এই আগস্টের শুরুতেও ফাহমি, ২৪ (ছদ্মনাম), বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চলাফেরা করেছে জামার আস্তিন গুটিয়ে। তিনি যেখানেই যেতেন সামনে পেছনে দেখা যেত ৩০, ৪০ জন কখনও অগণিত যুবক। আলম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন নেতা। আওয়ামী লীগ ২০০৯ থেকে ১৫ বছরের বেশি সময় বাংলাদেশকে শাসন করেছে শক্ত হাতে। কিন্তু ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অপ্রতিরোধ্য আন্দোলনে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নিয়েছেন আয়রন লেডিখ্যাত শেখ হাসিনা। ফাহমি এবং তার দলবল হাসিনা-বিরোধী বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সহিংস হামলায় নেতৃত্ব দেয়ার জন্য অভিযুক্ত ছিল। হাসিনার পলায়নের পর আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের সব নেতাকর্মী আত্মগোপনে চলে গেছেন। ওই আন্দোলনে সহস্রাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন তার চেয়েও বেশি।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধের দাবি উঠতে থাকে। শেষ পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে বুধবার বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ আর কোনো কার্যক্রম চালাতে পারবে না। ফলিত রসায়ন বিভাগে স্নাতক পর্যায়ের একজন ছাত্র ফাহমি কাতারভিত্তিক সংবাদ সংস্থা আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘কিছুদিন আগে, আমি এখানে কর্তৃত্বের কণ্ঠস্বর ছিলাম। আর এখন আমি পলাতকের মতো ছুটছি, যার কোনো লক্ষ্য বা সম্ভাবনা নেই।’
ফাহমির গল্পটি এমন হাজারো ছাত্রের বর্তমান অবস্থার প্রতিচ্ছবি, যারা পূর্বে আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত ছিল, এক সময় বাংলাদেশের ক্যাম্পাসে যাদের শক্তিশালী দখল ছিল। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে রাতারাতি সব ভেঙে পড়ে। অনেকে আত্মগোপনে গিয়েছেন আবার অনেকে পালিয়ে দেশ ছাড়ার চেষ্টা করতে গিয়ে আটক হয়েছেন। তার ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে ফাহমি বলেন, ‘আমি একজন ভালো ছাত্র ছিলাম, রাজনীতি নিয়ে খুব কমই চিন্তা করতাম। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে রাজনীতি করা অনিবার্য ছিল। আপনি হয় তাদের দলে যোগদান করবেন, নয়তো আপনাকে কষ্ট পেতে হবে।’ তিনি স্বীকার করেছেন, অবস্থা এমন ছিল যে, একজন ছাত্রলীগ নেতা হওয়ায় তার একটি সরকারি চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনাকে জোরালো করবে। একটি সঙ্কুচিত চাকরির বাজারে এটি ছিল আকর্ষণীয় প্রণোদনা। বিশেষ করে দুই বছর আগে বাবার মৃত্যুর পর সংসারের ওপর তার দায়িত্ব বেড়েছে। তার মা, দুই অবিবাহিত বোন এবং ছোট ভাইয়ের দেখভাল করতে হয় তাকে। ফাহিম বলেন, পেছন ফিরে তাকালে, আমি দেখতে পাচ্ছি যে আমি আমার পরিবারকে সমর্থন করার চেয়ে দলের কর্মকাণ্ডকে অগ্রাধিকার দিয়েছি। ফাহমি দুঃখের সাথে বলেছিলেন যে, আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট করেছিলাম আমাদের নেতাদের জন্য এবং দলীয় সমাবেশের আয়োজন করতে, এখন তা অর্থহীন মনে হচ্ছে। দল আমাদেরকে তার রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ব্যবহার করেছে কিন্তু যখন আমাদের প্রয়োজন তখন কোনো সুরক্ষা দেয়নি। হঠাৎ হাসিনার শাসনের পতন; রাগান্বিত জনতার হাত থেকে নিজেকে বাঁচানো আমার পক্ষে সেই সন্ধ্যায় সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল। তারপরও দলের শীর্ষ নেতা বা ছাত্রলীগের ছাত্রনেতা কেউই আমার খোঁজ নেননি।
আওয়ামী লীগ অনুমান করে যে, সারা দেশে তার অন্তত ৫০ হাজার ছাত্র সহযোগী এখন অচলাবস্থায় রয়েছে, তাদের শিক্ষা চালিয়ে যাওয়ার জন্য সংগ্রাম করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মাহবুবুর রহমান আল জাজিরাকে বলেন, অন্য শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার সময় ছাত্রলীগের কোনো নেতার সাথে বসতে রাজি হয়নি। ২৫ অক্টোবর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেয়ার সময় দুই ছাত্রলীগ নেতা- ফিন্যান্স বিভাগের ছাত্র আবুল হাসান সাইদী এবং নৃবিজ্ঞানের ছাত্র কাজী শিহাব উদ্দিন তৈমুর গ্রেফতার হন। প্রক্টর জানান, ‘দুই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা থাকায় তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে।’
