতির রূপায়নে ভারত আরো দু’টি মারাত্মক ভুল করেছে বলে আমি মনে করি।

প্রথমত, ইনটেলিজেন্স বা গোয়েন্দা অ্যাপারেটাসের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা। গোয়েন্দা তথ্য দরকার সেটা ঠিক আছে, কিন্তু গোয়েন্দাদের চোখ দিয়ে যদি আমরা একটি প্রতিবেশী দেশকে বিচার করার চেষ্টা করি এবং তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিই সেখানে আমাদের নীতি বা কৌশল কী হওয়া উচিত তাহলে যা হওয়ার তাই হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, এই মোদি জমানার আগে আমরা কখনো দেখিনি ভারতের শাসক দলকে পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের কাজে সক্রিয়ভাবে যুক্ত করা হয়েছে।

মোদি ১.০ বা মোদি ২.০-তেও দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নন, বরং আরএসএস নেতা রাম মাধব স্থির করতেন নেপাল, বাংলাদেশ, মিয়ানমার বা কিছুটা পাকিস্তানেও ভারত কী নীতি নিয়ে এগোবে।

বিজেপি ও আরএসএসের ওই প্রভাবশালী নেতার হাতেই নেইবারহুডের এতগুলো দেশে ভারতের কৌশল নিরূপণের ভার ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। ভারতের জন্য তার ফল যে সুখকর হয়নি, সেটা তো এখন দেখাই যাচ্ছে।

বর্তমান বাংলাদেশের প্রসঙ্গে যদি আসে, সেখানেও ভারতের পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতার পেছনে অনেকগুলো কারণকে দায়ী করা যায়।

যেমন- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সে দেশে সঠিক রাস্তায় এগোচ্ছেন না এবং তার বিরুদ্ধে জনরোষ পুঞ্জীভূত হচ্ছে সেটা তাকে কখনো ভারত স্পষ্ট ভাষায় খেয়ালই করিয়ে দেয়নি।

তিনি যদি ভারতের ভালো বন্ধু হন, তাহলে তো তাকে সিরিয়াসলি ‘নাজ’ করারও দরকার ছিল, যেটা কখনো করা হয়নি! তার ওপর চরম গোয়েন্দা ব্যর্থতা তো ছিলই।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের আগেও ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক সচিব পি এন হাকসার কিন্তু নিরাপত্তার স্বার্থে হেলিকপ্টারে করে তাকে সরিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাতে রাজি হননি সেটা অন্য কথা, কিন্তু তার জীবনের ওপর যে হুমকি আছে সেটা ভারতের জানা ছিল।

এক্ষেত্রে যে শেখ হাসিনাকে সরিয়ে দেয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকতে পারে, ভারত সেটা ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারেনি।

আমি তো বলব, শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিকভাবে সমর্থন করে ভারত কার্যত একটা ‘ব্ল্যাঙ্ক চেক’ লিখে দিয়েছিল- সেটাই এখন বুমেরাং হয়ে ভারতের কাছে ফিরে এসেছে!

সৌমেন রায়
সৌমেন রায় ভারতের একজন সাবেক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিবিদ, রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন একাধিক দেশে। মধ্যপ্রাচ্য ও বাংলাদেশ তার বিশেষ আগ্রহ, চর্চা ও গবেষণার ক্ষেত্র।

প্রথমেই একটা জিনিস স্পষ্ট করে বলা দরকার, ভারতের আশেপাশের দেশগুলোতে যা ঘটছে সেটাকে আমি ভারতের পররাষ্ট্রনীতির বা ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ পলিসির ব্যর্থতা বলে মনে করি না।

সারা পৃথিবীতে প্রায় সব দেশেই নানা কারণে রাজনৈতিক উথালপাথাল চলছে, দক্ষিণ এশিয়াও তার বাইরে নয়।

এখন নেপালে, মালদ্বীপে বা বাংলাদেশে যদি রাজনীতির পটপরিবর্তন হয় বা ক্ষমতার নাটকীয় পালাবদল ঘটে, তাহলে তার জন্য প্রধানত দায়ী সে সব দেশের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ ডায়নামিক্স।

ধরা যাক, এগুলোর মধ্যে কোনো একটা দেশে একজন শাসক দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় আছেন, তার বিরুদ্ধে ‘অ্যান্টি ইনকামবেন্সি’ সেন্টিমেন্ট বা শাসক-বিরোধী অনুভূতি মাথা চাড়া দিচ্ছে।

সেখানে ভারত বা ভারতের পররাষ্ট্রনীতি চাইলেও কিছু করতে পারবে না, ওই দেশ তার রাজনৈতিক গতিপথের ভবিতব্য মেনেই চলবে।

তাহলে কি আমি বলতে চাচ্ছি, এই সব প্রতিবেশীদের সাথে ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সব মসৃণভাবে চলছে? না, সেটাও কিন্তু ঠিক নয়।

এই সম্পর্কগুলোর ক্ষেত্রেও নানা ধরনের ‘ফল্টলাইন’ আছে, থাকারই কথা আর সেই ফাটলগুলো কখনো সখনো বেড়ে গিয়ে বড় সমস্যাও তৈরি করছে।

কিন্তু ভারতের সাথে এই দেশগুলোর আকারে, সামরিক বা অর্থনৈতিক শক্তিতে কিংবা বৈশ্বিক প্রভাবে যে বিপুল ফারাক, তাতে কিন্তু এই ফল্টলাইনগুলো থাকবেই।

ভারতকে ও তাদের প্রতিবেশীদের এই বাস্তবতাগুলো মেনেই এগিয়ে চলতে হবে। সম্পর্কেও নানা ওঠাপড়া থাকবে অবধারিতভাবে। আবারো বলি, কোনো দেশে নাটকীয় পটপরিবর্তন হলে তাতে অন্য যেকোনো ফ্যাক্টরের চেয়ে সবচেয়ে বড় ভূমিকা থাকে তাদের নিজস্ব ও অভ্যন্তরীণ ঘটনাপ্রবাহের।

এখন যদি ধরি কাঠমান্ডু, কাবুল, মালে বা ঢাকায় এক সাথে চারটি ‘ভারত-বিরোধী’ সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তাহলে আমি কিন্তু সেটাকে নিছকই সমাপতন (কোইনসিডেন্স) বলেই ধরব।

বিভিন্ন দেশের সাথে ভারতের সম্পর্কে ওঠাপড়া থাকবেই, এখন হয়তো তিনটি বা চারটি দেশে একসঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কটা একটা চ্যালেঞ্জিং পর্বে প্রবেশ করল, তা তো হতেই পারে!

বরং আমি যেটা মনে করিয়ে দিতে চাই, ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোতে (এক পাকিস্তান ছাড়া) যখন যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, দিল্লির সাথে তাদের আলোচনার রাস্তা কিন্তু কখনো বন্ধ হয়নি।

মালদ্বীপের মুইজ সরকার পর্যন্ত দিল্লিতে এসে ভারতের সাহায্য চেয়েছে, নেপালের সাথে সহযোগিতা অব্যাহত থেকেছে সব পর্যায়ে।

বাংলাদেশেও যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক দিল্লি ও ঢাকাকে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ও সহযোগিতা রক্ষা করে চলতেই হবে কারণ এর উল্টোটা কোনো বিকল্প নয়, কখনো ছিলও না।

এই যে ‘ওয়ার্কিং রিলেশনশিপ’টা আগাগোড়া বজায় রাখা, এটাকে আমি তো দিল্লির সাফল্য বলেই মনে করি।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে অনেকেই ভারতের সমালোচনা করে বলেন, ওখানে ভারত নাকি ‘সব ডিম একই ঝুড়িতে’, অর্থাৎ শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগের ভরসায় ফেলে রেখেছিল, আর আজকে ভারতকে তারই দাম চোকাতে হচ্ছে।

এই সমালোচকদের উদ্দেশে আমার পাল্টা প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে কি ভারতের জন্য সত্যিই কোনো দ্বিতীয় ঝুড়ি কখনও ছিল?

সোজা কথায়, যে সব রাজনৈতিক শক্তির অতীত ও বর্তমান পুরোটাই ভারত-বিরোধিতায় ভরা, তাদের সাথে হাত মেলানো দিল্লির পক্ষে সম্ভব ছিল না। একে আপনি নীতির ব্যর্থতা বলুন বা অন্য যা খুশি বলুন, প্রকৃত বাস্তবতা এটাই!

সঞ্জয় কে ভরদ্বাজ
দিল্লির জহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটিতে ‘সেন্টার ফর সাউথ এশিয়া স্টাডিজের বহু বহু বছর ধরে যুক্ত ড: ভরদ্বাজ, ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানও ছিলেন দীর্ঘদিন। ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করছেন বহুকাল ধরে, বাংলাদেশেও কাটিয়েছেন দীর্ঘ সময়।

ভারত একটি বৃহৎ আঞ্চলিক পরাশক্তি (রিজিওনাল সুপারপাওয়ার), যারা ক্রমশ একটি বৈশ্বিক শক্তি (গ্লোবাল পাওয়ার) হয়ে উঠতে চায়।

ভারতের এই লক্ষ্য পূরণে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর একটা বড় ভূমিকা আছে, কারণ নিজের ভৌগোলিক অঞ্চলে প্রতিবেশীদের স্বীকৃতি ও সম্মান না পেলে যেকোনো দেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মর্যাদা পাওয়াটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে তারই স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, প্রতিবেশী দেশগুলোকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে তাদের আস্থা অর্জনের কথা বলা হয়েছে।

এখন এই যে ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ পলিসির কথা বলা হচ্ছে, এটা কিন্তু একেবারে নতুন জিনিস কিছু নয়।

সেই তিন দশক আগে প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রকুমার গুজরাল দক্ষিণ এশিয়াতে ‘গুজরাল ডকট্রিন’ অনুসরণ করার কথা বলেছিলেন, যার মূল কথাটা ছিল ‘নন-রেসিপ্রোসিটি’। অর্থাৎ কি না, প্রতিবেশীরা বিনিময়ে কী করল বা না-করল, তা না-ভেবে সম্পর্ক উন্নত করার জন্য দরকারে একতরফাভাবেই পদক্ষেপ নিয়ে যাও।

আবার মনমোহন সিংয়ের জমানায় এটাকেই একটু অন্যভাবে বলা হল, প্রতিবেশীদের প্রতি ‘জেনেরোসিটি’ বা উদারতা দেখানো হোক, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে তার সুফল এমনিতেই আসবে।

এই প্রসঙ্গে মনে করিয়ে দেয়া যেতে পারে, বাংলাদেশের সাথে ঐতিহাসিক স্থল সীমান্ত চুক্তি কিংবা প্রস্তাবিত তিস্তা চুক্তি, দু’টিরই খসড়া কিন্তু হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের আমলে। আবার নরেন্দ্র মোদির আমলে এটারই নামকরণ করা হয়েছে ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’, কিন্তু প্রতিবেশীদের ক্ষেত্রে মূল দর্শনটা মোটামুটি একই রকম আছে।

এখন ভারতের একটা বড় সমস্যা হলো, চীনের মতো তাদের ‘ডিপ পকেট’ নেই – অর্থাৎ কি না, প্রতিবেশীদের কোনো বিশেষ প্রকল্পে বিপুল পরিমাণ লগ্নি করার মতো আর্থিক সঙ্গতি তাদের নেই।

অথচ ভারতের প্রতিবেশীরা প্রায় প্রত্যেকেই এক একটি উদীয়মান অর্থনীতি, তাদের নিজস্ব আশা-আকাঙ্ক্ষা আছে, উন্নয়নের অ্যাজেন্ডা আছে- সেটা পূরণ করার জন্য চীন বিশাল অর্থের ভান্ডার নিয়ে এগিয়েও আসছে।

ফলে প্রতিবেশীরা সাংস্কৃতিক বা ভৌগোলিকভাবে যতই ভারতের কাছাকাছি থাকুক- অর্থনৈতিক প্রয়োজনের স্বার্থে তারা অনেকেই চীনের প্রভাব বলয়ে ঢুকে পড়ছে। এসব ক্ষেত্রে চাইলেও ভারতের করার ক্ষমতা আসলে বেশ সীমিত।

অটলবিহারী বাজপেয়ী ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন যখন, তিনি বলেছিলেন আর সব কিছু বদলে ফেলেও আমরা প্রতিবেশী তো আর বদলাতে পারব না, এই ‘ভূগোল’ নিয়েই আমাদের চলতে হবে।

কথাটা কিন্তু ভারতের প্রতিবেশীদের ক্ষেত্রেও সত্যি, ভারত যেখানে আছে সেখানেই থাকবে, তারা চাইলেও ভারতকে তাদের দেশের পাশ থেকে সরিয়ে দিতে পারবে না।

সুতরাং এই দায়িত্বটা পারস্পরিক … সম্পর্ক কেন বিগড়ে গেল, এটার দায় শুধু একটা দেশের নীতির ভুলে হতে পারে না, এখানে দু’টি দেশেরই দায়দায়িত্ব থাকে। যখন উভয়ের স্বার্থটা মিলে যায় তখন সব হয়তো মসৃণভাবে চলে, আবার স্বার্থের সংঘাত হলেই পদে পদে হোঁচট খেতে হয়।

ভারতের বিরুদ্ধে কেন নানা দেশে অসন্তোষ, তার উত্তরেও আমি বলব এর জন্য যেমন ফাংশনাল (ব্যবহারিক) ফ্যাক্টর আছে, তেমনি বেশ কিছু স্ট্রাকচারাল (গঠনগত) ফ্যাক্টরও আছে।

বাংলাদেশ যেমন একটি মুসলিম প্রধান দেশ, ভারতে কোনো মুসলিম নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে সেখানে অসন্তোষ দানা বাঁধতে পারে- এটা ফাংশনাল ফ্যাক্টর।

আবার এই অঞ্চলে ভারতের গঠনগত বৈসাদৃশ্যের জন্যই হয়তো বা ভারতকে প্রতিবেশীরা একটি আধিপত্যবাদী শক্তি হিসেবে দেখে … কিংবা সে সেব দেশে কোনো কোনো শক্তি তাদের নিজেদের স্বার্থে ভারত-বিরোধিতায় ইন্ধন দেয় … এটাকে বলা যেতে পারে স্ট্রাকচারাল ফ্যাক্টর।

এগুলো নতুন কিছু নয়, বহুদিন ধরেই আছে। থাকবেও। কিন্তু প্রতিবেশী কোনো দেশে ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভ মাথাচাড়া দিলেই তার জন্য ভারতের পররাষ্ট্রনীতির ভুল ধরাটা আমার মনে হয় কোনো কাজের কথা নয়!

সূত্র : বিবিসি

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com