একজন ছাত্রনেতা বলেন, ‘ছাত্রলীগ বাংলাদেশে চলতে পারে না। তাদের সব নেতাকর্মীকে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা হবে। ২৩ অক্টোবর ছাত্রসংগঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞার পর থেকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কর্মকর্তারা শহর থেকে অন্তত ১০ ছাত্রলীগ নেতাকে গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন আল জাজিরাকে। সারাদেশ থেকে শতাধিক ছাত্রকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়।
এই অশান্ত পরিবেশের মধ্যে, সুজন আল জাজিরাকে বলেন, তিনি এখন একটি গোপন স্থানে থাকেন। ২১ অক্টোবর আমরা (্আল জাজিরার প্রতিনিধি) একটি নির্জন রাস্তার ধারে একটি খালের ওপরে কাঠ এবং বাঁশের তৈরি একটি ছোট ক্যাফেতে দেখা করি। যেখানে পাশ দিয়ে যাওয়া গাড়িগুলো মাঝে মাঝে থামবে। আমরা একটি কোনার বেঞ্চে ম্লান আলোর নিচে বসেছিলাম যখন সুজন ক্রমাগত জানালার দিকে তার দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছিল, তার চোখ যেন তার উদ্বেগের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে, যখন সে পানির গ্লাস নামিয়ে রাখছে।
এক পর্যায়ে, দু’টি গাড়ি বাইরে এসে থামে, তাদের যাত্রীরা পানির জন্য কিছুক্ষণের জন্য থামে। একজন চওড়া কাঁধের লোক বেরিয়ে আসার সাথে সাথে সুজনের মুখ উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠল, তার কণ্ঠস্বর কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেল তার গল্প শুরু করার আগেই। ‘আমি এমন এক প্রজন্মে বড় হয়েছি যারা শুধু আওয়ামী লীগকেই ক্ষমতায় দেখেছে। তাদের সাথে সারিবদ্ধ হওয়াই একমাত্র বিকল্প ছিল,’ তিনি বলছিলেন। সুজন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি নিচ্ছিলেন এবং আগস্টের অভ্যুত্থান তাকে আত্মগোপনে বাধ্য করার আগে স্নাতক শেষ বর্ষের পরীক্ষা ছিল।
হাসিনার মন্ত্রিসভার সাবেক মন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, বর্তমানে ভারতে নির্বাসিত, ছাত্রলীগের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাহীনতার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করেছেন। তিনি আল জাজিরাকে বলেন, এই সরকার বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার দাবি করছে। তবুও এটি হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে তাদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। যখন সঠিক সময় হবে, আমরা তাদের অধিকারের জন্য লড়াই করব। মুহাম্মদ ইউনূসের ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আবুল কালাম আজাদ মজুমদার আল জাজিরাকে বলেছেন যে ‘প্রত্যেকে নিয়মিত অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে যোগদানের জন্য স্বাধীন, যদি না তার বিরুদ্ধে কোনো অপরাধমূলক অভিযোগ থাকে।’
ভাগ্যের ওলোটপালট : এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্যাম্পাসে একচেটিয়া শাসন করেছে ছাত্রলীগ। সবচেয়ে বড় বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল কোনো রকমে উপস্থিতি বজায় রাখতে সক্ষম হলেও প্রায়শই রক্ষণাত্মক ছিল। আর জামায়াতে ইসলামীর অনুসারী ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে জোরপূর্বক নিষিদ্ধ রাখা হয়। ১৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে অসংখ্য মিডিয়া রিপোর্টে দেখানো হয়েছে যে শিবিরের সাথে সম্পর্ক থাকার সন্দেহে ছাত্রলীগের সদস্যদের দ্বারা ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রদের জোরপূর্বক বের করে দেয়া হয়েছে- নির্যাতন করা হয়েছে বা এমনকি নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। হাসিনা সরকার পতনের কয়দিন আগে একই সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে নিষিদ্ধ করেছিল এই শিবিরকে, যা এখন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আবু সাদিক বলেন, ছাত্রলীগ আধুনিক দাসত্বের ব্যবস্থা তৈরি করেছিল। ভিন্নমতাবলম্বীরা একটি জীবন্ত অগ্নিকাণ্ডের সম্মুখীন হতো। কেউ বেঁচে থাকার জন্য যোগ দিয়েছে, কেউবা ব্যক্তিগত লাভের জন্য। দেশজুড়ে এখন সবার দাবি, সব ছাত্রলীগ কর্মী যারা শিক্ষার্থীদের দমন পীড়নে জড়িত ছিল বা জুলাইয়ের সহিংসতায় যোগ দিয়েছে তাদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।
(আল জাজিরা থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত)